শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫ ১১ শ্রাবণ ১৪৩২
শনিবার ২৬ জুলাই ২০২৫
ত্যাগের উৎসব ঈদুল আযহা
ডা. মো. শহীদুল্লাহ সিকদার
প্রকাশ: সোমবার, ২৬ জুন, ২০২৩, ১০:৫৭ AM

ঈদুল আযহা হল ত্যাগের উৎসব। ত্যাগ আনন্দময় হতে পারে সেই অর্থকে সামনে রেখে মুসলিম উম্মার কাছে প্রতিবছর আসে ঈদুল আযহা। আমরা কখনও কখনও স্বতস্ফূর্তভাবে অথবা নিয়ম রক্ষার জন্য ত্যাগের উৎসব পালন করি। ঈদুল আযহা আমাদের ত্যাগকে আনন্দের মধ্য দিয়ে উৎযাপনের একটি সুযোগ করে দেয়। ত্যাগকে আমরা স্বাভাবিক অর্থে উৎসব হিসেবেÑ না নিজেরা বিবেচনা করি, না সমাজ, দেশ, জাতি বিবেচনা করে। মনে রাখতে হবে, ত্যাগকে সবসময় উদযাপনের প্রয়োজন হয় না। কিন্তু এই ত্যাগকে উৎসব হিসেবে যখন পালন করার সুযোগ হয় তখন এই ত্যাগ এর মূল্য আরো বেশি বেড়ে যায়। এর ফলে ত্যাগ আরো বেশি মহিমান্বিত হয়। কারণ ত্যাগ করার প্রবণতা সব সময় মানুষের মাঝে থাকে না। যেই সকল ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রাপ্তির সুযোগ থাকে না সেই সকল ক্ষেত্রে সাধারনভাবে আমাদের ত্যাগের মানসিকতা কম থাকে। অনেক সময় বাধ্য হয়ে প্রথা রক্ষা করার জন্য অনেক কিছু আমাদের ত্যাগ করতে হয়। সাধারণভাবে মানুষ বেঁচে থাকার জন্য নিয়ত সংগ্রাম করে থাকে। এই সংগ্রামের একটা বিশাল অংশ মানুষ নিবেদন করে সম্পদ আহোরনের ক্ষেত্রে। এই সম্পদ তার নিজের জন্য, পরিবারের জন্যে এবং তার নিকট জনের বেঁচে থাকার জন্য, ভোগ, বিলাস, স্বচ্ছলতা ও সমৃদ্ধির জন্যে অর্জন করে। যেখানে ত্যাগ করার মানসিকতাটা গৌণ হয়ে যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে।

মনে রাখতে হবে খুব পুরনো শব্দ ভোগে সুখ নেই, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ। এই বাক্যটি খুবই মৌলিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই কথাটিকে ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় জীবনে এমনকি সমগ্র মানবজাতির জীবনে চর্চা করা খুব বেশি জরুরি। কারণ ব্যক্তি হিসেবে মানুষ ত্যাগ করবে, এটি একটি মহৎ গুণ। তবে ত্যাগের উদ্দেশ্য যদি থাকে নিজের প্রচার প্রচারণায় বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বা ভিন্ন কোনো বাসনা থাকে তবে সে ত্যাগ শুধু কর্মই হয় তা মহৎ গুণ হিসেবে বিবেচিত হয় না। বলা হয়ে থাকে দান করতে হয় মানুষকে না দেখিয়ে, ডান হাতে দান করলে যেন বাম হাত না জানে। কথাটির মূল অর্থ কিন্তু এই নয় যে আপনার দান আপনি জানাবেন না। দান দেখিয়ে করলেও সেটি আরো বেশি মহৎ হিসেবে মূল্যায়ন হতে পারে যদি তার উদ্দেশ্য মহৎ থাকে। দান করে দানগ্রহীতাকে যেমন ছোট করা যাবে না। উপরন্তু তাকে আরো বেশি বড় করে দেখাতে হবে। মনে রাখতে হবে, যিনি দান গ্রহণ করেছেন তিনি দাতাকে কৃতার্থ করেছেন দান গ্রহণ করে। এর প্রচার-প্রচারণাও মহৎ উদ্দেশ্যে হতে হবে। সমাজের অসহায়, দরিদ্র, অভাগা মানুষকে দান করছি এই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে যেন সমাজের সকলেই এগিয়ে আসে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী; যাতে একার দানের চাইতে সম্মিলিত দান বা ত্যাগ সমাজের চিত্র পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখতে পারে, কারণ দানগ্রহীতা এবং দাতা সমান মূল্যের মানুষ, এই গূঢ় অন্তর্নিহিত অর্থ হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে।

মানুষ হিসেবে নিজের জীবনকে সার্থক করতে ত্যাগের অনুশীলনের কোনো বিকল্প নেই। মহৎ কর্মে নিজের জীবনকে পরিচালনা করার একটা শ্রেষ্ঠ পথ হল দান বা ত্যাগ। দান তো আসলে দান নয়। এটি একটি মহৎ অনুশীলন। দান কোনো মানুষকে দয়া করা নয়, কোনো জীবকে দয়া করার জন্য বা প্রকৃতিকে দয়া করার জন্য নয় বরং আমি আমার নিজের কল্যাণে, নিজের জীবনকে সার্থক করার লক্ষ্যে নিজের জন্যই আমি দানের মত একটি কর্মে অংশগ্রহণ করছি বা অনুশীলন করছি। এ ভালো কাজ নিজের জন্য যেমন ভালো; দেশ, জাতি, সমাজ, দুনিয়ার মানবজাতির জন্য ভালো। এর মাধ্যমে মানবসমাজ আরো সমৃদ্ধ হবে, সকলের জন্যই সমাজ আরো বেশি বাসযোগ্য হবে। এই মহৎ কর্মের উদাহরণ আরো বড় পরিসরে মানুষের কল্যাণে কাজে লাগতে পারে যার অংশীদার সকল মানুষ হতে পারে, বর্তমানের জন্য হতে পারে অথবা ভবিষ্যৎ জন্য হতে পারে। সুতরাং, ত্যাগ করা যে শুধু একটি উপাসনা, ইবাদত বা নেক কাজ তা নয়; এটি মানবকল্যাণে একটি মহৎ সামাজিক কর্ম। এই ত্যাগকে উৎসব হিসেবে যখন পালন করা হয় তখন ত্যাগ আরো বেশি গুরুত্ব পায়, আরো বেশি মহিমান্বিত হয়।

ঈদুল আযহা আমাদের উপর ফরজ হবার পূর্বের যে ইতিহাস আছে তাতে মানুষের বা নিজের সব চাইতে প্রিয় মানুষকে কোরবানি করার মত অসম্ভব কঠিন পরীক্ষার ইতিহাস আমরা জানি। এই কঠিন পরীক্ষাকে মহান সৃষ্টিকর্তা সহজ করে দিয়ে মানুষের মাঝে এই ত্যাগের আদর্শ, চেতনা ধারন করার আদেশ দিয়েছেন। মানুষকে ত্যাগী এবং দানশীল হতে আদেশ দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে এই ত্যাগের অনুশীলন বা চর্চাকে ধর্মীয় বিধান হিসেবে পালন করতে আদেশ দিয়েছেন। এ ধর্মীয় বিধানের মাধ্যমে সমাজের একটি সচ্ছল অংশের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে আসহায় একটি অংশ সাহায্য পাবে। ঈদুল আযহার কোরবানির মাধ্যমে ত্যাগের অনুশীলন আমাদের ত্যাগী হতে উদ্বুদ্ধ করে। এই আনুশীলন জীবনের কল্যাণের বাইরে থাকতে পারে না। তবে সব ধর্মীয় আচার-আচরণে আনন্দ থাকাটা জরুরি। পশুর জীবন উৎস্বর্গ করা বা কোরবারি করা আসলে মানুষের ভিতরের কিছু খারাপ রিপুকে দমন করা বা কোরবানি করার উদ্দেশ্যে মহান সৃষ্টিকর্তার একটি ব্যবস্থা। মানুষ সাধারণভাবে কখনই কিছুতেই তৃপ্ত হতে চায় না। আমাদের চাহিদার কোনো শেষ নেই। আমরা আমাদের নিজের সম্পদে তুষ্ট নই। আমরা আমাদের স্বামর্থের বাইরে যেয়ে অর্থ উপার্জন করি। আমাদের অসীম চাহিদা মেটাতে চাহিদার অতিরিক্ত অর্জন করি, অন্যকে বঞ্চিত করি, অন্যের জিনিস জোরপূর্বক দখল করি, অন্যায়ভাবে মানুষের হক নষ্ট করি। অর্থ, সম্পদ, বিত্ত-প্রাচুর্য পুঞ্জিভূত করে নিজের কাছে কুক্ষিগত করতে ভালোবাসি। এতে অন্যের কোনো অংশ আছে কিনা বা অন্যের কোন ক্ষতি হচ্ছে কিনা কখনই ভেবে দেখি না। নিজের অংশ থেকে আমরা কেউকে ভাগ দেবার মানসিকতা সাধারণভাবে রাখি না। এই সকল খারাপ রিপু মানুষের মনকে কুলসিত করে, অপবিত্র করে। পশু কোরবানির মাধ্যমে এই সকল খারাপ রিপুকে প্রতীকী বিসর্জন দিয়ে আমরা পবিত্র হবার একটি উৎসব পালন করি ঈদুল আযহার মাধ্যমে। কিন্তু এটি শুধু পশু কোরবানির আনুষ্ঠানিকতাই নয় এটি আসলে মানুষের ত্যাগের অনুশীলন।

আমরা সমাজের যারা সচ্ছল শ্রেণি তারা নিজের জন্য, পরিবারের জন্য ভালো খাবার, ভালো পোশাক, ভালো বাসস্থানের ব্যবস্থা করি। কিন্তু যারা নিঃস্ব অসহায় তাদের ভালো খাবার তো দূরের কথা দু’বেলা-দু’মুঠো খাবার জোগাতে হিমসিম খেতে হয়। তাই এই ঈদুল আযহার দিনে যাদের উপর ফরজ তাঁরা পশু কোরবানি করেন। এই কোরবানিতে অসহায়-দরিদ্র মানুষের অংশ আছে তিন ভাগের এক ভাগ। এই অংশ সমাজের অসহায় দরিদ্র-মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয় ফলে তারা ভালো কিছু খাওয়ার সুযোগ পায়। সমাজের মানুষের জন্য মানুষের কিছু করার যে ইচ্ছা থাকা উচিত এবং এটি যে একটি অপরিহার্য করণীয় সেটি প্রকাশ করার জন্য ঈদুল আযহা একটি আনুষ্ঠানিকতা। সে আনুষ্ঠানিকতায় উৎসবের আমেজ থাকবে এবং সকলের সামনে এর মূল গুঢ় সত্য প্রকাশ হবে যে ত্যাগই মানুষকে মানুষের পাশে থেকে সমাজকে সুন্দর করতে অবদান রাখছে। যে ত্যাগ শুধু ব্যক্তির ত্যাগ নয়, ত্যাগ শুধু পরিবারের নয়, ত্যাগ হল সকল মানুষের জন্যে, সমস্ত মানবজাতির জন্য, সৃষ্টির জন্য। বেঁচে থাকার জন্যে যেমন আহার গ্রহণ করতে হয়, অক্সিজেন গ্রহণ করতে হয়, আবাসন লাগে ঠিক তেমনি মানুষের জীবনকে অর্থবহ করতে মানুষের জীবনে ত্যাগের আদর্শ একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ত্যাগের মহীমাকে জাগরুক রাখার একটি চর্চার আনুষ্ঠানিকতা হল ঈদুল আযহা।

আমরা যদি ত্যাগের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজের চিন্তাকে কাজে লাগাই সমাজের কল্যাণে, দেশের কল্যাণে, বিজ্ঞানের কল্যাণে, সাহিত্য-সংস্কৃতির কল্যাণে, মানুষের ভালো লাগার কল্যাণে নিবেদন করি; তাহলেই না আমরা প্রকৃত ত্যাগী মানুষ হতে পারব ঈদুল আহযার প্রকৃত আদর্শে জীবনকে সাজাতে পারব। এর ব্যত্যয় হলে এই আনুষ্ঠানিকতা প্রকৃত পক্ষে কোনো কল্যাণ বয়ে আনবে না।

লেখক : সাবেক উপ-উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত