বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ‘শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির দেরি নেই’ এমন কথা উচ্চকণ্ঠে যখন বলছে, তখন টানা ১৬ দিন বিদেশ অবস্থান করে তিনি ঢাকায় ফিরে এলেন নির্বিঘ্নে। তাকে স্বদেশে ফিরতে দেওয়া হবে নাÑ এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘোষণা কেউ দেয়নি। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল কাজে লাগিয়ে প্রবাসে বসে কেউ কেউ উষ্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন কেন শেখ হাসিনাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে দেওয়া হলো? কেন তার ওপর ভিসা স্যাংশন আরোপ করা হলো না?
এটিও আমরা দেখেছি, শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালে বিএনপির সমর্থকরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। গত এপ্রিল-মে মাসে বিশ্বব্যাংকের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালেও বিক্ষোভ হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিএনপির সমর্থকদের উদ্দেশে বলেছেনÑ আপনাদের কথা শুনব, কাছে এসে কেউ বলবেন? এবার তিনি যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সভাপতিকে চায়ের আমন্ত্রণও জানিয়েছেন। তবে কথা বলতে বা চা খেতে বিএনপির কেউ আসেননি। বিক্ষোভকারীদের একটি অংশ উগ্র আচরণ করেছে। শেখ হাসিনার প্রতি অপমানসূচক মন্তব্যও শোনা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে এ বিক্ষোভ প্রদর্শন যারা করেছে, তাদের অনেকে ওই দেশে অনেক বছর বসবাস ও কাজ করছেন। কারও কারও গ্রিন কার্ড রয়েছে বলে ধরে নিতে পারি। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের কাছে এসব কর্মকাণ্ড মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে। এ কারণে বাধা প্রদানের প্রশ্ন আসে না। তবে আমরা প্রশ্ন তুলতে পারিÑ ঢাকায় যদি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কিংবা অন্য কোনো দূতাবাস কর্মীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়, তা হলে সেটিকে কেন আমেরিকার সার্বভৌমত্ব ও প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধির ওপর আঘাত হিসেবে গণ্য করা হবে? কেন এই দ্বিচারিতা?
গতবছর তথা ২০২২ সালের ১০ ডিসেম্বর থেকে বাংলাদেশের শাসনকাজ পরিচালনা হওয়ার কথা খালেদা জিয়ার নির্দেশে। তার পুত্রও লন্ডন থেকে নির্দেশ দেবেন এবং সেটি মেনে চলবে বাংলাদেশ। বিএনপি নেতারা উচ্চকণ্ঠে এসব বলেছিলেন। বাস্তবে সেটি ঘটেনি। পরের প্রায় ১১ মাস বাংলাদেশ এবং গোটা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে, শেখ হাসিনা স্বাভাবিকভাবে দেশ পরিচালনা করছেন। একের পর এক মেগাপ্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হচ্ছে। স্বল্পোন্নত দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে উন্নয়নশীল দেশের সারিতে স্থান করে নিতে দৃঢ়সংকল্পে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সামনে সাধারণ নির্বাচন। গত কয়েক দশকে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ ও অর্থনীতির ওপর নজর রাখছেন এমন অনেকেই একমত যে, অর্থনৈতিক-সামাজিক ও পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এত সাফল্য নিয়ে শেখ হাসিনার মতো আর কোনো নেতা ভোটারদের মুখোমুখি হননি। যারা এতদিন বলেছেÑ কিসের উন্নয়ন, সবই শেখ হাসিনার ফাঁকা বুলি; তারাও ক্ষীণকণ্ঠে বলতে শুরু করেছে, উন্নয়ন হয়েছে বটে তবে ব্যয় বড্ড বেশি হয়ে গেছে। কথায় বলেÑ যাকে দেখতে নারী, তার চরণ বাঁকা!
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগদান শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ফিরেছেন। তিনি টানা ১৬ দিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে ছিলেন। গত ২৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়Ñ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসান এবং এ সংঘাত কেন্দ্র করে আরোপ করা স্যাংশনের অবসান, জরুরি অবস্থা মোকাবিলার জন্য আঞ্চলিক খাদ্য নিরাপত্তা ব্যাংক চালু, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, টেকসই উন্নয়ন, সন্ত্রাসবাদ দমনসহ অনেক বিষয়ে কথা বলেছেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি হয়ে উঠেছেন স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের কণ্ঠস্বর।
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকালে একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমেরিকার স্যাংশনকে অগ্রহণযোগ্য ও অন্যায় বলে আখ্যায়িত করেছেন এবং একই সঙ্গে বলেছেন, আমাদেরও এমন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের অধিকার ও সক্ষমতা রয়েছে এবং সেটি প্রয়োজন বোধ করলে প্রয়োগ করা হবে। তিনি ভয়েস অব আমেরিকাকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানেও তার অবস্থান আমরা দেখেছি মহান দেশের মহান নেতার মতো। তাকে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে, এর কোনো কোনোটি ছিল উসকানিমূলক। কিন্তু তিনি উত্তর দিয়েছেন ধীর-স্থির থেকে। র্যাবের কয়েক কর্মকর্তার ওপর আরোপিত ২০২১ সালের স্যাংশন সম্পর্কে তিনি বলেছেনÑ যাদের দিয়ে জঙ্গিবাদ মোকাবিলা করা হলো, তাদের ওপর কেন স্যাংশন? তা হলে জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেই যুক্তরাষ্ট্র খুশি থাকে? আর এ বাহিনীকে ট্রেনিং তো যুক্তরাষ্ট্রই দিয়েছে। খালেদা জিয়াকে কেন চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে অনুমতি প্রদান করা হবে না, এ ধরনের আদালত সংশ্লিষ্ট বিষয়ও জানতে চাওয়া হয়েছে নির্বাহী বিভাগের প্রধানের কাছে।
এ বছরের ১ মে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ওয়াশিংটনে। সেখানে তিনি বিশ্বব্যাংকের সভাপতিকে ‘পদ্মা নদীর ওপর পদ্মা সেতু’Ñ এমন একটি সুন্দর চিত্রকর্ম উপহার দিয়েছিলেন। অনেকের কাছেই বিষয়টি ছিল টিট ফর ট্যাট। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু চায়নি, অন্যায় ও মিথ্যা অভিযোগ এনে ঋণচুক্তি বাতিল করে দিয়েছিল। নিজেদের অর্থে সেতু নির্মাণ করে তার বদলা বা মধুর প্রতিশোধ নেওয়া হলো। ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে উপহার প্রদানের বিষয়টিকে এভাবে উত্থাপন করা হলে শেখ হাসিনা তাতে সায় না দিয়ে বলেছিলেন, পদ্মা বাংলাদেশের বড় সম্পদ। সেখানে একটি সেতু তৈরি হয়েছেÑ যা দেখতে সুন্দর। আমাদের অনেক শিল্পী রয়েছেন যারা চমৎকার আঁকেন। এ নিয়ে একজন গুণীশিল্পীর একটি কাজ বিশ্বব্যাংকের সভাপতিকে উপহার দেওয়া হয়েছে। তার কথায় রাষ্ট্রনায়ক ও কূটনীতিকসুলভ প্রজ্ঞা আছে সন্দেহ নেই। শিল্পীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনও এভাবে করা হলো।
সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশ পদ্মা সেতু তৈরি করতে পারে। এ সফলতা নিয়ে আঁকা চিত্রকর্ম উপহারও আমরা দিতে পারি। মনে রাখতে হবে, বহু বছর বাংলাদেশ ঝড়-বন্যা-খরায় ত্রাণকাজ পরিচালনার জন্য উন্নত বিশ্বের রিলিফ আসার জন্য অপেক্ষায় থাকত। এখন বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় মডেল হিসেবে গণ্য করছে জাতিসংঘ ও উন্নত বিশ্ব। বহু বছর আমরা এমনকি ছোট সেতু ও সড়কপথ বানানোর জন্যও দাতাদের দ্বারস্থ হয়েছি। এখন বাংলাদেশ নিজের অর্থে, নিজের কারিগরি সক্ষমতায় অনেক বড় কাজ করতে পারে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৮তম অধিবেশনে যোগদানের সময় নানাভাবে তিনি এ নতুন বাংলাদেশকেই তুলে ধরতে পেরেছেন। লন্ডনেও নানা অনুষ্ঠানে তিনি ছিলেন আত্মপ্রত্যয়ী, বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ বিষয়ে নিঃসন্দেহ।
শেখ হাসিনার বয়স ৭৬ বছর পূর্ণ হয়েছে। অনেক বছর ধরে তিনি জন্মদিনের সময়টা কাটান জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচিতে। প্রতিদিন তার থাকে অনেক কর্মসূচি সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেন। পরিশ্রান্ত অবশ্যই হন। কিন্তু মুখায়বে কিংবা কথায় তার প্রতিফলন নেই। তিনি প্রাণচঞ্চল, হাসিখুশি থাকেন এবং অন্যদেরও উজ্জীবিত করতে পারেন। সামনে তার রয়েছে স্মার্ট ও ডেভেলপড বাংলাদেশ গড়ে তোলার সংকল্প। উন্নত বিশ্বের সারিতে বসতে চাইছে বাংলাদেশ এবং সেটি নিজ পরিকল্পনায়। আমরা অনেক ধরনের সক্ষমতাও অর্জন করেছি। এর সফল প্রয়োগের সুযোগ এসেছে। অন্যদের সহায়তা, পরামর্শ অবশ্যই আমরা নেব সানন্দচিত্তে। কিন্তু চলার পথ আমরাই নির্ধারণ করব এবং চলব মাথা উঁচু করে যেমনটি এ ভূখণ্ডের মানুষ করেছে ১৯৭১ সালে।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক