বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫ ৮ শ্রাবণ ১৪৩২
বুধবার ২৩ জুলাই ২০২৫
মেগাপ্রকল্প : একটি অর্থনৈতিক পর্যালোচনা
ড. স্বপন চন্দ্র মজুমদার
প্রকাশ: শনিবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৩, ২:৪৮ PM
এই শতাব্দীর শুরুর দশকের অন্তিম পর্বে যখন বিশ্ব অর্থনীতি অর্থনৈতিক মন্দার মুখোমুখি, তখন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকার দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চ্যালেঞ্জ নিয়ে যাত্রা শুরু করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিগত পনেরো বছরে অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক নানান উত্থান-পতন ও চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও এগিয়েছে এ দেশের অর্থনীতি এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে মানুষের জীবনযাত্রার মান।

সম্প্রতি এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) প্রকাশিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুকে যার প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির পূর্ভাবাস ছাড়াও চলমান নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতিও শিগিগিরই নিয়ন্ত্রণে আসবে বলে মন্তব্য করা হয় ওই রিপোর্টে। অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ কীভাবে অভূতপূর্বভাবে এতদূর এগোলো তা বিশেষ পর্যালোচনার দাবি রাখে।

করোনা মহামারি এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে খাদ্যশস্য, গ্যাস, তেল, জ্বালানিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্তর যখন বিশ্ব অর্থনীতির ভিত নড়বড়ে করে দিয়েছে, তখন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রবৃদ্ধির হার বজায় রেখে উন্নয়নে গতি ত্বরান্বিত করায় সরকারের বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী নেতৃত্বের অনস্বীকার্য ভূমিকা নিশ্চিতভাবেই প্রশংসার দাবিদার। অর্থনীতির এই চমকপ্রদ এবং অভূতপূর্ব অগ্রগতির পেছনে সরকার গৃহীত অবকাঠামোগত উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে।

পদ্মাসেতু : বিশ্বের আর্থিক দাতা সংস্থাগুলো থেকে ঋণ চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় মনোবল ও দেশের উন্নয়নে তাঁর অবিচল আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলনস্বরূপ দেশের জনগণের টাকায় নির্মিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু বাংলাদেশের জন্য শুধু অবিশ্বাস্য অর্জনই নয় বরং তৃতীয় বিশ্বের জন্যও এক অনন্য নজির। নির্মাণকালে অনেক আলোচনা-সমালোচনা, নানান প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও ২০২২ সালের ২৫ জুন খরস্রোতা পদ্মার বুকে যানবাহন চলাচলের জন্য উদ্বোধন করা হয় স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পদ্মা নদীর ওপর নির্মিত এই বহুমুখী সড়ক ও রেলসেতু বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু। সেতুটি মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, লৌহজংকে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তের সঙ্গে সংযুক্ত করেছে, যা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তকে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করেছে। ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এই সেতুর নির্মাণে খরচ হয়েছে মোট ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, মাত্র এক বছরের সামান্য একটু বেশি সময়ে এই সেতু থেকে টোল সংগ্রহের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। টাকার এই অঙ্ক এই সেতুর গুরুত্বের প্রতিফলন প্রকাশ করার পাশাপাশি এটাও স্মরণ করিয়ে দেয় যে, দেশের উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলকে সংযুক্ত করার মধ্য দিয়ে কত অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে এই সেতু। সম্প্রতি এই সেতুর ওপর দিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে রেল পরিচালনা করা হয়েছে। রেলসহ পুরোদমে এই সেতুর কার্যক্রম চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও দেশের আর্থসামাজিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে নিঃসন্দেহে এই সেতু বিবেচিত হবে।

ঢাকা মেট্রোরেল : ২০১৩ সালে এই অতি জনবহুল ঢাকা মহানগরীর ক্রমবর্ধমান যানবাহন সমস্যা ও দুঃসহ যানজট কমিয়ে আনার লক্ষ্যে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে বর্তমান সরকার, যার অধীনে প্রথমবারের মতো ঢাকায় মেট্রোরেল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। সে সময় মেট্রোরেলের মোট ছয়টি রুটের প্রস্তাব করা হয়, যেগুলো ছিল এমআরটি লাইন ১, ২, ৪, ৫ (নর্দার্ন ও সাউদার্ন), এবং ৬। ২০১৬ সালের ২৬ জুন এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয়। গত বছরের ২৮ ডিসেম্বর এমআরটি লাইন ৬-এর দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও অংশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্বোধনের মাধ্যমে ঢাকায় মেট্রোরেল আংশিক চালু হয়। প্রাথমিক পরিকল্পনায় উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ২০.১০ কিলোমিটার নির্মাণের কথা থাকলেও পরে তা সংশোধন করে মেট্রোরেলের রুট কমলাপুর পর্যন্ত আরও ১.১৬ কিলোমিটার বাড়ানো হয়। পুরো প্রকল্পের কার্যপ্রক্রিয়ায় আরও কিছু সময় লাগলেও ইতোমধ্যে ঢাকার যানজট নিরসনে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে চালু হওয়া মেট্রোরেলের এই আংশিক লাইন। বলা বাহুল্য, দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে এই সংযোজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে : অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট বাহনগুলো শহরে ঢুকতে যাতে কোনো ধরনের বাধার মুখে না পড়ে সরাসরি ঢাকাকে বাইপাস করে চলে যেতে পারে সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ১২২ বিলিয়ন টাকা খরচে ৪৬.৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের মূল উদ্দেশ্য ছিল ঢাকার বাইরে বিশেষ করে গাজীপুরের দিক থেকে বা উত্তরবঙ্গ থেকে যে বাহনগুলো অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে আসে, সেগুলো যেন ঢাকাকে বাইপাস করে চট্টগ্রামে চলে যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে যানজট নিরসনের জন্য ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে গাড়ি ওঠা ও নামার বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) আওতায় পরিবহন খাতে এই প্রথম প্রকল্প গত ২ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করেন। সম্পূর্ণ এক্সপ্রেসওয়ে অর্থাৎ তেজগাঁও থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত আগামী বছরের জুনে চালু করা সম্ভব হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা। এই এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়ে ঢাকা ইপিজেড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের যোগাযোগ সহজ হওয়ার পাশাপাশি ঢাকার যানজট নিরসন, যানবাহনের সময় সাশ্রয় ও পরিবহন ব্যয় কমানোর ক্ষেত্রে এক্সপ্রেসওয়েটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখবে।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র : ২০১৩ সালের অক্টোবরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের প্রথম পর্যায় কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। বিদ্যুৎ সরবরাহ ঘাটতির সমস্যা আমাদের দেশে দীর্ঘ দিনের, কিন্তু এই সমস্যার সুরাহার আন্তরিক কোনো উদ্যোগ ইতোপূর্বে দেখা যায়নি। এই সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে ২০১০ সালের বাংলাদেশ সরকার এবং রাশিয়ান ফেডারেশন সরকারের মধ্যে ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওই বছরের নভেম্বরে জাতীয় সংসদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য সিদ্ধান্ত প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুরে স্থাপিত হচ্ছে। ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকার এই প্লান্টে ২টি ইউনিট রয়েছে, যার প্রতিটির বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এবং দ্বিতীয়টি ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য প্রস্তুত হবে। পুরোদমে উৎপাদন শুরু হলে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হওয়ার যে স্বপ্ন এ দেশের সাধারণ মানুষ দেখে তা বাস্তবায়নে অনেকদূর এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ। সেই সঙ্গে বিদ্যুতের জন্য বৈদেশিক জ্বালানি আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমবে।

বঙ্গবন্ধু টানেল : চট্টগ্রাম শহরের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত এবং সহজতর করার লক্ষ্যে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু টানেল। বাংলাদেশ ও চীন সরকার ‘জি-টু-জি’ অর্থায়নে টানেলটি নির্মাণ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার বহন করছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা এবং বাকি ৫ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা সহায়তা দিচ্ছে চীন সরকার। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর কর্ণফুলী নদীর তলদেশে স্বপ্নের টানেল নির্মাণকাজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন যৌথভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনা রাষ্ট্রপতি সি চিন পিং। এই টানেল নির্মাণের আগে করা এক সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে বলে মন্তব্য করা হয়। এই টানেল কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে আনোয়ারার সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের পতেঙ্গাকে সংযুক্ত করবে, যা বিকাশমান শিল্পাঞ্চল আনোয়ারার কেইপিজেডসহ দক্ষিণে স্থাপিত ও নির্মাণাধীন অন্যান্য শিল্প-কারখানার সঙ্গে চট্টগ্রাম শহরের যোগাযোগে দূরত্ব কমিয়ে সময় ও খরচ সাশ্রয়ে সহযোগী হবে এবং ওই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম শহরের যানজট কমানোর ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখবে এই টানেল।

বিগত ১৫ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় বর্তমান সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম মানুষের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধি, শিক্ষার হার বৃদ্ধি, চিকিৎসা ও নাগরিক সুবিধার প্রসারণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিসহ সামাজিক-অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষ ২০ অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী এই দাবির ন্যায্যতাকে সমর্থন করে। বাংলাদেশের সর্বত্রই গত প্রায় পনেরো বছরের উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য শেখ হাসিনা সরকারের বিকল্প শেখ হাসিনা সরকারই। অবকাঠামোগত উন্নয়নের এই শক্তিশালী ধারা অব্যাহত থাকলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন একদিকে যেমন ত্বরান্বিত হবে, অন্যদিকে দেশীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই)ও অনেকাংশে আকৃষ্ট করা সম্ভব হবে। তাই জাতীয় স্বার্থেই এই সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা প্রয়োজন।

লেখক : অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত