চট্টগ্রাম নগরীতে দিন দিন বাড়ছে মোটর সাইকেলের সংখ্যা। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার। বেড়েছে হতাহতের সংখ্যা। চট্টগ্রামে নারী বাইক চালকের সংখ্যা খুব একটা বেশি না হলেও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নারী মৃত্যুর সংখ্যা কিন্তু কম নয়। পরিসংখ্যান বলছে চট্টগ্রামে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত নারীদের প্রায় সকলেই আরোহী ছিলেন। সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম নগরীর আখতারুজ্জামান ফ্লাইওভারে ট্রাকের ধাক্কায় মর্মান্তিক ভাবে নিহত হয়েছেন মোটরসাইকেল আরোহী দুই তরুণ-তরুণী। বিগত কয়েকদিন চট্টগ্রাম নগরীর সড়কে চলাচলকারী মোটরসাইকেল পর্যবেক্ষণকালে দেখা গেছে ঝুঁকিপূর্ণ চিত্র।
মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী উভয়ের মাথায় হেলমেট পড়া বাধ্যতামূলক হলেও চট্টগ্রাম নগরীর প্রায় সব মোটরসাইকেলের পেছনের সিটে বসা নারী আরোহীদের মাথায় হেলমেট পরিধান করতে দেখা যায়নি। এমনিতেই বাংলাদেশে নারীরা পোশাকের কারণে মোটরসাইকেলের পেছনে একপাশ হয়ে বসে যাতায়াত করেন। গত দুইদিন অন্তত কয়েক শতাধিক বাইকের পিছনে বসা আরোহী নারীদের পাশে ও কোলে শিশুদের বহন করতে দেখা গেছে। কয়েকজন নারীকে বাইকের পেছনে বসে মালামাল নিয়েও চলাচলের দেখা মিলেছে। সিআরবি এলাকায় এমন এক বাইক আরোহী নারীকে শিশু ও মালামাল নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে চলাচলের বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি মুচকি হেসে বললেন, “এটা তো প্লাস্টিকে ওয়াস বাস্কেট। শুক্রবার ছুটির দিন বাচ্চাকে নিয়ে একটু বেড়াতে বের হয়েছি পথে কিছু কেনাকাটা করে এখন বাড়ি ফিরছি। এই টুকুতে আল্লাহর রহমতে কিছু হবে না।” চালকের আসনে থাকা স্বামীর মাথায় হেলমেট থাকলেও সাথে থাকা স্ত্রী ও সন্তানের মাথায় কোন হেলমেট ছিল না। এই বিষয়ে স্বামীকে প্রশ্ন করলে তিনি বাইকের পেছনে বেঁধে রাখা প্লাস্টিকের একটি হেলমেট দেখিয়ে বলেন, “হেলমেট তো আছে উনি মাথায় ওড়না দেয় তো তাই হেলমেট পড়ে না।”
বাংলাদেশে চলাচলকারী বাইকগুলো দুইজনের বেশি বহনের উপযোগী নয়। আইনেও চালকের পিছনে একজনের অধিক আরোহী বহন দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বলা আছে। নগরিতে সরেজমিন ঘুরে বেশকিছু নারীদের বাইকের পেছনে থাকা হ্যান্ডেলের ওপর বসতে দেখা গেছে। বাইকে চালকের পিছনে আরো দুইজন বসতে গেলে পিছনের যাত্রীকে এই হ্যান্ডেলের ওপর বসা ছাড়া আর কোন উপায় থাকেনা। এক্ষেত্রে নারী যাত্রীরা যখন এসব ছোট্ট হ্যান্ডেলের ওপর একপাশ হয়ে বসেন তখন তা আরো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। এছাড়া বাইকের পেছনে বসা বেশ কিছু নারী যাত্রীর ওড়না বাইকের চাকার কাছে ঝুলে থাকতেও দেখা গেছে। বাইকের চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে বাইক দুর্ঘটনার পাশাপাশি নারী যাত্রীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনা ঘটে থাকে।
সরেজমিন পর্যবেক্ষণে বেশির ভাগ বাইকের পেছনের যাত্রীর জন্য কনস্ট্রাকশন সাইটে ব্যবহৃত এক শ্রেণীর হেলমেট দেখা যায়, যা কোন ভাবেই বাইকে ব্যবহারের উপযোগী নয়। বাইক দুর্ঘটনার আঘাত থেকে এসব হেলমেট রক্ষা করবে তো দূরের কথা উলটো আঘাতের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় বলে স্বীকার করলেন আগ্রাবাদের এক হেলমেট বিক্রেতা। বাইকার বিশেষ করে যারা রাইড শেয়ার করেন তারা কমদামের হেলমেট খুঁজে তাই আমাদেরও এসব রাখতে হয়। ইতিমধ্যে এসব হেলমেটের মান যাচাই করতে বিএসটিআই অভিযান পরিচালনা করছে। তবে আইন জরিমানা যাই করুক বাইকার ও বাইকের আরোহীরা যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেরা সচেতন না হবে ততদিন কোন ভাবেই দুর্ঘটনার ঝুঁকি দূর হবেনা বলে মনে করছেন নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চট্টগ্রাম নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক শফিক আহমেদ সাজীব।
সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে, ২০১০ সালে দেশি নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ছিল সাড়ে সাত লাখের মতো। এরপর ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে লাখখানেক মোটরসাইকেল যুক্ত হয়। কিন্তু ২০১৫ সাল থেকে মোটরসাইকেলের নিবন্ধন উচ্চ হারে বাড়তে থাকে। গত বছর পাঁচ লাখের বেশি নতুন মোটরসাইকেলের নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে দেশে নিবন্ধিত যানবাহনের সংখ্যা ৫৫ লাখের মতো। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪০ লাখের বেশি।
পরিসংখ্যান বলছে মোটরসাইকেলে মৃত্যুর দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশর অবস্থান এখন শীর্ষে। বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল বেশি চলাচল করে, এমন ১৬টি দেশের (বাংলাদেশসহ) ওপর সড়ক নিরাপত্তাসংক্রান্ত একটি গবেষণা করে বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই)। এতে বলা হয়েছে, প্রতিবছর দেশে প্রতি ১০ হাজার মোটরসাইকেলের বিপরীতে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছেন ২৮ দশমিক ৪ জন। তাঁদের প্রায় ৪০ শতাংশেরই বয়স ২৪ থেকে ৩০ বছর। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর এই হার সারা বিশ্বে সর্বোচ্চ। যদিও মাথাপিছু মোটরসাইকেল ব্যবহারকারীর হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান পেছনের (১৬ দেশের মধ্যে) দিকে।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের হিসেবে গত জুলাই মাসে দেশে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ছিল ৩৬.৭৯ শতাংশ। এসব সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীর ১৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা দেশের মোট দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ৩১.৯৩%। জুলাই মাসে সারা দেশের মোট দুর্ঘটনার ১৫.২৬% ঘটেছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এতে প্রাণহানিও হয়েছে দেশের মোট সংখ্যার ১৪.৬৫% যা সারা দেশের মধ্যে ২য় সর্বোচ্চ।
নগরীর গণপরিবহন ব্যবস্থার অপ্রতুলতার কারণে দিন দিন ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে মোটরসাইকেলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কম জ্বালানি ও দ্রুত যাতায়াতের জন্য মোটরসাইকেলের বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বাইক ব্যবহারকারীরা। মিনহজ নামের একটি বেসরকারি ব্যাকের এক্সিকিউটিভ বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে কর্মস্থলে পৌঁছতে বাইক ব্যবহার করছি। এছাড়া নানান কাজে শহরের অভ্যন্তরে যাতায়াত করতে বাইক ঝুঁকিপূর্ণ হলেও দরকারি। আসলাম হোসেন নামের এক বাইক রাইডান মানহীন হেলমেটের বিষয়ে আক্ষেপের সুরে বলেন, প্রথম প্রথম ভালো দামের হেলমেট রাখতাম। কিন্তু ক’দিন পরপরই চুরি হয়ে যাওয়ায় আর কেনার সাহস করি না। কলেজ পড়ুয়া ইসায়িন বাইক দুর্ঘটনায় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে বলেন, আমি এখন পর্যন্ত দুইবার এক্সিডেন্ট করেছি। দুইবারই সিএনজি চালিত ট্যাক্সি আমাকে লাগিয়ে দিয়েছে। এই তিন ব্যক্তি ঝুঁকি আছে জেনেও নিজ নিজ স্ত্রী, পরিবারের সদস্য ও বান্ধবীকে বাইকের পেছনে বসিয়ে ঘুরতে পছন্দ করেন। তাদের মতে চট্টগ্রাম নগরীতে দিনের বেলা বড় বড় গাড়ি গুলো অবাধ যাতায়াত করে। বড় গাড়িগুলো সড়কে থাকা বাইককে বিপদ জনকভাবে চাপ দেয় বলে বাইকাররা অভিযোগ করলেও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে আমদানি রপ্তানি পণ্য পরিবহণ করা কাভার্ট ট্রাক চালক রমিজ উদ্দিন এই অভিযোগ মানতে নারাজ।
রমিজ উদ্দিনের ভাষ্য, বেশির ভাগ মোটরসাইকেলের চালক পারেনা আকাশে উড়ে চলে যেতে। মোটরসাইকেলগুলো তার আগে পিছে না দেখে হুট করে এসে ঢুকিয়ে দেয়। এখন আমাদের মত বড় লোড গাড়ি তো চাইলেই হুট করে থামিয়ে দিতে পারি না। প্রাইভেটকার চালক হামিদুর রহমান বলেন, পিচ্চি পিচ্চি ছেলেরা একে তো স্প্রিডে বাইক চালায় তার ওপর ম্যাক্সিমাম ট্র্যাফিক আইন মানেই না। ওয়ান বাই, রং সাইড, সিগন্যাল লাইট এসবের তোয়াক্কা করে না। এক ট্র্যাফিক পুলিশ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, মোটরসাইকেলে পুরো পরিবারের ৪/৫ জন নিয়ে চলাচল করতেও আমরা দেখেছি। বিশেষ করে বন্ধের দিনে এসব বেশি হয়। আর ইয়াং ছেলেদের ড্রাইভিং লাইসেন্স কিংবা হেলমেট ছাড়া ধরলে দেখা যায় নানান জায়গা থেকে ছেড়ে দেয়ার সুপারিশ আসা শুরু হয়। সারাদিন গাড়ির ধোঁয়া ও উচ্চ শব্দের ভেতর ডিউটি করে সব বাইকারকে আটকানো সম্ভব হয়ে উঠেনা বলে মন্তব্য জুড়ে দিলেন আরেক ট্রাফিক পুলিশ।
আব্দুল খালেক নামের এক ৬০ ঊর্ধ্ব অভিভাবক বলেন, “আমি আমার ছেলেকে বাইক কিনে দেইনি বলে সে আমার উপর খুব অভিমান করেছে। আমার বড় ভাইয়ের ছেলে এই বাইক এক্সিডেন্টে মারা গেছে। বাইক আমার দৃষ্টিতে দুই চাকার অনিশ্চিত একটি বাহন।” আমেনা বেগম নামের এক গৃহিণী বলেন, “বাইকে মহিলারা কীভাবে যে বসে সেটাই দেখে ভয় লাগে। সাথে আবার তারা বাচ্চাকেও কোলে নিয়ে বসে। এসব মা-বাবার সচেতনতার অভাব।”
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ট্রাফিক উত্তর জোনের উপ-কমিশনার (ডিসি) জয়নুল আবেদীন টিটু বাইকের পেছনে নারী ও শিশুদের এভাবে বহন করাকে ভীষণ বিপদ জনক হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, “মানসম্মত হেলমেট পরিধান না করা সেই সাথে এই দুই চাকার বাহনে শিশুসহ চলাচল করা বেশ বিপদজনক। পুলিশ হেডকোয়ার্টারের নির্দেশনা আছে যে যদি বাইকে মা বাবার সাথে শিশুরা থাকে তাহলে শিশুর সামনে যেন আমরা কঠোর কোন ব্যবস্থা না নেই। এতে করে কোমল মতি শিশুদের ওপর একটি ইনপেক্ট পড়বে। তবুও আমরা যতটুকু সম্ভব এসব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আর এছাড়াও প্রায় প্রতিদিন বাইকের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা, জরিমানা করা হচ্ছে।
শনিবার (২ সেপ্টেম্বর) আমার জোনের ফ্লাইওভারের ওপর অন্তত ১০টি মোটর সাইকেলের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। একটু সময় বাঁচাতে অনেক বাইকার ফ্লাইওভারে উল্টোপথে চলাচল করে। এসব বাইক নিজেতো বিপদে পড়বে সাথে অপর দিক থেকে আসা যানবাহনকেও দুর্ঘটনায় ফেলবে।” সিএমপির ট্রাফিক বিভাগের চৌকস এই উপ-কমিশনার সকল যানবাহন চালক ও আরোহীদের সচেতনতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে সকলের প্রতি আহ্বান জানান।
বাবু/জেএম