বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পর্যালোচনায় এটি সুস্পষ্ট যে, পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের আচ্ছাদনে কথিত নির্বাচন বা রাষ্ট্র পরিচালনায় নেতৃত্ব নির্ধারণ চরম প্রহসনের অযৌক্তিক এবং পেশি-অর্থ শক্তির অযাচিত-অপাঙক্তেয়-অগ্রহণযোগ্য রূপ পরিগ্রহ করে। পূর্ববাংলাকে সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অদমনীয় নিপীড়ন-নির্যাতন-নিষ্পেষণ-বৈষম্যের পটভূমিতে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় আদর্শের মূলস্তম্ভ তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ-গণতন্ত্র-সমাজতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে একটি গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রবর্তনের দীর্ঘ সংগ্রাম উজ্জীবিত থাকে। বিপুল প্রাণসংহারের বিনিময়ে চূড়ান্ত পর্যায়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে লালসবুজের স্বাধীন মাতৃভূমির স্বাদ গ্রহণ করে আসছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট সভ্যতার নৃশংস হত্যাযজ্ঞে প্রায় সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবরণের পরবর্তী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে হত্যা-ষড়যন্ত্র-কূটচক্র সেনা-স্বৈর শাসকদের অবাঞ্ছিত-অনভিপ্রেত রাষ্ট্রশাসন দেশকে প্রচণ্ড বিপর্যয়ের মুখোমুখি করে। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দেশে ফিরে এসে স্বাধীনতা সংগ্রাম-মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণের পর বিভিন্ন দুরূহ ও দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে দেশ পুনর্র্নিমাণে অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল বিশ্বের মহাসড়কে যাত্রার পথ উন্মুক্ত করেন। এটুকু নির্দ্বিধায় বলা যায়, জাতির জনকের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত দেশ রূপান্তরে তার সার্থক ও সফল নেতৃত্ব আজ বিশ্বনন্দিত।
দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসলামপন্থি ছোটবড় দল ঘিরে নানামুখী অপতৎপরতায় জাতি উদ্বিগ্ন-আশঙ্কিত। দলগুলোর মধ্যে দুয়েকটি ছাড়া অন্য দলগুলো নিজস্ব শক্তি অর্জনে সমর্থ না হলেও; অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে নিয়েই তাদের কর্মকাণ্ড অতিশয় পরিলক্ষিত। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর গুরুত্ব নেহায়েত কম নয়। নির্বাচনের আগে বড় দলগুলোও ইসলামপন্থি দলগুলোকে নিজেদের অনুকূলে রাখতে তৎপর হয়ে ওঠে। এমনকি সব সরকারের আমলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু ইসলামপন্থি দলের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে বিপুল আলোচিত-সমালোচিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা, আশির দশকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু হওয়ার পর থেকে বড় দলগুলো সব সময়ই নির্বাচন এলে ধর্মকে ব্যবহার করে মাঠে সুবিধা নেওয়ার চর্চা করে আসছে। ধর্মভিত্তিক দলগুলো ধর্মের ব্যবহারে রাজনীতি করে আর বড় দলগুলো এসব দলকে নিজেদের পক্ষে রেখে সাধারণ মানুষের সমর্থন পাওয়ার জন্য সেই ধর্মকেই নির্বাচনের মাঠে ব্যবহার করে। বাংলাদেশে নির্বাচনে ইসলামি দলগুলোর ভোটের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা পাওয়া না গেলেও এর পরিমাণ খুব কম।
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় দলটি ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকেই তাদের জনসমর্থন কমে যাওয়া, ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধ বিচারের দাবি জোরদারে আদর্শগতভাবে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়া এবং নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়, কোনো স্থানীয়-জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারা, দলীয় ব্যানারে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি দিতে না পারাসহ বিভিন্ন কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অতিসম্প্রতি দলটির রাজধানী ঢাকায় অনুষ্ঠিত সমাবেশ সচেতন মহলসহ অনেকের মনে প্রশ্নের উদ্রেক জন্মিয়েছে। দীর্ঘদিন পরে রাজনীতিতে তাদের প্রকাশ্য অবস্থান নানা জল্পনাকল্পনার দৃশ্যপট নির্মিত হয়েছে। সরকারের সঙ্গে তাদের কোনো সমঝোতা হয়েছে, নাকি বিদেশি চাপের কারণে সরকার তাদের ব্যাপারে নমনীয় হয়েছে কিংবা জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ক্ষমতাসীন দলের কোনো কৌশল কি না তারও চুলচেরা বিশ্লেষণ সমধিক জরুরি।
পৃথিবীর বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা থাকলেও বিজেপি এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলো ছাড়াও কমপক্ষে ৩৭টি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। এর মধ্যে ১০টি সর্বভারতীয় ভিত্তিতে এবং ১০টি আঞ্চলিক দল হিসেবে বিদ্যমান। ইউরোপ-আমেরিকাসহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ধর্মভিত্তিক দলের অস্তিত্ব বিরাজমান। তবে তাদের নিষিদ্ধ করার উদাহরণও রয়েছে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯। তার মধ্যে ধর্মভিত্তিক ইসলামি দল ১০টি। ধর্মীয় বিভিন্ন ইস্যুতে তারা কর্মসূচি পালন করলেও দেশের জাতীয় ইস্যুতে কোনো কর্মসূচি তেমন নজরে আসে না। দলীয় কার্যালয়েও নেতাকর্মীদের আনাগোনা দেখা যায় না। বিবৃতি আর সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে বেশিরভাগ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কার্যক্রম। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা নিয়মিত অংশগ্রহণের বিপরীতে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে এ ১০ দলের অংশগ্রহণ খুবই সীমিত। জাতীয় নির্বাচনে এ দলগুলোর এককভাবে জয়লাভ সুদূরপরাহত হলেও, জোটভুক্ত হয়ে ক্ষমতাবান হয়ে ওঠার দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর এজন্যই নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এ দলগুলোর টানাহেঁচড়া-দরকষাকষি শুরু হয়। স্বাধীনতাপূর্ব বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক দলগুলো দেশের রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে অংশ নিত এবং সত্তরের নির্বাচনেও তাদের অংশগ্রহণ ছিল।
দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয়সহ নানা কারণে তৎকালীন ধর্মীয় দলগুলো এ সংগ্রামের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে তারা রাজনীতি করার অধিকার হারায়। বাহাত্তরের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৮-এ সংগঠনের স্বাধীনতা সম্পর্কে বলা ছিল, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে। তবে শর্ত থাকে যে, কোনো ব্যক্তিরই এমন কোনো সংগঠন গঠন করার-সদস্য হওয়ার কিংবা কোনো কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার অধিকার থাকবে না যদি ওই সংগঠনটি সাম্প্রদায়িক হয় অথবা কোনো ধর্ম বা ধর্মীয় উদ্দেশ্য ভিত্তি করে কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য গঠিত হয়। এর মাধ্যমে সব ইসলামি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৫ সালে ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর তৎকালীন সরকার ১৯৭৮ সালে একটি আদেশের মাধ্যমে অনুচ্ছেদ ৩৮-এর ওই অংশটুকু বাতিল করে দেয়। পরে যা ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনের মধ্য দিয়ে সাংবিধানিক বৈধতা পায়। পঞ্চম সংশোধনের পর ৩৮ অনুচ্ছেদ ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ সাপেক্ষে সমিতি বা সংঘ গঠনের অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকবে’ সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞাটি উঠে যাওয়ায় ইসলামি দলগুলো তাদের কার্যক্রম আবার শুরু করে। ৩১ বছর পর ২০১০ সালে আদালতের রায়ে পঞ্চম সংশোধন বাতিল হলে পুনরায় ধর্মভিত্তিক দলগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। সর্বশেষ ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদে নতুন শর্তাবলি যুক্ত করা হয়; যার মাধ্যমে বাহাত্তরের সংবিধানের মতো স্পষ্টভাবে না বললেও রাষ্ট্রের হাতে ধর্মভিত্তিক দলের রাজনীতি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করার কিংবা পরোক্ষা নিয়ন্ত্রণের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠিত হয়।
দেশে পরিশুদ্ধ রাজনৈতিক সংস্কৃতির মোড়কে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন অনিবার্য। সন্ত্রাসী-জঙ্গি-সহিংসতা-বিরোধ-বিচ্ছেদ এবং গণমানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে বিভ্রান্ত করার কোনো উদ্যোগই গ্রহণযোগ্য নয়। রাজনৈতিক দলগুলো শুধু ভোটের রাজনীতিতে জয়যুক্ত হওয়ার অযৌক্তিক সমীকরণ-আপসকামিতা মৌলবাদ-জঙ্গিবাদকেই অধিকমাত্রায় উৎসাহিত করবে। সামগ্রিক বিবেচনায় চিহ্নিত ধর্মান্ধ-সহিংস-উগ্রবাদী ধর্মভিত্তিক দলগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা পরিপূর্ণভাবে পরিত্যাজ্য হওয়া সমীচীন।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
বাবু/এ.এস