১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বিশ্বের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। কারণ ঐদিন খুব সকালে নৃশংসভাবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকরা। বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে তাঁরা জাতি হিসেবে বিশ্বের মানুষের কাছে আত্মঘাতী চরিত্রই প্রকাশ করেছে। ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট দ্য টাইমস অব লন্ডন এ প্রকাশিত সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সারাজীবন বিশ্ব স্মরণ করবে। কারণ তাঁকে ব্যতীত বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই। একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়, বঙ্গবন্ধুর ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে মনে করছে এবং করবে বাংলাদেশের জনসাধারণ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ঘৃণা জানানোর ভাষাও জানা নেই।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়, কিন্তু বিচারের কার্যক্রম শুরু হয় অনেক বছর পরে। এটাও জাতির জন্য আরেক দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা হয় এবং হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার মাধ্যমে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের গতিশীলতা ফিরে পায় বাঙালি জাতি ও দেশের নাগরিক। নতুন প্রজন্মের একজন নাগরিক হিসেবে আজও বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়, কীভাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করল কিছু দুষ্কৃতকারী। ভাবতে আজও শিউরে উঠি আতঙ্কে। কারণ যে মানুষটি জীবনে ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন, যা তার মোট জীবনের এক-চতুর্থাংশ, যাকে ২০ বার গ্রেপ্তার করা হয় শুধু দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে, যার অসামান্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আর সাহস দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা এনে দেয়, তাকেই নিহত হতে হয় দেশের কিছু পথভ্রষ্ট মানুষের হাতে।
আজ আমরা বিশ্বের ৩৮তম শক্তিশালী অর্থনীতিক দেশ, মানুষ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন আজ আমরা আরও উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে থাকতে পারতাম। তার নেতৃত্বে যে গুণ, দক্ষতা এবং দূরদৃষ্টি ছিল, তা আর কারও মধ্যে নেই। তবে ১৫ আগস্ট ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে বন্ধ করতে পারেনি। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ সফলভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার ঘটনার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মান নেতা উইলি ব্রান্ট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যেকোনো জঘন্য কাজ করতে পারে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম সেই পুরুষ তিনি, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন, যে বন্ধন কোনদিন ছিন্ন হবার নয়। আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, যার তুলনা বিরল। একজন প্রকৃত নেতার যেসব গুণাবলী থাকা প্রয়োজন, তার সব গুণ নিয়েই জন্মেছিলেন ক্ষণজন্মা এই মহাপুরুষ যাঁর রাজনৈতিক জীবন ছিল বহু বর্ণিল, যাঁর কণ্ঠে ছিল জাদু। যিনি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাস।
একাত্তরের পরাজিত শক্তির ঘৃণ্য সর্বনাশা চক্রান্তে একদল ঘাতকের পৈশাচিকতার বলি হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার-পরিজন। রচিত হয় ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়। কিন্তু তাতে তো এমন একজন রাষ্ট্রনায়ককে একটি জাতির হৃদয় থেকে চিরতরে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসেন প্রতিটি বাঙালির উৎসবে, আনন্দ-বেদনায়। আরো বেদনার বিষয় হচ্ছে, রাজনীতির সঙ্গে সামান্যতম সম্পৃক্ততা না থাকা সত্ত্বেও নারী-শিশুরাও সেদিন রেহাই পায়নি ঘৃণ্য কাপুরুষ এই ঘাতকচক্রের হাত থেকে। বিদেশে থাকার জন্য প্রাণে বেঁচে যান কেবল বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। বাংলাদেশের স্থপতির নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচার পেতে বাঙালি জাতিকে ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। পদে পদে খুনিদের দোসর ও মদদদাতাদেও ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজালে আটকে থেকেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাযজ্ঞের বিচার। সকল ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে ২০১০ সালের শুরুতেই ২৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে মানবতার শত্রু নরপিশাচ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। দীর্ঘ ৩৫ বছর পরে হলেও বাঙালি জাতি পিতৃহত্যার কলঙ্ক থেকে মুক্ত হয়। যারা এক সময় নিজেদের বিচারের উর্ধ্বে ভেবেছিল এবং তাদের কেউ কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না বলে দম্ভ করেছিল; এই বিচার ও দণ্ডাদেশ কার্যকর করার ভেতর দিয়ে প্রমাণিত; বাংলার মাটিতে কেউই আইনের উর্ধ্বে নয়।
বাঙালি জাতির জন্য জীবনজয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে কৈশোর, যৌবন ও পৌঢ়ত্বকালকে উৎসর্গ করেছিলেন ইতিহাসের মহিমান্বিত মহাপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁর ঐন্দ্রজালিক নেতৃত্বে এই ভূখণ্ডের মানুষ হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিঁড়ে ছিনিয়ে এনেছিল স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। আমরা পেয়েছিলাম নিজস্ব জাতিরাষ্ট্র, গর্বিত আত্মপরিচয়। মুক্তিযুদ্ধকালীন ৯ মাস কারাগারে বন্দি রেখেও পাকিস্তানি জল্লাদরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাহস দেখাতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল স্বাধীন দেশে কোনো বাঙালি তাঁর নিরাপত্তার জন্য হুমকি হতে পারে না। সেজন্যই বঙ্গবন্ধু বঙ্গভবনের পরিবর্তে থাকতেন তাঁর প্রিয় ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর ধানমন্ডির অপরিসর নিজ বাসভবনেই। বাঙালির স্বাধিকার-স্বাধীনতা আন্দোলনের সূতিকাগার এই বাড়িটি অসম্ভব প্রিয় ছিল বঙ্গবন্ধুর। এখানে থেকেই বঙ্গবন্ধু সর্বশক্তি নিয়ে ব্রতী ছিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে। কিন্তু একাত্তরের পরাজিত শত্রুরা বাঙালির প্রতি বঙ্গবন্ধুর অসীম-গভীর ভালবাসা ও বিশ্বাসকেই সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে। রাতের অন্ধকারে হামলায় চালায় স্বাধীনতার স্থপতির বাসভবনে। কাপুরুষোচিত আক্রমণ চালিয়ে পৈশাচিক পন্থায় ঘাতক দল বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুর ও নির্মমভাবে হত্যা কওে, বাঙালিকে পিছিয়ে দেয় প্রগতি-সমৃদ্ধির অগ্রমিছিল থেকে।
আগস্ট মাস বাংলাদেশ ও বাঙালির গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিন, জাতীয় শোক দিবস। কলঙ্কমুক্ত বাঙালি জাতি আজ গভীর শোক ও শ্রদ্ধায় তাঁর শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করবে। সেদিনের সেই অনির্বাণ সূর্যের প্রখর ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর দৈহিক মৃত্যু ঘটলেও তাঁর আদর্শের মৃত্যু হতে পারে না। মানুষ মরে যায়, আদর্শ মরে না। বঙ্গবন্ধু নিজেও একাধিক বক্তৃতায় এ কথা বলেছিলেন। তাই বঙ্গবন্ধু কোন ব্যক্তিমাত্র নন, অবিনশ্বর এক আদর্শ ও প্রেরণার নাম। আর এই প্রেরণাতেই এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট
বাবু/এ.এস