শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫ ২৭ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ১১ জুলাই ২০২৫
পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দীর্ঘসূত্রতা
মো. সাখাওয়াত হোসেন
প্রকাশ: শুক্রবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ২:৩৬ PM

পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, বিষয়টি নিয়ে আদতে কেউই ভবিষ্যদ্বাণী করেন না কিংবা ভবিষ্যদ্বাণী করলেই সেটি পরবর্তী সময়ে টিকছে না। অর্থাৎ সব সময়ই একটি অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সরকার পরিচালিত হয়েছে এবং পাকিস্তানের জনগণও এ ব্যাপারে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি পার্লামেন্টে নিম্নকক্ষ ভেঙে দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক প্রশাসনের অধীনে সাধারণ নির্বাচনের পথ প্রশস্ত করার পর নতুন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রীর নাম ঘোষণা করেছেন। আইন অনুসারে, পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। তবে দেশটি সাংবিধানিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে থাকায় নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে পাকিস্তানে আগামী দিনগুলোর সম্ভাব্য পরিস্থিতি ও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হবে, এটি একটি আইনগত বাধ্যবাধকতা। কিন্তু বিদায়ী সরকার মেয়াদের শেষ দিনে একটি নতুন আদমশুমারি অনুমোদন করায় নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই নতুন নির্বাচনী সীমানা নির্ধারণ করতে হবে। কমিশনের একজন সাবেক কর্মকর্তার মতে, ২৪১ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশে শত শত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনী আসনের জন্য নতুন সীমানা নির্ধারণে ছয় মাস বা তার চেয়ে বেশি সময় প্রয়োজন হতে পারে। নির্বাচন কমিশনকে ঘোষণা করতে হবে সীমানা পুনর্নির্ধারণ শেষ করতে কত সময় লাগবে। নির্বাচনি এলাকা নিয়ে প্রার্থীরা আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। এসবের ভিত্তিতে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হতে পারে। তাহলে সহজেই অনুমেয় পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচন তিন মাসের মধ্যে শেষ করার কোনোরূপ সুযোগ নেই। তা ছাড়া প্রতিবেশ-পরিবেশের কারণে অন্যান্য সমস্যা পাকিস্তানের সঙ্গে লেগেই রয়েছে।

দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাস দেখলে জানা যায়, পাকিস্তানের রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় পর্দার আড়ালে সেনাবাহিনীর ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। দেশটির ৭৬ বছরের ইতিহাসে সেনাবাহিনী সরাসরি তিন দশকের বেশি শাসন করেছে। দেশটির রাজনীতিতে প্রচণ্ড প্রভাবশালী সেনাবাহিনী। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার যদি সাংবিধানিক মেয়াদ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া দীর্ঘ সময় থাকলে শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে তার নিয়ন্ত্রণ সুসংহত করার সুযোগ দেবে। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে তুলে নিতে পারে, এ ভাবনা কোনোভাবেই অবান্তর নয়। তার মানে দাঁড়ায়, একটি অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার সেনাবাহিনীকে এ ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করে দিচ্ছে।

একটি রাষ্ট্রের স্থিতাবস্থার জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে একটি ঋণ সহযোগিতায় খেলাপি হওয়া এড়ানোর পর অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা পাকিস্তানের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক সংস্কারের ফলে ইতোমধ্যে মুদ্রাস্ফীতি ও সুদের হার বেড়ে গেছে। ইমরান খানের কারাদণ্ড ও রাজনীতিতে নিষেধাজ্ঞার পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তাও আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাকে গ্রেপ্তারের পর বড় কোনো সহিংসতা হয়নি। কিন্তু মে মাসে তাকে গ্রেপ্তারের পর সমর্থকরা তাণ্ডব চালিয়েছিল। ফলে তাকে কারাবন্দি রাখা নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। সাংবিধানিক ইস্যুতে হস্তক্ষেপের ইতিহাস থাকা সক্রিয় সুপ্রিম কোর্ট থাকায় ৯০ দিনের বেশি নির্বাচন বিলম্বিত হলে আইনি প্রশ্নও দেখা দিতে পারে।

অতীতে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো পক্ষপাতদুষ্ট, অযোগ্য, অগণতান্ত্রিক এবং অপ্রয়োজনীয় বলে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সংঘটনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও তারা নির্বাচন সংঘটনের নামে অসাড়তা করে শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করার চেষ্টা করেছে। এর ফলে পরে একাধিকবার তারা সামরিক ও বিচার বিভাগের সম্মুখীন হয়েছে। তা সত্ত্বেও সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের ফলে পাকিস্তানে পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং জাতীয় পরিষদের মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ নিয়ে ভেতর ভেতর তুমুল বাগ্বিতণ্ডার পর অবশেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে সিনেটর আনোয়ারুল কাকারের নাম ঘোষণা করে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের কার্যালয়।

সেনাশাসকের ঘরে জন্ম নেয়া নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সিনেটর আনোয়ারুল কাকারও সেনা শাসকের মনমানসিকতা নিয়ে বেড়ে উঠেছে। পাকিস্তানের অতীত ইতিহাসে সমালোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো নতুন এ তিন মাসের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দীর্ঘসূত্রতা হচ্ছে, এমনটি সহজেই বলা যায়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের দায়িত্ব গ্রহণ করে সেনাশাসিত সরকারে পরিণত হয় এবং নির্দিষ্ট সময় পর নির্বাচন না করে শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেপ্তার করে সাজা দিয়ে রাজনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। বাংলাদেশের সাধারণ জনতা সেনাশাসিত সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটা অনির্বাচিত সরকার পরবর্তী দুই বছর ধরে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল, তা সাধারণত কোনো জান্তা সরকারই করে থাকে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা-কর্মীদের বিভিন্ন হয়রানি করা ও জেল-জরিমানা দেয়া হয়। সেদিনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রভাবক হয়ে থাকতে পারে।

বিএনপিসহ অন্য দলের নেতা-কর্মীরাও খুব ভালোভাবে জানেন যে, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সংঘটনের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালে আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ অন্য সব দলের নেতা-কর্মীদের কতভাবে হয়রানির শিকার ও জেল-জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাংলাদেশে সংবিধানস্বীকৃত নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন আছে। একটি দেশের নির্বাচন ওই দেশের সংবিধানস্বীকৃত নির্বাচন কমিশনের অধীনে হবে, এটাই তো একটা স্বাধীন এবং গণতান্ত্রিক দেশের মূল কথা। সংবিধানস্বীকৃত এমন নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকার পরও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি করা মূলত ওই দেশের সংবিধানকে অমান্য করার সমতুল্য।

দেশের সংবিধানকে অমান্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করে বাংলাদেশকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব কোনোভাবেই সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসাড়তার তিক্ত ইতিহাস তুলে ধরে ইইউর সাবেক কমিশনার ইয়ান ফিজেল বলেছেন, সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে ঘটনাক্রমে তা সেনাবাহিনীর হাতে চলে যায়। ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা থাকলেও তারা নির্বাচনই স্থগিত করে; ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কার্যত দেশ শাসন করে। ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়কের আড়ালে স্বৈরশাসনের দেখা মেলে।

দুই বছরের তত্ত্বাবধায়কের শাসনামলে শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সব নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। ইয়ান ফিজেলের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমন একটি ব্যবস্থা, যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট এ ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য একটি নতুন আইন পাস করা হয়। সে অনুযায়ী বাংলাদেশে বর্তমানে একটি স্বাধীন, শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সংঘটনের লক্ষ্যে। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাংবিধানিক ভিত্তিহীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে পাকিস্তানের মতো সরকারব্যবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নির্ধারিত তিন মাসের মধ্যে পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে দীর্ঘসূত্রতা হবে, প্রকারান্তরে সেনা নিয়ন্ত্রণেই থাকবে পাকিস্তানের নির্বাচনকালীন সরকার। আবার অনেকেও এও বলে থাকেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিয়ে নিতে পারে। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের দিন পাকিস্তানের সরকার নির্বাচনের সীমানা পুননির্ধারণের যে আদমশুমারি অনুমোদন করেছে, তা শেষ করতে বেশ সময় লাগবে। এ ছাড়া পাকিস্তানের রাজনীতিতে এমন কিছু বিষয়াদি যেকোনো সময় উঠে আসতে পারে, যা কখনোই চিন্তা করা যায় না। এমন পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হবে এবং পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে পারে। বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়কের বদৌলতে এমন পরিস্থিতির আবির্ভাব ঘটুক, তা এ দেশের কেউই প্রত্যাশা করে না।

লেখক : চেয়ারম্যান, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত