সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের আকাক্সক্ষা নিয়ে মরণপণ লড়াইয়ে অর্জিত স্বাধীনতায় যে সু-উচ্চ ব্যক্তিত্ব উন্মোচিত হয়েছিলো তা ক্রমাগত দূর্বল থেকে দূর্বলতর হচ্ছে। আপন সংগ্রামের প্রতি সুদৃঢ় আস্থা ও অন্যায়কে প্রতিরোধ করার অনমনীয় মনোভাব বাংলাদেশের মানুষের মর্যাদাকে বাড়িয়ে দিয়েছিলো পৃথিবীর সামনে। সে জন্যই ফিদেল কাস্ত্রো বলতে বাধ্য হয়েছিলো আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখেছি। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু ছিলো বাংলাদেশি জনসাধারনের জ¦লজ¦লে ব্যক্তিত্বের মূর্তপ্রতীক। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে জনসাধারণ যে অসাধারণ ত্যাগ, সংযম ও ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়েছে তা দুনিয়াবি ইতিহাসে বিরল। বিদেশি সাহায্যনির্ভও দেশ গড়ে তুলতে নারাজ ছিলেন তাজউদ্দিন আহমেদ। ম্যাকনামারাকে তাজউদ্দিন আহমেদ গরু-দড়ির গল্প শুনিয়ে জাতীর ব্যক্তিত্বকে হিমালয় চূড়ায় শক্ত আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাঙালি লড়তে জানে, গড়তে জানে। ব্যক্তিত্ব ও বিবেচনাবোধকে অন্যের কাছে সমর্পন করে না। সময় পাল্টায় মানুষ উন্নত থেকে আরো উন্নত হয়। অতীত সংগ্রামী ইতিহাসের আলোতে-উত্তাপে নিজেকে বিকশিত করে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে অন্যায়-অবিচার ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের যে পণ করেছিলো সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীনতা অর্জনের পর সে প্রতিজ্ঞা পদদলিত হওয়া শুরু করে। ন্যায়-অন্যায়ের দোলাচালে দুলতে থাকে আমাদের স্বার্বভৌমত্ব। জনতার ক্ষমতার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ক্রমাগত নির্ভর করতে শুরু করে সামরিক জান্তার শক্তির ওপর। অথাৎ জনগন সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রয়োজনে যাদের পাহারায় নিযুক্ত করলো তারাই ক্ষমতা কাঠামোর নিয়ম নীতি ভেঙ্গে ক্ষমতার পালাবদলে ভুমিকা রাখতে শুরু করে। সকল শক্তির উৎস জনগনের হাত থেকে ক্ষমতা বেহাত হতে শুরু করে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেশ নায়ক নির্বাচিত করার অন্যতম উপায় হচ্ছে ভোট। জনগণের ভোটে রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচিত হয়। ক্ষমতা হস্তান্তরের এই প্রক্রিয়া গণতন্ত্রের প্রাণশক্তি। ১৯৭০ সালের পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নির্বাচন করেছে। নির্বাচনে বিপুল ভোটে হেরেছে। তবুও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। যার ফলাফল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বিজয় অর্জন। তখনো বিদেশি শক্তির কাছে কুর্ণিশ করতে হয়নি। কথিত ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের বিরোধিতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জনগণ লড়ে গেছে। স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পরই স্বাধীনতাকে রক্ষা করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। দেশ স্বাধীনের দশ বছরের মাথায় দুই রাষ্ট্রপতি খুন। সামরিক জান্তার পুনঃপুন ক্ষমতা দখলের পরিণতি বিশ^ বেহায়ার হাতে দেশের শাসনভার অধিষ্ঠিত হয়। বিদেশ প্রীতি কিংবা বিদেশিদের কাছে তদবির করে স্বৈরাচার এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার প্রচেষ্টা জনগণের ছিলো না। জনগণ তাদের আত্মমর্যাদা ও উন্নত ব্যক্তিত্ব লুম্পেন দেশগুলোর হাতে বিসর্জন দেয়নি। রক্ষক্ষয়ী লড়াইয়ে শামিল হয়েছে। আট বছর নিরবিচ্ছিন্ন লড়াই করে স্বৈরাচারি শাসনের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ক্ষমতা হস্তান্তর করার বিধান নিশ্চিত করে। এটাই বাংলাদেশের লড়াকু জনতার গর্বিত ব্যক্তিত্ব।
নব্বইয়ের দশক থেকে জনসাধারনের ব্যক্তিত্বকে দুর্বল করার নানা অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। বাঙালির অপ্রতিরোধ্য তারুণ্যের শক্তিকে কলুষিত করতে এগিয়ে এসেছে সাম্রাজ্যবাদী প্রেসক্রিপশন। বেকারত্বের স্বাস্থ্যবান গোডাউন তৈরি করেছে। শিক্ষা ততটুকু অবারিত হয়েছে যতটুকু হলে ‘আপনি বাঁচলে বাপের নাম’-এই রকম মনোভাব গড়ে উঠবে। যুক্তিবাদী মননকে ঠেলে দিয়েছে মৌলবাদী চিন্তার গহ্বরে। ষাটের দশকে যে তারুণ্য ‘তোমার আমার ঠিকানা মক্কা মদিনার; বিপরীতে স্লোগান তুলেছে তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা-মেঘনা-যমুনা। সেই তারুণ্য আজ জীবনের সামনে শুধু অন্ধকার দেখে। নব্বইয়ের পর থেকে যারাই ক্ষমতার সাধ নিয়েছে তারাই জনতার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ক্ষমতায় মসনদ চিরদিনের জন্য পাকাপোক্ত করতে জনগনের শক্তির ওপর নির্ভর করা থেকে বিরত থেকেছে। ক্ষমতায় লাভের উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছেÑ দেশীয় সম্পদ কত বেশি বিদেশিদের কাছে অসম চুক্তিতে তুলে দেওয়া হবে সে দরকষাকষির উপর। ফলে ক্রমাগত জনগনের ক্ষমতাকে খর্ব করে দেশে বিদেশে তদবির করার প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিদেশ থেকে রেফারি এসে টস কওে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন আগামী পাঁচ বছর কারা ক্ষমতায় থাকবে। ২০২৪ সালে জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বিদেশে তদবিরের ঘটনা প্রতিনিয়ত দৃশ্যপটে ভেসে আসে। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য সর্বত্রই বিদেশি শক্তির উপস্থিতি বিদ্যমান। ক্ষমতার মোহে বিদেশিদের কাছে আত্মসমর্পণের ফলে জাতীয় আত্মমর্যাদাবোধ ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। জনগণের পছন্দ-অপছন্দ গৌণ বিষয় হয়ে পড়ছে। এমতবস্থায় রাজনৈতিক সংকট কাটানোর বিকল্প খুঁজছেন অনেকেই। কিন্তু যার ওপরই আস্থা রাখার চেষ্টা করছে তিনিই পিছন থেকে চুরি বসিয়ে দিচ্ছে। দ্বি-দলীয় মেরুকরণের বাহিরে উদারনৈতিক ও বামপন্থার শক্তি জনগণের প্রত্যাশিত প্রয়োজন পূরণে আস্থাশীলভাবে সাড়া দিতে পারছে না। ফলে রাজনীতিতে সংকট ঘণীভুত হচ্ছে। কিন্তু জন-আকাক্সক্ষা পূরণ করার মত রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটছে না। বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ব্যক্তি-গোষ্ঠীর লড়াই বা প্রতিবাদে মানুষের বিপুল সমর্থন দৃশ্যমান। রাজনৈতিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে না ওঠায় জনগণের অধিকার কিংবা আকাক্সক্ষা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
দেশের বর্তমান সংকট উত্তরণে ঘটবে কেমন করে? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছে রাজনৈতিক সংঘঠন, সুশীল সমাজ ও বুদ্ধিজীরীরা। ষাটের দশকের মতো প্রতিশ্রুত রাজনৈতিক শক্তি ও ব্যক্তিকে পাশ কাটিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা যেমন করে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো এখনো তেমন কোন শক্তি উত্থান ঘটবে কিনা সে সংশয় সংকটে সময় অতিবাহিত হচ্ছে। অনেকে মনে করছেন এই নির্বাচনে তদবির ও জোর জবরদস্তি করে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেও জনগণের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ অচিরেই ঘটবে। বিদেশি হস্তক্ষেপকে সাধুবাদ জানানো ব্যক্তি গোষ্ঠী সেনা অভ্যুত্থানকে একমাত্র সমাধানের পথ হিসেবে বিবেচনা করছে। অভিজ্ঞতা বলছে- সেনা অভুত্থান বা বিদেশি শক্তির প্রেসক্রিপশনে ক্ষমতার পালাবদল দেশকে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির দিকে ঠেলে দেয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। জোর-জবরদস্তিমূলক শাসন পৃষ্ঠপোষকতা পায়। জনমনে অস্থিরতা দেখা দেয়। বাংলাদেশের ইতিহাস লড়াই করে স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতাকে ধূলিস্যাৎ করার ইতিহাস। বাংলাদেশের ইতিহাস দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকে মোকবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার ইতিহাস। ফলে ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে জণগন। পুনরায় জাতীয় ব্যক্তিত্বের ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। এখন প্রয়োজন সংকট দেখে নিজেকে ঘুটিয়ে না নিয়ে, সংকট সমাধানে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
লেখক : কলামিস্ট
বাবু/এ.এস