সোমবার ২৩ জুন ২০২৫ ৯ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ২৩ জুন ২০২৫
বিকল্প জ্বালানি মিথানল পরিবেশ ও খরচ বাঁচাবে
শর্মিলী মাহজাবিন
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৫ জুলাই, ২০২৩, ৪:২০ PM

জুলাই মাসের শুরুতে ভারতের আসাম থেকে প্রথম মিথানলের চালান বাংলাদেশে এসে পৌছেছে। আসাম পেট্রোকেমিক্যালস লিমিটেড এক একটি বিশেষায়িত প্ল্যান্টে উৎপাদিত মিথানল আমদানি করেছে বাংলাদেশ। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা দৈনিক ৫০০ টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন আসাম পেট্রোকেমিক্যাল প্ল্যান্ট (এপিএল) থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে মিথানল-বাহী ট্রাকের চালানটির উদ্বোধন করেন। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ভারত থেকে মিথানল আমদানির এটিই সূচনা হলেও, এটি বাংলাদেশের আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাতে বিরাট সম্ভাবনার সঞ্চার করছে।

মিথানল, একটি রংবিহীন তরল জ্বালানি, যা মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা, জৈব বর্জ্য বা কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে উৎপাদিত হয়। এর জ্বালানি বৈশিষ্ট মিথানলের মতোই, তবে উৎপাদন খরচ মিথানলের চেয়ে অনেক কম। প্রচলিতভাবে, কার্বন মনো অক্সাইড এবং কার্বন ডাই অক্সাইডের হাইড্রোজেনেশন এর মাধ্যমে গ্যাসোলিন বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে মিথানল তৈরি করা হয়।

আসাম থেকে বাংলাদেশের মিথানল বানিজ্যের এই শুভ সূচনার প্রশংসা করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, এটি আসাম এবং সমগ্র উত্তর-পূর্বের পেট্রোকেমিক্যাল খাতকে উৎসাহিত করবে। এটি ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশের সাথে বাংলাদেশের সংযোগ বৃদ্ধির নতুন এক উদ্যোগ, যখন ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সাথে বাণিজ্য এবং সংযোগ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ চলমান রয়েছে। এই বছরের মার্চ মাসে, একটি ১৩১.৫৭ কিলোমিটার মৈত্রী পাইপলাইনের উদ্বোধন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে ভারত থেকে ডিজেল আমদানি করা হচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির কারণে যখন বাংলাদেশের ডিজেল আমদানি ব্যহত হচ্ছিলো তখনই এই পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ থেকে ডিজেল আমদানি করতে পারায় তা বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে উল্লেখযোগ্য চাপ কমিয়েছে। বিশ্বব্যাপী যখন তেলের দাম বেড়ে আকাশচুম্বী হয়েছে, তখন ভারত রাশিয়া থেকে ৪০ শতাংশ কম দামে ডিজেল আমদানি করেছে। এতে পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারত থেকে কম দামে ডিজেল আমদানি করতে পেরেছে।

তবে রাশিয়ার কাছ থেকে বিশেষ সুবিধা পাওয়ার আগে ভারত আমদানি করা জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নিয়েছেলো। এই কৌশলের অংশ হিসেবে, ভারত উচ্চ-অ্যাশসমৃদ্ধ কয়লার উপর ভিত্তি করে পাঁচটি মিথানল প্ল্যান্ট, পাঁচটি ডিএমই প্ল্যান্ট এবং একটি প্রাকৃতিক গ্যাস-ভিত্তিক মিথানল উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিল যার উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক ২০ মিলিয়ন টন। কয়লা থেকে মিথানল উৎপাদনের জন্য মূলত কম অ্যামসমৃদ্ধ কয়লার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ভারতে উৎপাদিত কয়লায় অ্যাশ-এর আধিক্য থাকায় তারা সেখানে নিজস্ব প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। প্রাথমিকভাবে, একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে দেশীয় প্রযুক্তিতে প্রথম উচ্চ-ছাইসমৃদ্ধ কয়লাভিত্তিক  মিথানল প্ল্যান্ট চালু করেছে।

ভারতের পরিকল্পনা কমিশন মিথানল অর্থনীতি প্রোগ্রাম চালু করেছে, যার লক্ষ্য জ্বালানি তেল আমদানি বিল হ্রাস করা এবং গ্রিনহাউস নিঃসরণ হ্রাস করা। নীতি আয়োগের মতে, মিথানল অর্থনীতি ভারতের আমদানি খরচ প্রায় ১০ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারে। এরই অংশ হিসেবে তারা আসাম পেট্রোকেমিক্যাল প্ল্যান্টের মিথানল উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ১০০ টন থেকে ৬০০ টনে উন্নীত করেছে। এবছরের এপ্রিল থেকে আসামের নামরুপে অবস্থিত এ প্ল্যান্টটি প্রতিদিন অতিরিক্ত ৫০০ টন মিথানল উৎপাদন করছে, যেখান থেকে বাংলাদেশ মিথানল আমদানি করছে।

ইঞ্জিন-ফুয়েল হিসেবে প্রচলিত জ্বালানি তেলের তুলনায় মিথানল উল্লেখযোগ্য মাত্রায় পরিবেশ দূষণ রোধ করে। মিথানল পুড়লে ৯৯ শতাংশ কম সালফার নির্গত হয়, এবং নাইট্রোজেন নির্গমন ৬০ শতাংশ হ্রাস পায়। অধিকন্তু, এটি ক্ষতিকারক পদার্থ ও কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন যথাক্রমে ৯৫ শতাংশ এবং ২৫ শতাংশ হ্রাস করে।

তবে মিথানল ব্যবহার করার জন্য মিথানল-চালিত বিশেষ ইঞ্জিন প্রয়োজন। ফলে সাধারণ ইঞ্জিনে ব্যবহারের জন্য এটিকে পেট্রল বা ডিজেলের সাথে মিশ্রিত করা হয়। ১৫ শতাংশ মিথানল মিশ্রিত জ্বালানিকে এম১৫ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এম১৫ ব্যবহারের দ্বিমুখী উপকারিতা রয়েছে, কারণ এটি একইসাথে সাশ্রয়ী এবং কম দূষণ ঘটায়। গবেষণায় দেখা গেছে মিথাইল-মিশ্রিত পেট্রোল সাধারণ গ্যাসোলিনের তুলনায় কমপক্ষে ৩৩ শতাংশ কম গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন করে।

উচ্চ কার্বন নিঃসরণ এবং বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে জলবায়ু পরিবর্তন বিশ্বকে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির দিকে উৎসাহিত করছে। টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য বাংলাদেশও একটি ক্লিন-এনার্জি অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। ফলে খরচ এবং কার্বন নিঃসরণ কমাতে মিথানল একটি উৎকৃষ্ট বিকল্প জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে।

বৈশ্বিক মুদ্রাস্ফীতির কারণে বাংলাদেশ বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটের মুখোমুখি, এমতাবস্থায় মিথানল বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য একটি উৎকৃষ্ট সমাধান হতে পারে। কম খরচে অধিক শক্তি প্রদানের ফলে এটি আমদানি খরচ কমিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ কমবে। যেহেতু বাংলাদেশে মিথানল উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল প্রাকৃতিক গ্যাস বা কয়লার পর্যাপ্ত মজুদ নেই, সেক্ষেত্রে বিকল্প এই জ্বালানির আমদানিই আপাতত চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপায়।

সুতরাং মিথানল উৎপাদন সম্ভাবনার কারণে ভারতই আমদানির সবচেয়ে নিকটতম উৎস হতে পারে। ভারতের মিথানল অর্থনীতি বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশও এর সুফল পেতে পারে। বিদ্যমান প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। ভারত যেহেতু পণ্য পরিবহন সহজ ও দ্রুতগতির করার জন্য বাংলাদেশের ভূখণ্ড, নদীপথ ও বন্দর ব্যবহার করে ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্টের সুযোগ পেয়েছে, তাই এই অঞ্চলের সম্ভাবনাগুলো উন্মোচন করা এখন আরো সহজ হয়ে পড়েছে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার ফলে এই অঞ্চলের যে প্রভূত উন্নয়ন, বাংলাদেশেরও তা থেকে লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বর্ধিত সংযোগ, বাণিজ্য এবং জ্বালানি সহযোগিতা বাংলাদেশ এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল উভয়ের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করবে। ফলে বাংলাদেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আসাম থেকে মিথানলের প্রথম চালানটি অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে।

লেখক : গবেষক

বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত