মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫ ২৪ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫
মিজানের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব গোড়পাড়ার বহু পরিবার
রবিউল ইসলাম, বেনাপোল (যশোর)
প্রকাশ: সোমবার, ১৪ আগস্ট, ২০২৩, ৬:২১ PM
যশোর জেলার নিজামপুর ইউনিয়নের গোড়পাড়া গ্রামের সুদ ব্যবসায়ী (দাদন ব্যবসায়ী) মিজানুর রহমান মিজানের ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে এলাকর সহজ সরল সাধারণ মানুষ। সুদের টাকা সময়মতো পরিশোধ করতে না পারায় অনেকেই বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। কখনো সাদা কাগজে, কখনো অলিখিত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর/টিপসই রেখে টাকা দেয়ার পর নানাভাবে ফাঁদে ফেলার অভিযোগ রয়েছে মিজানুরের বিরুদ্ধে। 

সময় মতো সুদের টাকা পরিশোধ না করতে পারলে কারও কারও জমি রেজিস্ট্রি করে নেয়া হয়। গোড়পাড়া সহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছে। অনেকেই ঋণের টাকা পরিশোধ করতে না পেরে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়িঘর ফেলে রাতের আধাঁরে স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অনেকেই সুদ ব্যবসায়ীদের হুমকীর কারণে থানায় অভিযোগ করারও সাহস পাচ্ছে না। তবে শার্শা উপজেলা নির্বাহী অফিসার নারায়ণ চন্দ্র পাল বলেছেন অভিযোগ পেলে এসব অবৈধ ব্যবসায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।  

অনুসন্ধানে জানা যায়, ব্যবসা টিকিয়ে রাখা ও জীবিকার প্রয়োজনে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেন অভাব অনটনে থাকা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক, দিনমজুর, শিক্ষকসহ সাধারণ মানুষ। এসব মানুষদের কষ্টের আয়ের প্রায় সবটাই চলে যায় সুদি (দাদন) ব্যবসায়ীদের পকেটে। তবে একাধিক সুদি কারবারি বলেন, আমরা কাউকে জোর করে টাকা দিই না। তারা নিজেদের প্রয়োজনে আমাদের কাছে এসে টাকা নেন। সারা দেশের মতো একই নিয়মে আমরাও টাকা আদায় করি।

ক্ষতিগ্রস্তরা বলছেন, বিপদে পড়ে চড়া সুদে নগদ টাকা নিতে বাধ্য হই। এভাবে সারা মাসের ইনকামের অর্ধেক টাকা তাদের পকেটে চলে যায়। দিনরাত পরিশ্রম করেও সংসারের অভাব-অনটন লেগেই থাকে। আবার টাকা দিতে না পারলে সুদের টাকারও সুদ গুণতে হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গোড়পাড়া গ্রামের ইসমাইল ও তার স্ত্রী কহিনুর বেগম মিজানুরের কাছ থেকে ২ কিস্তিতে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তা বেড়ে এখন দেড় লক্ষ টাকার বেশি হওয়ায় সুদের টাকা দিতে না পেরে মিজানের অত্যাচারে বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। 

এ বিষয়ে কহিনুর বেগমের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, প্রথমে আমি মিজানের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা সপ্তাহে হাজারে ২০০শত টাকা হারে সুদের উপর ঋণ নেই। যা ১০ হাজার টাকায় সপ্তাহে সুদ আসে ২ হাজার টাকা। কিছুদিন পর আমার স্বামীর গেনগেনে রোগ হওয়ায়  ৫ সপ্তাহ সুদের টাকা দিতে না পারায় সেই টাকা ২০ হাজার টাকার উপরে চলে যায়। স্বামীকে সুস্থ করতে উপায় না পেয়ে তার কাছ থেকে আরো ৩০ হাজার টাকা সুদের উপরে ঋণ নেই। তখন সর্বমোট ৫০ হাজর টাকায় হাতে পায়ে ধরে মাসে ১০ হাজার ৫০০ শত টাকা সুদ দেওয়ার কথা হয় তার সাথে। কিন্তু কয়েক মাস পর তাও দিতে আমরা অপারগ হয়ে যায়। এসময়ে মিজানুর রহমান মিজান সুদের টাকার জন্য আমাদের উপর নানা ভাবে চাপ দিতে থাকে। 

রাতের আঁধারে এসে আমাকে কুপ্রস্তাব দেয়। যে টাকা শোধ করা কোন বিষয় না আমি কয়জন লোক ঠিক করে দেবো তুই খালি এদের সাথে শুবি বাদ বাকি সব আমি দেখবো। তার এই প্রস্তাবে রাজি না হলে শেষে আমাকে বলে অমুকের বউকে আমার জন্য ঠিক করে দিতে পারলে তোর সব টাকা মাফ করে দেবো। রাতবেরাত তার অত্যাচার সইতে না পেরে আমরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এসেছি। আমরা বাড়ি ফিরতে চাই কিন্তু তার ভয়ে বাড়ি ফিরতে পারছি না।

কহিনুর বেগমের মত এ রকম বহু পরিবার গোড়পাড়ার বিভিন্ন গ্রামে দাদন ব্যবসায়ীর ফাঁদে পড়ে নিঃস্ব হচ্ছে। হারাচ্ছেন ইজ্জত, ভিটেবাড়ি আর সাজানো সংসার। প্রশাসনিক কোন পদক্ষেপ না থাকায় দিনের পর দিন সারা দেশে সুদ কারবারিদের দাপট বৃদ্ধি পেয়েই যাচ্ছে। তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন শিক্ষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, দিনমজুরসহ সাধারণ মানুষ।

তথ্য নিয়ে জানা গেছে, নিজামপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে দাদন ব্যবসা এখন জমজমাট। শিক্ষক, হোটেল, ক্ষুদ্র ব্যবসা, দিনমজুর, ভ্যান ও রিকশা চালকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ সংসার চালাতে গিয়ে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নিচ্ছেন। গোড়পাড়ার অপর এক ভুক্তভোগী রাজমিস্ত্রী হযরত আলী এ রকম অসহায়দের মধ্যে একজন। তিনিও এই সুদকারবারী মিজানের অত্যাচার আর নির্যাতনে টাকা পরিশোধ করতে না পেরে নিজের জমি তার মাধ্যমে লিখে দিতে হয়েছে।

কিছু দিন আগেও কন্দপপুর গ্রামের চা বিক্রেতা আব্দুল্লাহর স্ত্রীকে মিজান সুদের টাকা আদায় করার জন্য আটক করে রেখেছিলো। পরবর্তীতে তার টাকা পরিশোধ করে তার স্ত্রীকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া লেগেছে। মিজানের ভয়ে আব্দুল্লার মত অনেকে মুখ খুলতে নারাজ।

মিজানুর রহমান মিজান সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মিজান গোড়পাড়া মানিকতলার মৃত ওয়াজেদের পুত্র। এক সময় সে নাপিতের কাজ করতো। বর্তমানে সে গোড়পাড়া ১নং ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি হওয়ায় তার এই সকল অন্যায়নের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে ও প্রশাসনের সহায়তা নিতে সাহস পায় না।

স্থানীয়রা বলছেন, দাদন বা সুদ ব্যবসা আইন সম্মত বা বৈধ না হওয়া সত্ত্বেও এই ব্যবসার সাথে জড়িতদের নানা কুট কৌশলের কারণে সমাজে এদের বিরুদ্ধে কেউ ‘টু’ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারে না। কিন্তু দিনে দিনে এর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে মধ্যবিত্ত পরিবার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতিটি গ্রামে সুদের ব্যবসা ভয়াবহ বিষের ন্যায় ছড়িয়ে পরেছে। সুদ ব্যবসায়ীদের এখনই থামানো না গেলে এর ভয়াবহতা আরও বৃদ্ধি পাবে। দাদনের ফাঁদে পড়ে একাধিক ভুক্তভোগী জানান, দাদন ব্যবসায়ীরা টাকা দেওয়ার সময় জমির দলিল, ব্যাংকের ফাঁকা চেক ও সাদা স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর রাখেন। যখন কেউ টাকা ফেরত দিতে না পারে তখন ওই চেক স্ট্যাম্পে ইচ্ছেমত টাকা বসিয়ে পাওনাদারের নিকট দাবি করে। অনেক সুদি ব্যবসায়ী অন্য ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে রাতারাতি কোটিপতি হওয়ার আশায় এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছে। এমনি একজন ব্যাক্তি মিজান যে কিনা একজন নাপিত থেকে সুদের ব্যবসা করে এখন কোটি টাকার মালিক। এ বিষয়ে মিজানুর রহমানকে ফোন দিলে, তিনি কোন কথার উত্তর না দিয়ে ফোনটি কেটে দেন।

এ ব্যাপারে নিজামপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সেলিম রেজা বিপুল বলেন, আমি ব্যাক্তিগতভাবে এসকল সুদ ব্যবসায়িদের ঘৃণা করি। আমার জানামতে এলাকায় সুদি কারবারি মিজানের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হয়েছেন অনেক মানুষ। আমি নিজেও তার সুদের টাকার ঝামেলার ২/৩টা বিচার করেছি। তার সুদের টাকা দিতে না পেরে শাহ আলম বুলির স্ত্রী আত্নহত্যা করেছিলো। তার জমি এখন মিজানের নামে। এলাকায় এরা টাকা ধার দেওয়ার নামে নিরীহ মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে এবং এই সুদ ব্যবসায়ী যে কি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তার কোন হিসাব নেই!

বাবু/জেএম
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত