শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫ ১৩ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫
ড. ইউনূসকে নিয়ে কিছু প্রশ্ন
মোনায়েম সরকার
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৩:০০ PM

বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে নিয়ে আবার আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে। তিনি নিজেও সম্ভবত এভাবে বিতর্কে থাকতে পছন্দ করেন। তিনি অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। তবে আমি মনে করি, তিনি চট্টগ্রামের সওদাগর বা ব্যবসায়ী পিতার সন্তান হিসেবে চূড়ান্ত সাফল্য দেখিয়েছেন ‘দারিদ্র্য-বাণিজ্যে’। তিনি দেশের গরিব মানুষদের নিয়ে কাজ করে, অর্থাৎ ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করে খ্যাতি অর্জন করলেও এখন আর গরিবদের নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান বলে মনে হয় না। তিনি এখন যেমন বিভিন্ন দেশের রাজা-রানি, সরকারপ্রধান, রাষ্ট্রপ্রধান, ফার্স্ট লেডির সঙ্গ পছন্দ করেন, তেমনি পছন্দ করেন ধনসম্পদ, প্রাচুর্য। তাঁর আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ভালো। কেউ কেউ বলেছেন, আন্তর্জাতিক এলিটদের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা বেশি। মানুষকে চেনা যায় তাঁর সঙ্গ ও সঙ্গীদের দিয়ে। ড. ইউনূসের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন পর্যায়ের কতজন মানুষের যোগাযোগ আছে? চট্টগ্রামের হাটহাজারীর যে জোবরা গ্রাম থেকে তাঁর উত্থানযাত্রা, সেই গ্রামের সঙ্গেও কি তাঁর আর কোনো যোগাযোগ আছে?

ড. ইউনূস দেশ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে চেয়েছিলেন। দেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। হতদরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমেছে। কিন্তু সেটা কতটা ড. ইউনূসের ক্ষুদ্রঋণের কারণে আর কতটা সরকারের সামগ্রিক অর্থনৈতিক নীতি-কৌশলের কারণে, তা নিয়ে তর্কবিতর্ক করা যেতে পারে। তবে আমার আজকের বিষয় তাঁকে নিয়ে সম্প্রতি যেসব আলোচনা শুরু হয়েছে সেটা।
প্রথমেই উল্লেখ করা যাক আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের একটি বক্তব্য দিয়ে। ওবায়দুল কাদের ৬ সেপ্টেম্বর বলেছেন, ‘সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে অশুভ শক্তি তৎপর। গতবার ড. কামাল হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে তারা নির্বাচনের বিরুদ্ধে নিজেদের অশুভ তাণ্ডব চালিয়েছিল। এবারও তারা ড. ইউনূসকে ইস্যু করে মাঠে নামতে চায়। সেই খেলা অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। ইউনূসকে নিয়ে তারা আবার সেই ওয়ান-ইলেভেনের মতো অস্বাভাবিক সরকারের খেলায় মেতে উঠতে চায়।’

অন্যদিকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘ড. ইউনূসের বিষয়টা ব্যক্তিগত হিংসার কারণে। আরেকটা বিষয়, এই মুহূর্তে এটাকে এত দ্রুত বিচারে নিয়ে আসা, আমাদের প্রধান যে ইস্যু—সরকার পরিবর্তন করতে হবে, তাদের পদত্যাগ করতে হবে—সেটাকে ডাইভারশন করার জন্য এ ধরনের ইস্যু নিয়ে আসা হচ্ছে। এটা এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায়ও প্রাধান্য পাচ্ছে।’

প্রধান দুই দলের দুই নেতার বক্তব্য থেকে এটা স্পষ্ট যে ড. ইউনূসকে নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে। এখন প্রশ্ন হলো, এই রাজনীতিতে ড. ইউনূসের কি কোনো ভূমিকা নেই? এবারের আলোচনার সূত্রপাত একটি বিবৃতিকে কেন্দ্র করে। এই বিবৃতিরও মূল কারিগর ড. ইউনূসই বলে মনে করা হচ্ছে। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলো স্থগিত চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে লেখা ১৬০ জনের একটি খোলাচিঠি গণমাধ্যমে খবর হওয়ায় শুরু হয় পক্ষে-বিপক্ষে বাদ-প্রতিবাদ। ইউনূসের মামলা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশকারী খোলাচিঠিদাতাদের মধ্যে ১০৪ জনই নোবেল বিজয়ী। এর মধ্যে ১৪ জন শান্তিতে, ২৮ জন রসায়নে, ২৯ জন চিকিৎসাশাস্ত্রে, ২২ জন পদার্থবিজ্ঞানে, চারজন সাহিত্যে এবং সাতজন অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী। স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন, পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস-হোর্তা, আয়ারল্যান্ডের সাবেক প্রেসিডেন্ট মেরি রবিনসন, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুনসহ আরও মন্ত্রী, শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী, সামরিক কমান্ডারসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা রয়েছেন।

১৬০ ব্যক্তির স্বাক্ষর সংগ্রহে এবং তাঁদের সবাইকে একটা চিঠির জন্য একত্রীকরণের কাজটি খুব সহজ ছিল বলে মনে হয় না। এমন একটা চিঠি বিশ্বে অবশ্যই রেকর্ড সৃষ্টিকারী। কিন্তু বড় প্রশ্ন জাগে, এর উদ্যোক্তা কে বা কারা? নিশ্চয়ই বিদেশি কেউ বাংলাদেশের বিচারিক ব্যবস্থা এবং মামলা নিয়ে নিজে থেকে এমন একটা বিষয়ে উদ্যোগ নেননি ড. ইউনূসের জন্য।

কোনো লবিস্ট ফার্ম এটা করে থাকতে পারে। সেখানেও প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, ড. ইউনূসের সরাসরি সম্পৃক্ততা না থাকলে এমনটা হওয়া অবশ্যই অস্বাভাবিক। ড. ইউনূসের নোবেল বিজয়ে হিলারির ভূমিকা ছিল মর্মে আমরা আগেও শুনেছি। হিলারির স্বামী বিল ক্লিনটনের ফাউন্ডেশনে ইউনূসের বিরাট অঙ্কের অর্থদানের কথাও আগে শোনা গেছে। কার্যক্ষেত্রে বান কি মুনের সঙ্গেও ইউনূসের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা যায়। হিলারির সঙ্গে বারাক ওবামা এসে যাওয়া খুবই স্বাভাবিক। কেননা, ওবামারই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন হিলারি। আর ড. ইউনূসের পক্ষে অন্যান্য নোবেল বিজয়ীকে একত্র করাও সংগত কারণেই সম্ভব। অতএব, লবিস্ট দিয়েই হোক কিংবা নিজ উদ্যোগেই হোক, ড. ইউনূসই এমন একটা চিঠির সুচারু সম্পাদন করতে সফল হয়েছেন বলা যায়। আগের ৪০ জনের চিঠিরও একই সূত্রে এবং একই ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে বোঝা যায়। ব্যক্তি ইউনূস এতে সায় না দিলে কার এমন দায় পড়েছে বাংলাদেশের বিচারিক বিষয় নিয়ে এভাবে প্রধানমন্ত্রীকে খোলাচিঠি দেওয়ার? যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোভিত্তিক জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান সিজিয়ন পিআর নিউজওয়্যার তাদের ওয়েবসাইটে এ চিঠি প্রকাশ করা থেকেই অনেক কিছু পরিষ্কার হয়।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেগুলো কি সত্যি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তাঁকে হয়রানি করার জন্য? এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. বদিউর রহমানের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন, যত জনই বিবৃতি দেন, তাতে কিছুই হবে না। কারণ রাজস্ব বোর্ড আয়করের মামলা করার আগে সাত-পাঁচ অনেক ভাবে, আইনের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে থাকে। ঘটনার পেছনে সারবস্তু না থাকলে রাজস্ব বোর্ড অবশ্যই এমন একজন বিশ্ববিখ্যাত এবং আমাদের গর্ব নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে মামলা করত না।

আইন নিজস্ব গতিতে চলবে, কোনো বিবৃতিতে মামলার ওপর কোনো প্রভাব পড়বে না। ওই মামলায় ড. ইউনূসকে কর পরিশোধ করতে হয়েছে, তিনি মামলায় জিততে পারেননি, রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে রায় হয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে নির্ধারিত বয়সের বেশি বয়সেও অধিষ্ঠিত থাকা নিয়েও তিনি শেষ পর্যন্ত লড়েছেন এবং শেষতক হেরেছেন।

এখন গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে তাঁকে রাখার পক্ষে যুক্তি দিয়ে কেউ কেউ বলেছেন, ওয়াসার এমডি পদে একজনকে যদি বারবার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, তাহলে ড. ইউনূসের বেলায় বয়স এত গুরুত্বপূর্ণ হলো কেন? এটা কি বিদ্বেষের কারণেই নয়? এই বক্তব্য আসলে কুযুক্তিপূর্ণ। ওয়াসার এমডি আর ড. ইউনূস কি এক মাপের মানুষ? একটি অন্যায় হলে আরও অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে হবে? 

নোবেল বিজয়ীরা একটি স্বাধীন দেশের আদালতের বিচারাধীন বিষয়ে এভাবে বিবৃতি দিয়ে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কতটা ভালো করলেন, সে প্রশ্নও উঠতে পারে। তবে এ রকম বিবৃতিদানের মাধ্যমে সেই সব সম্মানিত নোবেল বিজয়ী নিজেদেরই হেয় করেছেন বলে মনে করা অসমীচীন নয়। তাঁরা বড়জোর ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য একটি সাধারণ আহ্বান জানাতে পারতেন, যার গুরুত্ব এভাবে সরাসরি বিচার বন্ধের আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেওয়ার থেকে অনেক বেশি হতো। কেননা, সে রকম একটি সাধারণ বিবৃতিতে সরকার বেশি সচেতন হতো এবং বিচারটি যাতে শতভাগ নিরপেক্ষ হয়, সেই চেষ্টা করত। এখন তো তাঁরা এভাবে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়ে সরকারের মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁদের বিবৃতিতে সাড়া দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই বিচার বন্ধের উদ্যোগ নেবেন—তেমনটা আশা করা দুরূহ। কেননা, অতীতে এ রকম অনেক ক্ষমতাধর ব্যক্তির সরাসরি টেলিফোনে সাড়া না দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সাজা কার্যকরের দৃষ্টান্ত তো নিকট অতীতেই আছে। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রী আইনগতভাবে কোনো বিচার বন্ধের উদ্যোগ নিতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে বিচার যদি অব্যাহত থাকে এবং আদালতের রায়ে যদি সাজা হয়েই যায়, তখন নোবেল বিজয়ীদের অবস্থানটা কোথায় দাঁড়াবে?

আমার ধারণা, এতজন নোবেল বিজয়ী বিষয়টি পুরোপুরি জেনে এই বিবৃতি দেননি। ড. ইউনূসই তাঁদের প্রভাবিত করেছেন। এখন আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে এসব নোবেল বিজয়ীর কাছে সরাসরি চিঠি দিয়ে আসল বিষয়টি তুলে ধরা, যাতে তাঁরা নিজেদের ভুলটা বুঝতে পারেন।

ড. ইউনূসকে নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন আছে। যেমন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আবুল বারকাতের মনে প্রশ্ন: ড. ইউনূস কেন সাভার স্মৃতিসৌধে যান না; কেন তিনি শহীদ মিনারে যান না; কেন তাঁকে পহেলা বৈশাখ স্পর্শ করে না; কেন তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারণ করেন না; কেন তিনি ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে যান না; কেন তিনি ১৬ ডিসেম্বর এবং ৭ মার্চ ধারণ করেন না; ১৭ আগস্ট ২০০৫-এ জঙ্গিরা যখন সারা দেশে বোমাবাজি করল, কেন তিনি তখন কিছুই বললেন না; ২১ আগস্ট ২০০৪-এ যখন শেখ হাসিনাকে গ্রেনেড মেরে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলো, তখনো তিনি কেন কিছুই বললেন না; কেন তিনি এ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন না (তিনি তো শান্তিতে নোবেল পাওয়া বাঙালি মানুষ)। হতে পারে আমরা আবেগী-অতি আবেগী, আর তিনি.... আমি না, বুঝি না।’

আমারা বাঙালিরা তর্ক করতে পছন্দ করি। ড. ইউনূস পদ্মা সেতু নির্মাণে বিদেশি সাহায্য বন্ধের পক্ষে তদবির করেছিলেন বলে শোনা যায়। কিন্তু তাঁর পক্ষের লোকেরা বলেন, তিনি যে ওই কাজ করেছেন এর কোনো তথ্য-প্রমাণ আছে? এ ক্ষেত্রে পাল্টা প্রশ্ন করা যায়Ñ তিনি যে দেশকে ভালোবাসেন, তার কোনো তথ্য-প্রমাণ কি তাঁর ভক্তরা দিতে পারবেন? এই যে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে বাংলাদেশ হাবুডুবু খাচ্ছে, এর প্রতিকারে ড. ইউনূসের কোনো দৃশ্যমান ভূমিকা দেখা যায় না কেন? 

লেখক : রাজনীতিবিদ ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর

বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত