রবিবার ১০ আগস্ট ২০২৫ ২৬ শ্রাবণ ১৪৩২
রবিবার ১০ আগস্ট ২০২৫
যুদ্ধে বিধ্বস্ত বিশ্ব মানবতা
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শুক্রবার, ২০ অক্টোবর, ২০২৩, ৪:২১ PM
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ছাপিয়ে হামাস-ইসরাইল যুদ্ধ এবং গাজা উপত্যকায় ঘটে চলা তীব্র নৃশংসতা বিশ্বের মাথা ব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত কয়েক দশক ধরেই বিশ্ব যেন যুদ্ধ বন্ধ করার চেয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পরাকেই নিয়তি হিসেবে ধরে নিয়েছে। মানুষ এতটাই অমানবিক, প্রতিশোধ পরায়ণ এবং নিষ্ঠুর হতে পেরেছে যে ফিলিস্তিনের একটি হাসপাতালেও বোমার আঘাতে শত শত মানুষ নিহত হয়েছে। সেখানে কিন্তু মৃত মানুষও ছিল। একজন মানুষ আর কতবার মরবে? অতি দ্রুত এখন ইসরাইলের এই নৃশংসতা বন্ধ করা জরুরি এবং বিশ্বকে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। যুদ্ধ বিশ্বের অর্থনীতি এবং রাজনৈতি পরিস্থিতিকে আরও বেশি জটিল করে তুলছে।

যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে স্বল্প আয়ের দেশগুলোর পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে। নতুন সংকটের অর্থাৎ যুদ্ধের সাথে সাথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘদিন অতিবাহিত হয়েছে। আবার ইসরাইলের সাথে হামাসের চলমান সংঘাত আরও তীব্র হতে পারে। কারণ এতে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও দেশ জড়িয়ে পরার সম্ভাবনাও রয়েছে। সেটি হলে পৃথিবী একটি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ দেখার অপেক্ষায় রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে যা ঘটছে না সেটি ঘটছে এই যুদ্ধে। বিপুল সংখ্যক নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে এবং ঘটছে। পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে গাজার হাসপাতালগুলো এখন রীতিমতো কবরস্থানে পরিণত হয়েছে। সেখানে অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বিশ্বনেতারা যখন একটি ঐক্যবদ্ধ বিশ্ব গড়ার ডাক দেন তখন এই অমানবিক পরিস্থিতি তাদের লজ্জায় ফেলে দেওয়ার কথা। দিন যতই গড়াচ্ছে উভয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা, অবকাঠামোগত ক্ষতি, শরণার্থী সমস্যা এবং খাদ্যসংকট তীব্র হচ্ছে। অপরদিকে পশ্চিমা দেশগুলোর অস্ত্র সহায়তায় ইউক্রেন রাশিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র যুদ্ধ করছে। যতদিন অস্ত্র আছে ততদিন এই যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু প্রশ্ন হল যুদ্ধ কেন বন্ধ হচ্ছে না? এখানেও কি কোনো সূক্ষ্ম বৈশি^ক রাজনীতির খেলা! ইচ্ছা করলেই কি যুদ্ধ যুদ্ধ এই খেলা বন্ধ করা সম্ভব যেখানে পৃথিবী অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। অস্ত্র বিক্রি করে মোটা টাকার ব্যবসার প্রশ্ন এবং হাতছানি এখানেও রয়েছে। যার যত অস্ত্র সে তত ধনী এবং লাভবান! এখানে শুধুই লোকসান। জীবন, সম্পদসহ সারা পৃথিবীর ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা তৈরি হয়েছে যুদ্ধকে কেন্দ্র করে। অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ হলেও এই যুদ্ধ পশ্চিমাদের সাথে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেও পরিণত হয়েছে। যেখানে একদিকে রাশিয়া-চীন এবং অন্যদিকে পশ্চিমা বিশ^। আধিপত্য বিস্তারের এই প্রতিযোগিতার সময়ে এই বিভক্ত বিশে^র দিকেই ইঙ্গিত করছে। লাভ যে একেবারেই কারো হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। এই যুদ্ধকালীন সময়েও দেশে দেশে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে। পৃথিবী ভরে যাচ্ছে মিলিয়নারে। আমরা দেখছি দরিদ্রদের চিত্র। বিপরীত চিত্রও কিন্তু আছে। অস্ত্র ব্যবসায় লাভবান হচ্ছে কিছু দেশ। যুদ্ধ মানেই অস্ত্র। আর বিশে^র গুটিকতক দেশ অস্ত্র তৈরি এবং বিক্রি করে সবচেয়ে বেশি। নিজেকে সুরক্ষিত করার প্রশ্নটি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর থেকে আরও বেশি সামনে এসেছে। তাছাড়া অস্ত্র মানেই মোড়লিপনা। বিশ^জুড়েই অস্ত্র ব্যবসা বাড়ছে। গত পাঁচ বছরে অস্ত্রের বাণিজ্য কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে ইউরোপে।

গত বছর সুইডেনভিত্তিক স্টকহোম ইন্টারন্যশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপরি) গত পাঁচ বছরের অস্ত্র ব্যবসা নিয়ে সম্প্রতি এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, ইউরোপে অস্ত্র ব্যবসা বাড়তে শুরু করে ২০১৪ সাল থেকে। ওই বছর ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া। মূলত এ ঘটনাই বাড়িয়ে তোলে ইউরোপের নিরাপত্তা উদ্বেগ। এর পরপরই ইউরোপের একাধিক দেশ সামরিক খাতের বাজেট বাড়িয়ে দেয়। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এই গুরুত্ব আরো বেশি বোঝা যায়। ইউক্রেনের এখন দরকার শুধু অস্ত্র। ঐ পাঁচ বছরে বিশে^র অস্ত্র বাণিজ্যের ৭৮ শতাংশ ছিল মাত্র পাঁচটি দেশের দখলে। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি ও চীন। আর যুক্তারাষ্ট্র বিশে^র সবচেয়ে বড় অস্ত্র রপ্তনিকারক দেশ। আর শীর্ষ দশ অস্ত্র আমদানিকারক হলÑ ভারত, সৌদি আরব, মিশর, অস্ট্রেলিয়া, চীন, কাতার, দক্ষিণ কোরিয়া, পাকিস্তান, জাপান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই দেশগুলো বিশে^র ৫৫ শতাংশ অস্ত্র আমদানি করে। 

এই যুদ্ধ পৃথিবীকে একটি নতুন ব্যবস্থায় দাড় করাচ্ছে। অথচ বিশ^জুড়েই মন্দাবস্থা আরো প্রকট হচ্ছে। এর মধ্যেও ব্যক্তিগতভাবেও মিলিয়নারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধও চলছে আবার এই লড়াইও চলছে। কিন্তু সমাধানের ক্ষেত্রে তেমন কোনো ভালো কোনো আশা করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে না।  ঠিক কবে এই যুদ্ধ বন্ধ হবে তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ পরাশক্তিগুলো আদৌ যুদ্ধের মধ্যেমে কি চায় সেটাই স্পষ্ট নয়। যদি যুদ্ধ দিয়েই একসময় যুদ্ধ শেষ হয় তাহলে সেই ক্ষয়ক্ষতি হবে ভয়ঙ্কর। কারণ পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগের ব্যাপারটি বারবার উঠে আসছে। তৃতীয় বিশ^যুদ্ধের কথা আসছে। প্রাসঙ্গিক কারণেই এসব বিষয় উঠে আসছে। যুদ্ধ কোনোদিনও ভালো কিছু দিতে পারে না। এতে একপক্ষ বিজয়ী হবে নিশ্চয় কিন্তু ততদিনে বহু প্রাণ এবং অবকাঠামো ধ্বংস হবে যে পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে বহু সময় লাগবে। গাজা এখন একটি ধ্বংসস্তূপ শহরে পরিণত হয়েছে। সেখানকার জনগণের জীবন কি আর কোনোদিন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ফিরে আসবে? যদি আসে সেই শান্তি প্রক্রিয়ার কী হবে? কারণ দশকের পর দশক ধরে জিইয়ে রাখা একটি সমস্যার নাম গাজা উপত্যকা। বহু আগেই গাজার শিশুর রক্তে সেখানকার মাটি লাল হয়েছে। আবার অবকাঠামোতে একসময় ঘুরে দাড়ালেও মানুষ তো আর ফিরে আসবে না। তাছাড়া যুদ্ধ যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে পৃথিবী জুড়েই সংকট তীব্র হবে। খাদ্যসংকট হবে সবচেয়ে তীব্র। 

পরাশক্তিগুলো আছে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে। তবে আলোচনায় যে সমাধান আসতে পারে সে নিশ্চিত। তবে এবারের ইসরাইলের অবস্থা একটু ভিন্ন। হামাসের হামলার শিকার হয়ে বহু মানুষ নিহত হওয়ার পর ইসরাইল এই অভিযানে নেমেছে। নিজেদের সর্বোচ্চ শক্তির প্রয়োগ করছে তারা। যদি এই সমস্যার সমাধানে বিশ্ব ব্যর্থ হয় তবে এক বিভক্ত বিশ^ নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। যেখানে স্পষ্ট হবে শক্তির বিভক্তি বলয়। যেখানে বলয়ের একদিকে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রশক্তি এবং অন্যদিকে রয়েছে রাশিয়া-চীন। এই যুদ্ধে বিশে^ নতুন মেরুকরণ শুরু হয়েছে যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের বিষয়টি প্রবলভাবে ধাক্কা খাচ্ছে।

যুদ্ধ থামার কোনা আশা দেখছে না বিশ^। যত দীর্ঘ সময় নিয়ে যুদ্ধ হবে ততই ক্ষতি বাড়বে। নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটবে। মানুষ তার বেঁচে থাকার আশা হারাবে। নিজেকে একবার সেই জায়গায় ভাবি যেখানে যুদ্ধাবস্থায় মানুষের দিন-রাত চলছে। হয়তো একপক্ষ বিজয়ী হবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত হেরে যাবে মানবতা অর্থাৎ মানুষ। যুদ্ধ এক আজব বিষয়। মানুষের প্রাণ নিয়ে মানুষের লাভ! লাভ-ক্ষতির হিসেবের পাল্লায় ক্ষতির হিসাবটাই অনেক বড়। একটি টেকসই পৃথিবী গঠনে অস্ত্র নয় প্রয়োজন সবার জন্য খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানের মতো মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করা। সেই লক্ষ্যে অগ্রসর হতে প্রথমেই যুদ্ধ বন্ধ করতে হবে। আর তা না হলে নিজেদের হাতে তৈরি সভ্যতায় নিজেরাই বিলুপ্ত হবে কোনো সন্দেহ নেই।
 

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত