এবারের জাতীয় শোক দিবসে প্রধানমন্ত্রীর লেখা একটি প্রবন্ধ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে। হিমালয়সম শোককে বুকে চেপে তিনি তাঁর এই লেখাটিতে তুলে ধরেছেন পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট রাতের ঘটনাপ্রবাহ। আমাদের কাছে মনে হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এই লেখাটি পুরো জাতির জন্য অবশ্য পাঠ্য। বাংলাদেশের সৃষ্টির প্রেক্ষাপট, সেদিনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের বর্তমান আর এমনকি আজকের প্রেক্ষাপটেও বাংলাদেশের বর্তমান আর ভবিষ্যৎকে দেখা-বোঝার জন্যই সবার পড়া প্রয়োজন লেখাটি।
আমরা আমাদের বলা আর লেখায়, বুঝে আর না বুঝে বঙ্গবন্ধুকে প্রায়ই হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে সম্বোধন করি। কার্যত বঙ্গবন্ধুকে হাজার বছরের সব বাঙালির মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ দাঁড়ায় তাঁকে খাটো করে দেখা। কারণ, বঙ্গবন্ধুর আজকের যে বাংলাদেশ, বাঙালির স্বাধীন বাসভূমি, বাঙালির লিপিবদ্ধ ইতিহাসে এর আগে এই জাতির কোনো স্বাধীন বাসভূমির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। বঙ্গবন্ধুই হচ্ছেন বাঙালি জাতির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রটির প্রথম স্বাধীন শাসক। শুধু তাই নয়, এই রাষ্ট্রটির কনসেপ্টটিও তাঁরই দেওয়া। এমনকি তিনিই নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন এই রাষ্ট্রটির জাতীয় সঙ্গীত থেকে শুরু করে নামটি পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধু কেন বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রটির স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে তিনি যে রবীন্দ্রসঙ্গীতটি বাছাই করেছিলেন, তার মধ্যেই প্রতিভাত।
কবিগুরু আমাদের জাতীয় সঙ্গীতটি রচনা করেছিলেন বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে। প্রশাসনিক সুবিধার দোহাই দিয়ে ব্রিটিশদের বঙ্গভঙ্গ যে আসলে ছিল বাঙালি জাতিকে ধর্মের ভিত্তিতে দ্বিখ-িত করার কালো চক্রান্ত, তা আজ আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিল বাঙালিয়ানায়। তিনি ছিলেন প্রতি নিশ্বাসে একজন আদ্যন্ত বাঙালি। তিনি নিজেও বলেছেন, তিনি সবার আগে মানুষ, তারপর তিনি বাঙালি আর সব শেষে তার ধর্মীয় পরিচয়। এ কারণেই তিনি বাঙালিদের দ্বিখণ্ডিত করার প্রতিবাদে কবিগুরুর লেখা গানটিকেই বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্রটির জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। আর সেই রাষ্ট্রের নামটি বাছাই করতে গিয়েও তিনি সেখানে জুড়ে দিয়েছিলেন বাংলা। বাংলাদেশ মানেই তো বাঙালি জাতির স্বাধীন স্বদেশ।
বাংলাদেশে যেমন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ^াসী বাঙালি আছে, তেমনি আছে সেই বাঙালিও যারা স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ^াস করে না। এরা আয়নায় সবার আগে নিজেদের চেহারাটা দেখে ধর্মীয় লেবাসে। এরা তারপর পাকিস্তানি। মনুষত্ব নামক কোনো শব্দ এদের অভিধানেই নেই। এরাই পঁচাত্তরে ১৫ আগস্ট সংগঠিত করেছিল। বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল তাই ঘাতকদের সঙ্গে মেজর নূরকে দেখে ভেবেছিলেন ঐ খুনি বোধহয় বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হামলাকারীদের হাত থেকে রক্ষা করতে সেখানে উপস্থিত হয়েছে। কারণ, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি এবং মেজর নূর দুজনই সেনাপ্রধান জেনারেল ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্বপালন করেছিলেন। এই মেজর নূরের গুলিতেই শেখ কামাল শাহাদাতবরণ করেন।
৩২-এর সিঁড়িতে বন্দুক হাতে উদ্ধত মেজর হুদাকে দেখে বঙ্গবন্ধু অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলেন, ‘তুই না রিয়াজের ছেলে’? মেজর হুদার গুলিতেই প্রাণ হারান জাতির পিতা। এবারের জাতীয় শোক দিবসে আওয়ামী লীগ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়েও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ১৫ আগস্ট ঘটনার সঙ্গে এমন বিশ^াসঘাতকরা জড়িত ছিল, তারা নিয়মিত ৩২-এ যাতায়াত করত, যেমনটি তিনি লিখেছেন তাঁর এই লেখাটিতেও। সর্বকালের সর্বনিকৃষ্ট বাঙালি বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক আহমেদও ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহকর্মী আর বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ। পঁচাত্তরের ১৪ আগস্ট তিনি বঙ্গবন্ধুকে হাঁসের মাংস রান্না করে খাইয়েছিলেন।
১৫ আগস্ট রাতে এ সব বিশ্বাসঘাতক যেমন সক্রিয় ছিল, তেমনি নেপথ্যে সক্রিয় কিংবা নিষ্ক্রিয় ছিলেন আরও অনেকেই, যাদের সক্রিয়তা অথবা নিষ্ক্রিয়তায় ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির সফল মঞ্চায়ন সম্ভব হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর এই লেখাটিতেও তেমনি কিছু নাম উঠে এসেছে, যাদের মধ্যে উর্দি পরা আর উর্দি ছাড়া এই দু’ধরনের মানুষেরই নাম আছে। এই যে এই বিপরীত মেরুর বাঙালি, তারা যেমন একাত্তরে ছিল, ছিল একাত্তরের আগে আর পরে পঁচাত্তরেও। তারা আছে আজও এবং এমনটি ভাবার কোনোই কারণ নেই যে, তারা আগামীতে থাকবে না। এটাই বাংলাদেশের ভবিতব্য। এটাই বাংলাদেশের বাস্তবতা।
বঙ্গবন্ধুর স্বপক্ষীয়রা যখনই কিছুটা অসতর্ক হয়েছেন কিংবা ভেবেছেন তারা জিতে গেছেন, তখনই ছোবল মেরেছে তাদের প্রতিপক্ষ শক্তি। দীর্ঘ প্রায় পনেরো বছর টানা ক্ষমতায় থাকার বাস্তবতায় আমরা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম যে, আমাদের আশপাশে ওরা বহাল তবিয়তেই আছে। আর এখন নির্বাচনটাকে সামনে রেখে পানিটা যখন কিছুটা ঘোলা, তখন তারা আবারও ছোবল দিতে উদ্যত। কদিন আগেই দ-িত যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুতে শাহাবাগ এলাকাকে সুবেহ সাদিকে দোজখে পরিণত করে তারা তাদের অস্তিত্ব ভালোভাবেই জানান দিয়েছে। পঁচাত্তরের ১৬ আগস্ট হঠাৎ করে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ আজকের মুজিবাদর্শের বাঙালিদের অদেখা। তারা শুধু শুনেই খালাস।
আর হালের নব্য বিপ্লবীরা পঁচাত্তরের পরে তাদের বিপ্লব আর প্রতিবাদের গপ্প শুনিয়ে হালের টকশোগুলোয় চায়ের কাপে ধোঁয়া তোলেন, তারা এই নতুন আওয়ামী প্রজন্মকে এক অর্থে বিভ্রান্তই করছেন। আমরা ক্রমাগত তাদের মুখে এসব কেচ্ছা শুনতে শুনতে একটা সময় অবচেতন মনে ভাবতে শুরু করেছি যে, পঁচাত্তরের পর অসংখ্য দেশপ্রেমিক প্রতিবাদে প্রকম্পিত হয়েছিল রাজপথ। আদতে যে প্রতিবাদ ছিল ঘরের ভিতরে আর রাজপথে ছিল দালালের লাইন, সেটি তো এবারের জাতীয় শোক দিবসে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যেই স্পষ্ট। তিনি তো স্পষ্ট করেই বলেছেন, সেদিন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে একজন মাত্র সেনাকর্মকর্তা ছাড়া আর কেউই প্রতিরোধ গড়ে তোলা তো দূরে থাক, ৩২-এসে উঁকি দেওয়ারও চেষ্টা করেননি।
আজকের পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শকুনের দৃষ্টি যখন বঙ্গোপসাগরের সুনীল জলরাশির ওপর আর ডাঙ্গায়, যখন সক্রিয় তাদের ‘কেনা গোলামরা’, তখন মুজিবাদর্শের বাঙালিদের আরও বেশি সক্রিয়তা এবং তারচেয়েও বেশি তাদের ঐক্য এখন বড় বেশি প্রয়োজন। কারণ, সামনে কড়া নাড়ছে আরেকটি জাতীয় নির্বাচন আর নেকড়ের পাল পচা মাংসের গন্ধে এখন বিভোর।
লেখক : অধ্যাপক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
বাবু/এ.এস