বাংলাদেশ সরকার সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে। দুজন অতিরিক্ত সচিবকে এই কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভবে চালু করার জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে এই কর্মসূচি আরও বেগবান করার জন্য একটি রেগুলেটরি সংস্থা গড়ে তোলার কাজও সমান তালে এগোচ্ছে।
সব বিচারেই সরকারের এই উদ্যোগটি অভিনন্দন পাওয়ার অধিকার রাখে। সরকারি ও আধা-সরকারি কর্মচারীদের বাইরে প্রায় সবাই প্রবীণ হওয়ার পর দারুণ ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে জীবনযাপন করেন। ছেলে-মেয়েরাও আজকাল আর তাদের বাবা-মায়ের জীবনচলায় ইচ্ছে থাকলেও খুব বেশি কিছু করতে পারে না। যারা প্রবাসে দিন-রাত পরিশ্রম করে পরিবারের জন্য প্রায় সবটুকু আয়-রোজগার পাঠিয়ে দেন, তারাও এক সময় কর্মজীবনের ইতি টেনে দেশে ফিরলে খুবই অসহায় হয়ে পড়েন। তাই প্রস্তাবিত সর্বজনীন এই পেনশন কর্মসূচি প্রবাসীসহ সবার জন্যই এক আশার আলো হিসেবে আবির্ভূত।
বিশেষ করে প্রবাসীদের মাসিক চাঁদার ওপর প্রচলিত আট শতাংশ সুদের ওপর আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা যোগ করার সিদ্ধান্তটি খুবই সংবেদনশীল ও সময়োপযোগী। একই বিনিময় হার চালুর প্রস্তাব করে বাস্তবানুগ একটি মুদ্রনীতি দেওয়ার পরপরই সর্বজনিন পেনশন কার্যক্রম শুরু করার এই সিদ্ধান্ত একদিকে বেশি হারে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে প্রবাসী আয় পাঠাতে প্রবাসীদের উৎসাহিত করবে এবং অন্যদিকে প্রবাসে দিন-রাত পরিশ্রম করা সত্যিকারের জাতীয় বীর এই রেমিট্যান্সযোদ্ধাদের যোগ্য সম্মানও করা হবে।
বলতে দ্বিধা নেই, এক দশক আগেও আমাদের সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিলেন মূলত দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী প্রান্তিক ও ঝুঁকিতে থাকা নাগরিকরা। সে সময়কার বাস্তবতায় এমনটিই প্রত্যাশিত ছিল। গ্রামে থাকা বিপন্ন নারীদের ভিজিডি কার্ডের মাধ্যমে সুবিধা দেওয়া কিংবা কাজের অভাবে ভুগতে থাকাদের জন্য অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচির (ইজিপিপি) মতো কর্মসূচিগুলো ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন করে আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারগুলোকে দারিদ্র্যের দুষ্টচক্র থেকে বের করে আনা গিয়েছে বলেই তাদের কাছে প্রবৃদ্ধির সুফল পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। তবে তাদের জন্য বরাদ্দ যাতে যথাযথভাবে ভুক্তভোগীদের কাছে পৌঁছে এজন্য নিবিড় তদারকি দরকার। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির কোনো কোনো ক্ষেত্রে কতিপয় দায়িত্বশীল অসাধুর অপতৎপরতার খবর সংবাদমাধ্যমে জানা গিয়েছিল।
এক দশক আগে আমাদের মূল ভাবনার জায়গায় ছিল। সবার খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করা, কেউই যেন কাজের অভাবে না ভোগেন, সেটি নিশ্চিত করার মতো বিষয়গুলো। কিন্তু বর্তমানে কেউই আর অভুক্ত থাকছেন না, প্রায় সবারই মাথার ওপর ছাদ আছে, গ্রামেও অকৃষি খাতের বিকাশ ঘটছে। এখন তাই বিপদগ্রস্ত বিধবা কিংবা কর্মহীনতায় ভুগতে থাকা অতিদরিদ্র পরিবারের মতো সুনির্দিষ্ট গ্রুপের কল্যাণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পাশাপাশি আমাদের সবার জন্যই আরেকটু সুরক্ষিত জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেওয়ার মতো কর্মসূচি প্রণয়ন নিয়ে ভাবতে হবে। আমরা খুবই আশান্বিত হয়েছি যখন জানা গেল যে সরকারও বরাবরের মতো সাধারণ মানুষের চাহিদার প্রতি সময়োচিত সংবেদনশীলতা দেখিয়ে সে পথেই এগোচ্ছে। গত বছরের আগস্টে 'সার্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল ২০২২' মহান জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটির পর্যালোচনাসাপেক্ষে এই বিলটি এখন আইনে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে সামাজিক সুরক্ষার এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ধারাবাহিক টানা তিন মেয়াদের সরকারের নিঃসন্দেহে এটি বড় সাফল্য। সামাজিক সুরক্ষার ব্যাপারে সরকারের পরিকল্পনা কত দূরদর্শী এরও সাক্ষ্য বহন করছে সর্বজনীন পেনশন স্কীম।
আগেই যেমনটি বলেছি-অন্তর্ভুক্তিমূলক অগ্রযাত্রার ধারাবাহিকতার কল্যাণে আমাদের জনবলের বড় অংশটিই এখন কাজে নিয়োজিত আছে এবং দারিদ্র্য পরিস্থিতিরও নাটকীয় উন্নতি হয়েছে। এর ফলে অন্য অনেক সূচকে উন্নতির পাশাপাশি এ দেশের নাগরিকদের গড় আয়ু এখন ৭৩ বছর। তবে হালের মূল্যস্ফীতির কারণে এই অর্জন খানিকটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বললে ভুল হবে না। বর্তমানে দেশে ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সি নাগরিক মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি। কর্মক্ষম এই নাগরিকরা দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে এক সময় প্রবীণ হবেন। জনমিতিক হিসাব বলছে, ২০৩১ সাল নাগাদ ৬০-এর বেশি বয়সি নাগরিকের সংখ্যা হবে ২ কোটিরও বেশি। ফলে এই নাগরিকদের প্রবীণ বয়সের সুরক্ষা নিশ্চিত করার রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ থাকা রাষ্ট্রের দায়িত্ব।
অন্যদিকে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, আমাদের মাথাপিছু আয়ও বাড়ন্ত। আয় বৈষম্য তো রয়েছেই। তবুও ধারণা করা যায়, কর্মক্ষম নাগরিকদের একটি বৃহত্তর অংশেরই এখন থেকে শেষ বয়সের জন্য কিছুটা বিনিয়োগ করে রাখার সামর্থ্য রয়েছে। অথচ আনুষ্ঠানিক পেনশন সুবিধা আর সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় বয়স্ক ভাতা পাচ্ছেন নাগরিকদের একটি তুলনামূলক ছোট অংশ। এই প্রেক্ষাপটে নাগরিকদের নিজেদের নিয়মিত চাঁদা এবং আনুষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে সেই সঞ্চিত চাঁদা বিনিয়োগ করে তার লভ্যাংশের মাধ্যমে সব প্রবীণের জন্য একটি পেনশন স্কিম চালু করা এখন সময়ের দাবি।
বিদ্যমান বাস্তবতার আলোকেই আইনটি প্রণীত হয়েছে। যেমন- পেনশনাররা যেন সহজে পেনশনের টাকা মাসিক ভিত্তিতে তুলতে পারেন সে জন্য ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফারে মাধ্যমে টাকা উত্তোলনের সুযোগ রাখার কথা বলা হয়েছে। আশা করা যায়, এই কর্তৃপক্ষ টাকা জমা নেওয়ার ক্ষেত্রেও ডিজিটাল পদ্ধতি অনুসরণ করবে। ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি এমএফএস এবং এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো বিকল্প পথেও টাকা জমা ও উত্তোলনের সুযোগ রাখা উচিত হবে বলে মনে করি। পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারী নাগরিকরা মাসে মাসে পেনশনের জন্য যে চাঁদা দেবেন, সেটিকে বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচনা করে কর রেয়াত দেওয়ার প্রস্তাবনাটিও জনচাহিদার প্রতি সংবেদনশীলতা প্রমাণ করে। সর্বোপরি সব নাগরিকের পক্ষে এই স্কিমে একই মাত্রায় নিয়মিতভাবে চাঁদা দেওয়া সম্ভব হবে না। আবার অনেকে হয়তো আকস্মিক কোনো জটিলতার কারণে এই চাঁদা দেওয়ার সক্ষমতা হারাতে পারেন। এ জন্য দুস্থ চাঁদাদাতার চাঁদার একটি অংশ সরকারে তরফ থেকে অনুদান হিসেবে দেওয়ার প্রস্তাবনা রয়েছে।
এ কথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, সর্বজনীন পেনশন স্কিম সময়োচিত হলেও বাংলাদেশে একেবারেই নতুন। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচি বাস্তবায়নে আমাদের অনবদ্য সাফল্যের ট্র্যাক রেকর্ড রয়েছে। সঞ্চিত অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই কাজে দেবে। তবে ওইসব টার্গেটেড কর্মসূচির সঙ্গে এই সর্বজনীন তথা ইউনিভার্সাল কর্মসূচির পার্থক্যের জায়গাগুলোর বিষয়েও সদাসচেতন থাকা চাই। প্রাথমিক পর্যায়েই এই কর্মসূচির বিষয়ে বৃহত্তর জনগণকে আস্থার জায়গায় নিয়ে আসতে হবে। জনপরিসরে পেনশন স্কিমের প্রাসঙ্গিকতা, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে যত বেশি আলোচনা হবে ততই মঙ্গল। আইনটি পাস হয়ে গেছে। এখন এটিকে ঘিরে জন-সংলাপ, গণশুনানি ইত্যাদি আয়োজন করা দরকার।
জন-পরিসরে এই প্রস্তাবিত স্কিম বিষয়ে জন আলাপ হলে এর ওপর জনআস্থাও বাড়বে। সেই আলাপের আলোকে আইনপরবর্তী রেগুলেশনে নতুন ভাবনা যোগ করা সম্ভব হবে। যেমন- সর্বজনীন পেনশন স্কিমে প্রতিষ্ঠানগুলোরও অংশগ্রহণের সুযোগের কথা বলা হলেও সেটার শর্ত ও সুবিধাদি নিয়ে খুব স্পষ্ট করে বলা হয়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য যথাযথ প্রণোদনার ব্যবস্থা করা গেলে তারা বেশি বেশি আগ্রহ দেখাবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে কৃষিঋণ দেওয়া এবং গ্রামাঞ্চলে শাখা খোলার জন্য এমন প্রণোদনা দেওয়ার সুফল পেয়েছি। পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারীদের দেয়া চাঁদা নিরাপদ বিনিয়োগের মাধ্যমে এগুলোর সুফল তাদের পেনশনের মাধ্যমে দেওয়ার কথা বলা আছে। কোন খাতে কত মেয়াদে বিনিয়োগগুলো করা উচিত- এ নিয়েও জন-পরিসরে আলোচনা হওয়াটাও খুবই জরুরি। জনগণের আস্থা অর্জন করতে এর বিকল্প নেই।
লক্ষ্য ও শিক্ষা প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখে গেছেন, একটি জাতি উন্নতির পথে যতই এগিয়ে যাবে সেখানে মানুষেরা তত বেশি মনুষ্যত্বের পুরো গৌরব দাবি করতে পারবে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমের মাধ্যমে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রবীণ নাগরিকদের জন্য আরও বেশি মানবিক একটি জীবন নিশ্চিত করতে পারব। ফলে এই স্কিমটি হতে পারে আমাদের উন্নতির একটি নতুন মাইলফলক। এই কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আরও বেশি নজর দিতে হবে আনুষঙ্গিক অন্যান্য ক্ষেত্রেও।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
বাবু/এ.এস