রবিবার ২২ জুন ২০২৫ ৮ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবার ২২ জুন ২০২৫
আমাদের শ্রমবাজার যেভাবে বিস্তৃত করা যায়
ড. সায়মা হক বিদিশা
প্রকাশ: রবিবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ২:৪৪ PM

বিদেশে জনশক্তি রফতানির ক্ষেত্রে সরকারিভাবে নতুন করে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক উদ্যোগ, কারণ শ্রমবাজারে যদি দক্ষ জনশক্তি পাঠানো যায়, তাহলে তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা কিছুটা হলেও বাড়বে। গৃহকর্মী হিসেবে নয়, কেয়ার গিভার, সুপারভাইজার হিসেবে যদি পাঠানো যায়, তখন কিন্তু একজন জনশক্তির ভূমিকা ভিন্ন হয়। কিছুটা শিক্ষিত হলে ইংরেজি কিছুটা বলতে পারবে, এটি একটি দিক আর দ্বিতীয় দিক হচ্ছে, নির্দিষ্ট দেশগুলোতেই কেন জনশক্তি পাঠানো হবে, এর বিকল্পও খুঁজতে হবে। যেসব জায়গায় প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূরীকরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি নতুন গন্তব্যে জনশক্তি রফতানিতে কূটনৈতিক প্রয়াস জোরদার করা উচিত। যেমন মরিশাসসহ বেশকিছু দেশে রেডিমেড গার্মেন্টস শ্রমিকের সুযোগ রয়েছে, জাপানসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় কেয়ার গিভাররা কাজ করে সম্মানজনক অর্থ উপার্জন করতে পারে। সেজন্য কূটনৈতিকভাবে বিভিন্ন ধরনের এক্সপ্লোরেশন দরকার আছে।

যাচাই-বাছাই ও খোঁজ নেয়ার পাশাপাশি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন প্রয়োজন। আমাদের দেখার দরকার আছে যে, কোন দেশগুলো আনএক্সপ্লোরড, সে দেশগুলোয় জনশক্তি পাঠাতে হবে। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় কেমন জনশক্তি পাঠানো যায় সেটা চিন্তা করে দেখতে হবে। এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাবতে হবে। প্রশিক্ষণ আবার দুই রকম। একটা হচ্ছে সফট স্কিল, বেসিক স্কিল, আইটি স্কিল, ল্যাংগুয়েজ স্কিল বিশেষ করে ইংরেজি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটিকেট স্কিল। এসব ক্ষেত্রে বিএমইটি বা তাদের সংশ্লিষ্ট যারা তারা কাজ করতে পারে। আর প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে দেখা যায়, যারা প্রশিক্ষণ দেয় তারাই অতটা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নয়। আবার দেখা যায়, প্রশিক্ষণের সময়সীমা খুব স্বল্প সময়ের। এ কম সময়ে আসলে তেমন কিছু শেখানোর সময় হয় না। দ্বিতীয়ত দেখা যায়, সার্টিফিকেশন নেই। প্রশিক্ষণের কারিকুলাম নেই এবং কারিকুলাম দেশী ও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। তাহলে কীভাবে হবে? আর কোন কোন জায়গায় আমাদের সুযোগ আছে? যেমন বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিংয়ের একটা সুযোগ আছে। এ জায়গায় কীভাবে আরো মানুষ আনা যায়? 

কিছুদিন আগে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগ নিয়ে এক জায়গায় কথা বলেছিলাম, হাই স্কিল ওয়ার্কারদের ক্ষেত্রে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সফট স্কিলের জন্য ছোট ছোট কোর্স থাকতে পারে। যেটি ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সংযোগের ক্ষেত্রে কাজে দেবে। মাসিক ভিত্তিতে অথবা প্রতি সপ্তাহের শুক্রবার হতে পারে। ইন্ডাস্ট্রিগুলো বিভিন্ন ধরনের কর্মশালার আয়োজন করতে পারে। সরকার এগুলো ফ্যাসিলিটেট করতে পারে। অ্যালামনাইদের আমরা কীভাবে আনব এটি নিয়ে কাজ করতে হবে। এটা গ্র্যাজুয়েট লেভেলে। আর প্রাইমারি লেভেলে যেটি হতে পারে, আমার কাছে এটা ফান্ডামেন্টাল মনে হয়, প্রাথমিক শিক্ষার যে স্কিলটা সেখানে যদি দুর্বলতা থেকে যায়, তাহলে পরবর্তী সময়ে ওপরে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এ জায়গায় আমাদের কাজ করা খুব জরুরি।

বিদেশে প্রতিবেশী দেশ ভারতের কর্মীরা ভালো করছেন, এক্ষেত্রে ভারতের বিষয়ে বলতে হবে ডিমান্ড ক্রিয়েটস সাপ্লাই (চাহিদাই জোগানের বন্দোবস্ত করে)। ভারতে বেঁচে থাকতে হলেই ইংরেজি জানতে হবে -এ রকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেশটিতে বিভিন্ন জায়গার লোকজন আসে। আপনি যদি ভারতে যান, তাহলে দেখবেন কলকাতার লোক যাচ্ছে মুম্বাইয়ে, মুম্বাইয়ের লোক যাচ্ছে দিল্লিতে, সুতরাং সেখানে আপনার একটা কমন ল্যাংগুয়েজ থাকতে হবে। হিন্দি এখন আর কমন ল্যাংগুয়েজ নেই। তাদের এখন ইংরেজি কমন ল্যাংগুয়েজ হয়ে গেছে। আমাদের তো এ বিষয়টি নেই। কিন্তু ইংরেজির বিষয়টা খুব ব্যয়বহুল কিছু নয়। এখানে যে প্রোপার ইংলিশ জানতে হবে, সেটাও কিন্তু নয়। বেসিক বা কমন কিছু ইংলিশ। বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে বেসিক কিছু সমস্যা হচ্ছে মিসম্যাচ, যে স্কিলের ক্ষেত্রে সফট স্কিলের সমস্যা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সফট স্কিল, আন্তঃব্যক্তিত সম্পর্ক, প্রেজেন্টেশন স্কিল এসবের ক্ষেত্রেও আমাদের অনলাইন ট্রেনিং প্রোগ্রাম হতে পারে। এখন তো জুম ব্যবহার করে খুব সহজেই এমন আয়োজন করা যায়। এ জায়গায় আমাদের যতটা জোর দেয়া দরকার ছিল নারীদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ছেলেদের জন্য কম্পিউটারের কাজ শেখানো, আরো অনেক কিছু করার সুযোগ আছে। আবার দেখা গেল কম্পিউটারে কাজ করতে পারে, কিন্তু যোগাযোগ ঠিকভাবে করতে পারে না, এক্ষেত্রে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ করলে ইংরেজি টাইপে যদি প্রচুর ভুল থাকে, তাহলে তো কাজ পাওয়া যাবে না। সুতরাং, ফান্ডামেন্টাল জায়গাগুলো যতদিন না হবে, এক্ষেত্রে সাইড বাই সাইড কাজ করার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে যেটা বললাম আমাদের সফট স্কিলের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দেয়া দরকার।

অন্যদিকে রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্ষেত্রে দেখা যায় হুন্ডি-হাওলার দৌরাত্ম্য বেড়েছে। হুন্ডি কারবারিরা অনেক টাকা দেয়। আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে তো প্রণোদনা নেই। এক্ষেত্রে যেটা হলো, মোবাইল ব্যাংকিংকে যদি চাঙ্গা করা যায় তাহলে এখান থেকে ট্রানজেকশন করা যাবে। প্রযুক্তির মাধ্যমে এ সিস্টেম তৈরি করতে হবে। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে যে জায়গাগুলোয় অনেক প্রবাসী কাজ করেন, সে জায়গাগুলোয় যদি ব্যাংকিংয়ের ফ্যাসিলিটিজ তৈরি করা যায়, অনেক সময় দেখা যায় প্রবাসীদের ৩ ঘণ্টা সময় নিয়ে আরেক জায়গায় গিয়ে রেমিট্যান্স পাঠাতে হয়। সেটা যেন না হয়, অর্থাৎ যে জায়গায় অনেক প্রবাসী থাকে সে জায়গায় ফ্যাসিলিটিজটা তৈরি করা। অর্থাৎ সেবাটাকে প্রবাসীদের কাছে নিয়ে আসা। তা না হলে দুটো বিষয়—একটি হচ্ছে প্রক্রিয়াগত জটিলতা আরেকটা হচ্ছে আমাদের আর্থিক খাতের সে সুবিধা দুটোর ক্ষেত্রেই আনুষ্ঠানিক খাত বা বৈধ যে চ্যানেল সেটার ক্ষেত্রে কাক্সিক্ষত সুবিধা মিলছে না।

প্রবাসীরা কী চান? তারা সহজে, দ্রুত টাকা পাঠানোর সুবিধাসহ বেশি টাকা পাওয়ার চিন্তা করবে। এক্ষেত্রে অবৈধ চ্যানেলকে কীভাবে নিরুৎসাহিত করা যায়, আর বৈধ চ্যানেলকে কীভাবে আকর্ষণীয় করে তোলা যায় তার জন্য পদক্ষেপ প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পদক্ষেপগুলো খুব বড় না, ছোট ছোট পদক্ষেপ প্রয়োজন। যেমন ট্রেড লাইসেন্স বা ব্যাংক খাতে ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া, ট্যাক্সের ক্ষেত্রে ছাড় দেয়া। এসব ক্ষেত্রে সরকারের বড় ধরনের ক্ষতি হবে তা নয়। আর শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে যদি কৃষিভিত্তিক শিল্পায়নের কথা ভাবা যায়, যেহেতু আমরা রফতানি বহুমুখীকরণের কথা বলছি, তখন কিন্তু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আমাদের পার্টনারশিপ তৈরি হতে পারে। বিভিন্ন ব্যক্তি খাতে বড় বড় প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেমন এক জায়গায় আম বেশি উৎপাদন হয়, কিছু জায়গায় টমেটোর বেশি ফলন হয়, সে জায়গায় যদি পার্টনারশিপ গড়া যায়, সেখানকার উদ্যোক্তা বা গ্রামীণ নারীদের যদি প্রসেসিংয়ের কাজে লাগানো যায়। এ বিষয়গুলো বিভিন্ন জায়গায় ক্ষুদ্র আকারে হচ্ছে। যেমন ঝাঁপি বানানো, যশোর অঞ্চলে তৈরি হওয়া এসব ঝাঁপি নেদারল্যান্ডসে যাচ্ছে। এ জিনিসগুলোর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির যে ধরনের পণ্য রয়েছে, ঘর সাজানো থেকে শুরু করে কাপড়-চোপড়, প্রসাধনসামগ্রী, খাদ্যদ্রব্য এসবের ব্যাপক চাহিদা আছে। এ জায়গাগুলোর ক্ষেত্রে সংযুক্তি তৈরি করতে হবে। কূটনৈতিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরির পাশাপাশি প্রোপার সার্টিফিকেশন দরকার। এটি যদি করা যায়, অনুমোদন যদি নেয়া যায়, লিচু, আম, বিভিন্ন দেশীয় ফল, দেশীয় সবজি এসব বিদেশে প্রচুর বিক্রি হচ্ছে। এ জায়গাগুলোয় প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। 

এসব চাহিদা কেন্দ্র করে আমাদের পরিকল্পনা সাজাতে হবে। এ জায়গাগুলো আরো বিস্তৃত করতে হবে। জোনভিত্তিক চিন্তার দরকার রয়েছে। চিন্তার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। সিলেটের জন্য যে পরিকল্পনা করা হবে, পটুয়াখালী বা সাতক্ষীরার জন্য সে চিন্তা করলে হবে না। এ মানসিক অবস্থার পরিবর্তনের জন্য গণমাধ্যমের বড় ভূমিকা রয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যক্তি খাত, এনজিও কাজ করতে পারে। শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে আমাদের আরো কাজের সুযোগ রয়েছে। সার্বিক দেশীয় শ্রমবাজারের ক্ষেত্রে সবাইকে আনুষ্ঠানিক করে ফেলা এত সহজ না। কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় আনার ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়া, আনুষ্ঠানিকতাকে সহজ করা এবং আনুষ্ঠানিক যদি করা যায়, তাদের কিছু সুবিধা দেয়া এবং পুরো প্রক্রিয়ার মধ্যে ন্যূনতম মজুরির বিষয় আনা। এটিকে আরো বিস্তৃত করা দরকার। সরকার সব কাজ করতে পারবে না, ব্যক্তি খাতকে সংশ্লিষ্ট করতে হবে। বাজেটে বড় বড় শিল্পকে প্রণোদনা দেয়া হয়, এ প্রণোদনাগুলোকে যদি শর্তসাপেক্ষ প্রণোদনা করা যায়, ন্যূনতম মজুরি, ডে-কেয়ারের বিষয়, রেশন থাকতে পারে। বিভিন্ন লেভেলের শ্রমিককে যদি প্রশিক্ষণ না দেয়া হয়, তাহলে প্রণোদনা পাবেন না—এ শর্ত দেয়া যেতে পারে। প্রণোদনা অর্থাৎ ট্যাক্সের অর্থ সরকার ব্যক্তি খাতকে প্রণোদনা হিসেবে দিচ্ছে। এর মানে ব্যক্তি খাত শিল্পায়ন করবে, কর্মসংস্থান তৈরি করবে। এজন্য প্রণোদনা শ্রমঘন এলাকাকে দেয়া দরকার। শ্রমিকের অধিকারের সঙ্গে যদি সংশ্লিষ্ট করা যায়, তাহলে সাধারণ মানুষ প্রণোদনার সুযোগ সরাসরি পাবে। আর দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে বলব দু-তিনটি মেজর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ, বিনিময় হারসহ সার্বিক প্রবৃদ্ধির চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে। আমি বলব না সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছি, তবে সামষ্টিক অর্থনীতির বেশকিছু জায়গায় আমাদের সতর্ক হওয়া দরকার।

লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত