রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘শিক্ষার মিলন’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বর্তমান যুগের সাধনার সঙ্গেই বর্তমান যুগের শিক্ষার সংগতি হওয়া দরকার।’ এখন প্রশ্ন হল সংগতির কথা বলা হয়েছে তা কি আমরা আমাদের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষাব্যবস্থায় দেখতে পাচ্ছি? তিনি মূলত শিক্ষাব্যবস্থার আধুনিকায়নের কথাই বলেছেন। আধুনিকায়নের ক্ষেত্রে যে বিষয়টি সবচেয়ে প্রয়োজন, তা হল বিনিয়োগ। কিন্তু বাস্তবতার আলোকে সেই বিনিয়োগই আজ অধরা। এই বিনিয়োগকে কেবলই আমরা অর্থের দৃষ্টিতে দেখছি না। তবে হ্যাঁ অসংগতির সবচেয়ে বড় যে জায়গাটি সেটি হলো আর্থিক অসংগতি। তা নিয়েই আজ কিছু একটু বলার প্রয়াস। সম্প্রতি মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির ব্যানারে টানা ২৩ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তালা ঝুলিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করেন মাধ্যমিকের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। দাবি পূরণে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শিক্ষকদের পূর্ণ আস্থা রয়েছে।
পরবর্তী সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সাথে বৈঠকে বসে শিক্ষক নেতারা। বৈঠকে শিক্ষকদের জাতীকরণের আশ্বাসে অনশন স্থগিত করে ক্লাসে ফেরার ঘোষণা দেন বাংলাদেশ টিচার্স অ্যাসোসিয়েমনের (বিটিএ) নেতারা। আন্দোলন বা আলোচনা সফল কিনা ব্যর্থ তা সময়ই বলে দিবে। আপাতত একটা জায়গায় তৈরি হয়েছে এটা বলা যায়। কোনো দাবি আদায় তো আর একদিনে সম্ভব হয়নি। এবারের আন্দোলনের সময় এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের যেভাবে সমালোচনা করা হয়েছে সেটা আসলেই ঠিক নয়। বিশেষ করে এনটিআরসিএ কর্তৃক পরীক্ষা নেয়ার পর থেকে শিক্ষক নিয়োগে মানের পরিবর্তন হয়েছে। সরকারি পর্যায়ে যেভাবে নিয়োগ প্রদান করা হচ্ছে তার চেয়ে বরং আরো স্বচ্ছ এবং ভালোভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে ভালোভাবে কেবল নিয়োগ পরীক্ষা নিলেই হবে না। ভালো শিক্ষার্থীরা যেন এ নিয়োগ পরীক্ষায় আগ্রহ দেখায় সে ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সরকারকেই উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রথম পছন্দ থাকে শহর এলাকায় প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দিকে; কারণ শহরের প্রতিষ্ঠানে আর্থিক-সুযোগ সুবিধা গ্রামের চেয়ে অনেক বেশি। শহরের প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীরদের কাছ থেকে বেশি পরিমাণে অর্থ আদায় করতে পারে যার প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেশি সুবিধা ভোগ করতে পারে। এমনকি গ্রামের চেয়ে শহরের শিক্ষকরা অতিরিক্ত প্রাইভেট পড়িয়ে রোজগারের পথকে সুগম করে থাকে। তাই প্রতিনিয়নই শহর ও গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তৈরি হচ্ছে ব্যাপক ফারাক। বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একজন শিক্ষক যোগদানের সময় জাতীয় বেতন স্কেলের ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫শ টাকা বেতন, ১ হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া, ৫শ টাকা চিকিৎসা ভাতা এবং ২৫ শতাংশ উৎসব বোনাস পেয়ে থাকে। এছাড়া ২০ শতাংশ বৈশাখী ভাতা সাথে যুক্ত হয়েছে। এখান থেকে আবার কর্তন করা দুটি ফান্ডে ১০ শতাংশ।
অন্যদিকে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সরকারের অন্যান্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতো সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকে যদিও তাদের কার্যক্রম একই। সবকিছু একরকম থাকার পরও সরকারের পক্ষ থেকে বিমাতাসূলভ আচরণ সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মাঝে বিভেদ তৈরি করছে। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি থাকতে পারে, তবে একটু চিন্তা করলে দেখা যায়Ñ এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা যে বেতন পান তা বর্তমান যুগে মানানসই বলে মনে হবে না।
বর্তমান সরকারের স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারি সমাজ হচ্ছে শিক্ষক। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষককে এক্ষেত্রে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করতে হবে। শুধু মুখে মুখে স্মার্ট শব্দ বলে বেড়ালেই চলবে না। কার্যকারি পদক্ষেপ নিতে হলে শিক্ষকদের দিকে তাকাতে হবে। শুধুমাত্র আর্থিক দিকে নজর দিলেই চলবে না। শিক্ষকদের আগে স্মার্ট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের দাবি একই পাঠ্যক্রমে সকল শিক্ষকই অন্তর্ভুক্ত থাকলেও বেতনের ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্য তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ থেকে বেরিয়ে না আসলে শিক্ষকরা তাদের সবটুকু উজাড় করে দিতে পারবে না। তাদের এ কথাটি একটু ভাবলেই সত্যতা পাওয়া যায়।
একটি জাতিকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে যেতে হলে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হয় শিক্ষায়। কিন্তু আমরা তা পারছি না; যার ফলে মেধাবীদের এ পেশায় আনার সুযোগ তৈরি হচ্ছে না। যার ফলে মেধাবীদের দিন দিন অন্যান্য পেশায় চলে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ যদি আমরা দেখি, কোনো ক্লাসে গিয়ে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় তোমরা কে কে শিক্ষক হতে চাও তখন কারো হাত উঠে না। দেশের ক্যাডার সার্ভিস পরীক্ষায়ও আমরা দেখে থাকি মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে পছন্দ না দেওয়া। সত্যিকার অর্থে স্বাধীন জাতি হিসেবে এটা আমাদের জন্য লজ্জাকর। বিভিন্ন সংবাদে চোখ রাখলেই দেখা যায় কি পরিমাণে মেধা পাচার হচ্ছে আমাদের দেশ থেকে। এর প্রকৃত কারণ আমরা মেধাকে লালন করতে পারছি না। আমাদের বাজেটে যে পরিমাণে বরাদ্ধ রাখা হয় তা দিয়ে মেধাবী জাতি গঠন করা কঠিন। তাই দেশের ভাগ্যোন্নয়নে ও জনশক্তিকে স্মার্ট জনশক্তিতে রুপান্তরিত করার জন্য শিক্ষায় বরাদ্ধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। এই বরাদ্ধের মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বরাদ্ধ বৃদ্ধি করে সরকারি ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মাঝে সমতা বৃদ্ধি করা জরুরি। আজকে যারা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে তারাও কিন্তু লেখাপড়া করেই আসছেন এবং বেশির ভাগই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কাছ থেকে কিন্তু তারা সেসব মনে রাখেনি। শিক্ষাব্যবস্থাকে সুন্দর করার দায়িত্ব আমাদের সবার। প্রতিটি শিক্ষকের অবসরের সুবিধাটুকু পেতে পেতে চলে যেতে হচ্ছে পরপারে। চাকরি শেষে আর্থিক প্রয়োজনীয়তা বেশি থাকে, সে সময় তাদের প্রাপ্য টাকাটা সঠিক সময়ে তাদের হাতে তুলে দেওয়া যাচ্ছে না। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
বাবু/এ.এস