বুধবার ১৮ জুন ২০২৫ ৪ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ১৮ জুন ২০২৫
ডেঙ্গুতে মৃত্যু আর দেখতে চাই না
প্রদীপ সাহা
প্রকাশ: রবিবার, ২৩ জুলাই, ২০২৩, ৩:২৩ PM

দিন যতই যাচ্ছে, ডেঙ্গু ক্রমেই ভয়াবহ হয়ে উঠছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী মৃত্যুর সংখ্যাও। প্রতিদিন অসংখ্য ডেঙ্গুরোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। আর এভাবে রোগী বাড়তে থাকলে হাসপাতালগুলোতে বিভিন্ন সংকটও দেখা দিবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মনে করে, দেশে এখন জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এটি এখন জাতীয়ভাবে উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ডেঙ্গু জীবাণুবাহী এডিস মশা পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার সক্ষমতা গড়ে তুলেছে। ঢাকা শহরেই ডেঙ্গুর আক্রমণ সবচেয়ে বেশি দেখা যাচ্ছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে বিশেষজ্ঞমহল আশঙ্কা করছেন।

সাধারণত বর্ষা মৌসুমে এবং শহরে বস্তি এলাকায় ডেঙ্গু বেশি দেখা যায়। জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা সৃষ্টি করা যায়নি বলে খারাপ অবস্থা নিয়ে রোগীরা হাসপাতালে আসছে প্রতিনিয়ত। মশা নিধনে সিটি করপোরেশনের যথেষ্ট প্রচেষ্টা কিংবা কার্যকরি উদ্যোগ না থাকায় ডেঙ্গু ক্রমেই ভয়াবহ আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনে মশক নিধনে যে কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও এখন প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞমহল ও চিকিৎসকরা নতুন করে কার্যকর মশকনিধন কীটনাশক আনার কথা বলছেন। বর্তমানে ডেঙ্গুর যে চারটি সেরুটাইপ রয়েছে (ডেন ১ থেকে ৪ পর্যন্ত), সবগুলো সেরুটাইপই এডিস মশা বহন করছে এবং সেরুটাইপ বেশি কার্যকর বলে মানুষ বেশি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে। এর আগে কখনও সবগুলো সেরুটাইপ কার্যকর ছিল না। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মতে, এডিস মশার বৈশিষ্ট্যে আমরা এখন পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছি। আগে এই মশাগুলো শুধু সকাল ও সন্ধ্যায় কামড়াতো। কিন্তু এখন রাতের বেলাও কামড়াচ্ছে। আগে দেখা যেত, এডিস মশা পরিষ্কার পানিতে ডিম ফুটে লার্ভা হতো। কিন্তু এখন নোংরা পানিতেও লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। তাছাড়া আগে এডিস মশা শুধু শহরাঞ্চলে দেখা যেত, এখন গ্রামেও দেখা যায়।

ডেঙ্গুতে জ্বর ছেড়ে গেলেই নিরাপদ ভাবা উচিত নয়। প্রকৃত বিপদ শুরু হয় তখন থেকেই। জ্বর ছাড়ার পর রক্তের প্লাটিলেট কমে যেতে শুরু করে। তাই রক্তের প্লাটিলেট মেপে দেখতে হবে। নির্দিষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পেলে অবশ্যই হাসপাতালে যেতে হবে। বিলম্বিত বর্ষা শুরুর কারণে ডেঙ্গু বাড়ছে, এটা আরও বাড়তে থাকবে। দেশে জ্বরে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। নিজের বা পরিবারের কারো জ্বর হলেই মানুষ চিন্তিত হয়ে পড়ছে। সবার শুধু একটিই প্রশ্ন এটি কোন জ্বর? ডেঙ্গু নাকি করোনা, নাকি মৌসুমি জ্বর? বিশেষ করে শিশুদের জ্বর হলেই বাবা-মা চিন্তিত হয়ে পড়েন। এটি কোন ধরনের জ্বর, তা শনাক্তের জন্য ভিড় করেন বিভিন্ন হাসপাতাল ও রোগ নির্ণয় কেন্দ্রে। অনেকের মধ্যেই এখন ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দেখা গেছে, অনেকের এখন আগের মতো জ্বর হচ্ছে না। রক্তের প্লাটিলেট কমে গেলেও টের পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে মনে হবে সাধারণ জ্বর, সর্দি, কাশি, মাথা ব্যথা, গলা ব্যথা। হঠাৎ করেই রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে, রক্তচাপ কমে যাচ্ছে, কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, রোগী অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেÑ এটি ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।

সাধারণত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর ৮০ শতাংশ উপসর্গবিহীন থাকে অথবা সাধারণ জ্বরের মতো সামান্য উপসর্গ থাকে। ৫ শতাংশ রোগীর রোগ জটিল হতে পারে এবং খুবই কম ক্ষেত্রে এটি প্রাণঘাতী হয়। তাই সচেতন হলে দ্রুতই এ জ্বরের ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। সাধারণত ভাইরাস শরীরে প্রবেশের চার থেকে সাতদিনের মধ্যে ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ দেখা দেয়। প্রথম এক থেকে পাঁচদিন হঠাৎ উচ্চমাত্রার জ্বর (প্রায় ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট), সঙ্গে বমি ভাব, বমি, র‌্যাশ, হাড়ের জোড়ায় গাঁটে ও মাংসপেশীতে প্রবল ব্যথা হয়। বিপজ্জনক লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয় পেট ব্যথা, অনবরত বমি, শরীরে পানি জমা, নাক ও মাড়ি থেকে রক্তপাত, অতিরিক্ত দুর্বলতা, অস্থিরতা, লিভারের স্ফীতি ইত্যাদি। অনেকেই সামান্য জ্বর-কাশি ভেবে ডেঙ্গুকে প্রথমে গুরুত্ব দিতে চায় না। ফলে তারা দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবার আক্রান্ত হচ্ছে। তারা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের মধ্যে পড়ছে।

ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল গত বছর (২০২২ সালে); এ সংখ্যা ছিল ২৮১। ২০২১ সালে সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছিল ১০৫-এ। অর্থাৎ পরপর তিন বছর ডেঙ্গুতে ১০০ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হতে দেখা যাচ্ছে। ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে মারা গিয়েছিল ৭ জন এবং ২০১৯ সালে মারা গিয়েছিল ১৭৯ জন। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাধারণত ডেঙ্গুর মৌসুম চলে আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, গত বছর ডেঙ্গু রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি ছিল অক্টোবর মাসে। এ বছরও সেই সময় বা তার পরেও সবচেয়ে বেশি রোগীর চাপ দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গু প্রতিরোধের প্রধান উপায় হচ্ছে এডিস মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা। এজন্য ফুল শার্ট, ফুল প্যান্ট ও মোজা পরে থাকতে হবে; দিনেও মশারি টানিয়ে ঘুমানো উচিত।

ডেঙ্গু যেভাবে দিন দিন বাড়ছে তাতে মনে হচ্ছে, ডেঙ্গুর মতো শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য একটি রোগ এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিধনে দেশব্যাপী কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশকনিধনে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছে। অভিযানে কোনো বাসাবাড়ি, স্থাপনা কিংবা নির্মাণাধীন ভবনে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হচ্ছে। বর্তমানে অপরিকল্পিত ত্বরিত নগরায়ন, জনঘনত্ব, গ্রাম ও শহরে অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে খারাপ করছে। ডেঙ্গুর চারটি ধরনেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।

মশা কম থাকতেই মশা মারার উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কিন্তু যখন মশা বেড়ে যায় বা মশার যন্ত্রণায় জনসাধারণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, তখন নেওয়া হয় মশা নিয়ন্ত্রণের চটজলদি কর্মসূচি। আমরা আর এমন অকাল মৃত্যু দেখতে চাই না। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর পদক্ষেপ আমাদের আগে থেকেই নিতে হবে। রাষ্ট্র ও বিভিন্ন সংগঠনকে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে আরও জোরালোভাবে। তা নাহলে কত মৃত্যু যে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত