তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার ধারণাকে ধ্বংস করেছে বিএনপি। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে খালেদা জিয়া এবং তার পুত্র তারেক রহমান যেভাবে তাদের হাতের পুতুল ব্যক্তিত্বহীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে নির্লজ্জভাবে কলুষিত করেন তা আামাদের সকলের জানা। এই সরকারব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে বিএনপি বারবার নানা ধরনের চতুরতা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে বারবার বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিএনপি নেতারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলছেন। অথচ বিএনপিই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে। ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে এবং পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নে বিএনপি বারবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরের বছরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ১৯৯৪ সালে ঢাকার মিরপুর ও মাগুরায় দুটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগসহ সে সময়ের বিরোধী দলগুলো। আন্দোলনের মুখে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিএনপি সরকারের অধীনে একতরফা নির্বাচন হয়। তাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে এসেও বিএনপি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। একপর্যায়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারেরব্যবস্থা করে আবার জাতীয় নির্বাচন দেয়।
তখন সিদ্ধান্ত হয়, সবশেষ অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান। তিনি রাজি না হলে সব দলের মতৈক্যের ভিত্তিতে একজন হবেন এই সরকারের প্রধান। আর আলোচনায় কাউকে পাওয়া না গেলে হবেন রাষ্ট্রপতি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সেই ভোটে জিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ২০০১ সালে। ওই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জিতে বিএনপি-জামায়াত জোট আসে ক্ষমতায়। তবে সেই সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো নিয়ে তৈরি হয় রাজনৈতিক বিরোধ। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা হয় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের। তিনি এককালে বিএনপির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ফলে তাকে মেনে নিতে রাজি ছিল না আওয়ামী লীগ। আন্দোলনের একপর্যায়ে কে এম হাসান জানান তিনি এই পদের জন্য আগ্রহী নন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদে কে আসবেন, এ নিয়ে বিরোধের মীমাংসা না হওয়ার পর বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের ওপর বর্তায় সেই দায়িত্ব।
নামে মাত্র ক্ষমতায় ছিল অথর্ব ইয়াজউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার । আসলে তা ছিল বিএনপির তাবেদার সরকার । বিএনপির এই তাবেদার সরকারকে ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দিয়ে মঈন-ফখরুদ্দীন (ড.ইউনুসের আশীর্বাদ ও সমর্থন নিয়ে) জুটি দেশে সেনা তাবেদার তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতষ্ঠা করেন। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি বিএনপির হাতে ধবংস হওয়ার পর আবার মঈন-ফখরুদ্দিন জোটের হাতে বাধাপ্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি সর্বসময় বিতর্কিত। তাই বলা যায় সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি গণতন্ত্রকামী মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু এই ধর্ষিত ও কলুষিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি পুনঃপ্রবর্তনের দাবিতে বিএনপি আন্দোলনের নামে সন্ত্রাসী কার্যক্রম করে যাচ্ছে। তাদের হয়তো মনের আশা, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটি পুনঃপ্রবর্তিত হলে আবার একজন সাহাবুদ্দিন অথবা ইয়াজুদ্দিন পাবেন এবং আবার ২০০১ ও ২০০৬ সালের খেলা খেলতে পারবেন।
রাজনীতিতে এক নগ্ন হস্তক্ষেপ হল ২০০৭ সালের ১/১১ এর সরকার। এই ১/১১ এর পেছনে বিএনপি জামায়াত জোট সরকার প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। তৎকালীন সংবিধানের ৫৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যে পদ্ধতিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকার কথা ছিল সেটি ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর বিএনপি লঙ্ঘন করে। ওইদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মেয়াদ শেষে দায়িত্ব হস্তান্তর না করে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে প্রধান উপদেষ্টা পদ গ্রহণে প্ররোচিত করেছিলেন। ২৯ অক্টোবর রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদও গ্রহণ করেন। এটি ছিল সরাসরি সংবিধানের লঙ্ঘন। রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহমেদ এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথম থেকেই সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, আন্তর্জাতিক মহলের সমালোচনার মুখে পড়ে। রাস্তায় আন্দোলন ও প্রতিক্রিয়াও ব্যাপকতর হতে থাকে। ডিসেম্বর মাসে সরকারের চারজন উপদেষ্টাও পদত্যাগ করেন। তারপরও রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা ইয়াজউদ্দিন আহমেদ চারদলীয় জোটের অঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হচ্ছিল। সব রাজনৈতিক দলের আন্দোলন, বিরোধিতা ও অংশগ্রহণহীন অবস্থাতেই একতরফা নির্বাচন সম্পন্ন করার প্রস্তুতি চলছিল।
এক-এগারোর সময় বাংলাদেশের সুশীল সমাজ ছিল খুবই তৎপর। তাদের কথাবার্তা, আর্তনাদ, আকুতি বলেই দিচ্ছিল অন্য কোনো উপায়ে তারা ক্ষমতায় আসতে চায়। কিন্তু ভোট করে ক্ষমতায় যাওয়ার সক্ষমতা তাদের ছিল না। তাই একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। এখনো তাদের তৎপরতা ২০০৬-০৭ সালের মতোই। ওয়ান ইলেভেনের কুশীলবরা দেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে নানাবিধ অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। তাদের এই অপচেষ্টা রুখে দিতে শেখ হাসিনা ও তার সরকার বদ্ধপরিকর। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের সংবিধান ও জনগণের অধিকার সুরক্ষিত। তাই সাধারণ মানুষ চায় দেশে শেখ হাসিনার অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। যুক্তরাষ্ট্রসহ এক-এগারোর কুশীলবদের উচিত এক-এগারোর বিরাজনীতিকরণের ভূত মাথা থেকে তাড়িয়ে সংবিধান অনুযায়ী একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের অধীনে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার গঠনের জন্য সহায়তা করা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা যে বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা নয় বরং পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা। তার আরেকটা কারণ ২০০৭ সালে বাংলাদেশে প্রতষ্ঠিত তত্ত্ববধায়ক সরকারের অতীত অভিজ্ঞতা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই শীর্ষ রাজনৈতিক দলগুলোর সব নেতাকে গ্রেফতার করা হয় এবং প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো একটা অনির্বাচিত সরকার পরবর্তী দুই বছর ধওে যেসব কর্মকাণ্ড চালিয়েছিল, তা সাধারণত কোনো জান্তা সরকারই করে থাকে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকর্মীদের বিভিন্ন হয়রানি করা ও জেল-জরিমানা দেওয়া হয়। সেদিনের সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি প্রত্যাখানের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রভাবক হয়ে থাকতে পারে।
আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ইতিহাসের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত জনসমর্থন ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস রেখে পথ চলেছে; যার জন্য জনগণ আওয়ামী লীগকে কখনও বিএনপির মতো ছুড়ে ফেলে দেয়নি। আওয়ামী লীগ ও জননেত্রী শেখ হাসিনার বরাবরের মতো জনগণের উপর বিশ্বাস ছিল এবং আছে এবং থাকবে। আমাদের সকলকে সবসময় অবশ্যই মনে রাখতে হবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কেবলই পাকিস্তানের মতো ব্যর্থ রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা। বাংলাদেশের মতো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের সরকার ব্যবস্থা নয় এবং কখনো হতেও পারে না।
লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাবু/এ.এস