শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫ ৬ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫
রাজনীতি যার যার দেশ সবার
আব্দুল বায়েস
প্রকাশ: বুধবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৩, ৩:৫৯ PM
‘যত ধীরেই হোক, রাজনীতি এবং ব্যক্তিজীবনে সংকট বিমোচনের নিশ্চিত পথ হচ্ছে সংলাপ’ (সূত্র : ওকটাভিও পাজ ‘ইন দ্য লাইট অব ইন্ডিয়া’)। ২০১২ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের ৪০ বছর উদ্যাপন উপলক্ষ্যে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদ কর্তৃক একটা সেমিনারের আয়োজন করা হয়। ওই সেমিনারে শহিদস্মৃতি বক্তৃতা করেছিলেন আকবর আলি খান, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও হোসেন জিল্লুর রহমান। তাদের তিনজনের বক্তব্যে বাংলাদেশের রাজনীতি সঠিক করার তাগিদ ছিল, পাছে সাংঘর্ষিক রাজনীতি দেশটার ভবিষ্যৎ ম্লান করে দেয়। তারা এও বলেছেন, বিশ্বের অন্যতম সমজাতীয় সমাজ হিসেবে স্বীকৃত বাংলাদেশের আপ্রাণ চেষ্টা থাকবে মুক্তিযুদ্ধের মতো সমবায়ী চেতনা ধারণ করে পরের ৪০ বছর জাতীয় নীতিসংক্রান্ত বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছার। এটা গর্বের কথা যে, আমরা প্রারম্ভিক নিরাশাবাদ কাটাতে পেরেছি এবং আগামীতে হতাশাবাদ দূরীকরণ না করার তেমন কারণ নেই।

দুই.
তারপর থেকে এ বাংলাদেশে চোখ ধাঁধানো উন্নয়ন ঘটেছে, এ বিষয়ে সন্দেহ থাকার অবকাশ খুব কম। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রযুক্তির প্রসার ইত্যাদিসমেত বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে রোল মডেল আবির্ভূত হওয়ার বিষয়টি কল্পনা নয়, বাস্তব। কিন্তু অনেকটা অনাদিকাল থেকে একটা কুৎসিত রাজনৈতিক কালচার যে একে কুরে কুরে খাচ্ছে, যেমন করে মানবদেহ খায় ক্যানসার; এ উদ্বেগাকুল বিষয়টি অগোচরে ঘটছে। আমরা আদৌ উন্নয়নের গল্প নিয়ে গর্ব করতে পারি কি না সে প্রশ্ন আজ তুলছেন কেউ কেউ। সমস্ত শরীরে প্রবাহিত না হয়ে রক্ত যদি কেবল মাথায় জমে, তাহলে তাকে যেমন সুস্বাস্থ্য বলা যায় না, তেমন জনগণের স্বাধীনতা পাশ কাটিয়ে দ্রুতবেগে চলা উন্নয়নের রেলগাড়িটা কখন যে দুর্ঘটনায় পড়বে তা কেউ বলতে পারবে না।

ধরুন, আনুক্রমিক সরকারগুলো বিরোধী পক্ষকে দমন করতে যেসব আইনকানুনের আশ্রয় নেয়, যেমন প্রিভেনটিভ ডিটেনশন, বা অন্য কোনো ধরায়, সেকেলে সেগুলো এখনও চোখ রাঙায়। অমর্ত্য সেনের বইয়ে পাই, ব্রিটিশরা তার আত্মীয়স্বজনকে আটক করেছে এ কারণে নয় যে, তারা কোনো দোষ করেছে; বরং ‘দোষ করতেও পারে’ এমন সন্দেহে বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি। এর পাশাপাশি একটা উদ্ভট উন্নতি লক্ষ করি, তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে যে যেখানে, যখন এবং যেভাবে পারছে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে সরকারকে তুলাধুনা করছে। অথচ তার পরও এক পক্ষ বলছে কিছুই বলতে দেওয়া হচ্ছে না; এত লিখিত-অলিখিত নিষেধাজ্ঞা দিয়ে বদনাম কেনার কসরত কেন সরকার করছে তা বুঝতে অক্ষম এই অধম।

তিন.
অথচ যাদের জেলে পুরে ছারখার করা দরকার, যেমন লাখ লাখ কোটি টাকার ঋণখেলাপি এবং ডলার পাচারকারী; ভূমি, নদী, জলাশয় দখলকারী; পরিবেশ বিনষ্টকারী; রাঘববোয়াল দুর্নীতিবাজ কিংবা সাগর-রুনি ও এএসএমএস কিবরিয়ার হত্যাকারী; তারা কিন্তু থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে এবং আপাতদৃষ্টে দেশের আইনকানুন তাদের পক্ষেই যায় বলে জনমত। অর্থাৎ দেশবিরোধীরা যতটুকু স্পেস পাচ্ছে প্রচলিত আইনকানুন থেকে, সরকারবিরোধীরা ততটুকু পাচ্ছে বলে মনে হয় না।

কারও কারও ধারণা, নিবর্তনমূলক আইন দিয়ে কণ্ঠস্বর নিবৃত্ত করা রীতিমতো অনৈতিক শুধু নয়, ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী করার টেকসই সোপানও তা নয়। ষাট বা সত্তরের দশকের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিলে বর্তমানে মনের ভাব প্রকাশ করার স্বাধীনতা অনেক বেশি বলে হয়তো মনে হবে; কিন্তু একবিংশ শতকের নিরিখে, যখন পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চোখ ধাঁধায়; প্রায় শতভাগ ঘরে বিদ্যুৎ, শিক্ষা প্রাণ জুড়ায়, কাজের বুয়ার হাতে স্মার্ট ফোন, বিকাশে টাকা পাঠায় ঠিক সেই পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান বাংলাদেশে বাকস্বাধীনতা বেশ সংকুচিত এমনকি রুদ্ধ বলে সমালোচকদের ধারণা। সুতরাং সরকার বদলাতে হবে এ দাবি তাদের।

চার.
কীভাবে বদলাতে পারি সরকার? অবশ্যই নির্বাচনের মাধ্যমে। তবে কথা হলো উন্নয়নের মহাসড়কে আছি অথচ এ দেশের নির্বাচনপ্রক্রিয়া যেমন বিতর্কিত, তেমন নিন্দিত সময়ের আবর্তনে। গেল ৫০ বছরে বাংলাদেশ একটাও সর্বমতের কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারেনি; এর চেয়ে লজ্জার বিষয় কিছু হতে পারে না। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত একটা স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের (ওখানকার প্রধান নির্বাচন কমিশনারের ভাষায় নির্বাচন কমিশনই তত্ত্বাবধায়ক সরকার) মাধ্যমে যুগের পর যুগ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে আমরা যে খাদে ছিলাম সেখান থেকে উঠে আসতে পারছি না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না বলে এসেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ধরে নিলাম তারা নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দিতে পেরেছে, কিন্তু তার পরও তো ওই ব্যবস্থা টেকসই ব্যবস্থা নয়, এর মধ্যে দলের পছন্দের তত্ত্বাবধায়ক বসাতে গিয়ে কি তুলকালাম ঘটেছিল তা স্মৃতির জাদুঘরে, যা না বলাই শ্রেয়। অতএব তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল এবং দলীয় সরকারের অধীনে ‘নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক অমানিশা রয়েই গেল এ অভিযোগে যে, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন নিরপেক্ষ হয় না। 

অতএব আন্দোলন গড়ে তোলা। সরকারবিরোধী আন্দোলনে যাবার যথেষ্ট যুক্তি থাকলেও যাত্রীবাহী বাসে আগুন কিংবা অন্য সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কখনওই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং সরকারেরও দায়িত্ব আছে দেখা যে, অপর দলের পিঠ যেন দেওয়ালে না ঠেকে।  

পাঁচ.
এদিকে দেশের অর্থনীতি ক্রান্তিকালে। বাংলাদেশকে এখন দারুণ চিন্তায় ফেলেছে অনেক কিছু, তবে সবকিছু  ছাপিয়ে ডলারের বিপরীতে টাকার মানে ধস এবং রিজার্ভের পতন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। যারা বলছেন আমরা খুব ভালো আছি, সবকিছু ভালো চলছে তারা যেমন ঠিক নন; তেমন ভুল করছেন গেল গেল অর্থনীতি গেল, আর মাত্র কদিন তার মধ্যেই সব শেষ; এ-জাতীয় যুক্তিতর্ক দিয়ে যারা আতঙ্ক ছড়াচ্ছেন তারাও। দেশের বর্তমান নাজুক অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া দরকার সেদিকে নজর দেওয়া হবে এ মুহূর্তের সহি কাজ। ডুবন্ত মানুষটিকে আগে উদ্ধার এবং পরে বকাবকি করা হবে বুদ্ধিমানের দৃষ্টিভঙ্গি।

দেশের সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, ‘ধারাবাহিকভাবে কমছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। আমদানি ব্যয়ে লাগাম টেনেও ঠেকানো যাচ্ছে না পতন। আমদানি কমলেও ব্যাংকে ব্যাংকে সংকট থাকায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের জরুরি আমদানি এবং বকেয়া বিল পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংককে রিজার্ভ থেকে প্রচুর ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এর ফলে প্রতি মাসেই কমছে রিজার্ভ, যা পুরো অর্থনীতি নাজুক পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না কমিয়ে আরও বাড়িয়েছে। জুলাইয়ের আগ পর্যন্ত যত চাহিদাই আসুক, এক কর্মদিবসে ৬০ মিলিয়ন ডলারের বেশি বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত ছিল। এখন প্রতি কর্মদিবসে বিক্রি করা হচ্ছে ৭০ মিলিয়ন ডলার’। জানা যায়, ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলার ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর প্রায় ২৭ বিলিয়নে নেমেছে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অবশ্য ইডিএফ ফান্ডের ৮ বিলিয়ন বাদ দিলে রিজার্ভ দাঁড়ায় প্রায় ১৯ বিলিয়ন ডলারে; যা উদীয়মান চ্যালেঞ্জের দিকে আঙুল তোলে। অন্যদিকে ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতিতে মানুষের নাভিশ্বাস বিশেষত গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের। বলা হচ্ছে, নির্বাচনের আগে নানান কারণে অর্থনীতি বেশ চাপের মধ্যে থাকবে।

এরই মধ্যে সরকারবিরোধী আন্দোলন সহিংস হয়ে উঠেছে। বলা হচ্ছে, বিরোধী নেতাকর্মীদের নানা অভিযোগে জেলে পাঠানো হচ্ছে। আমরা দেখছি, অবরোধ আর হরতালে নাকাল জনগণ। প্রাণ ঝরছে, সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে, পাটা-পুতায় ঘষাঘষি মরিচের মরণদশা। আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চালু করেছে ভিসানীতি, যার মাধ্যমে সেই দেশ বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক’ দেখতে চায়। আমাদের দেশের রাজনীতি যে কত দেউলিয়া হয়ে গেছে তার প্রমাণ বিএনপি বলছে, যুক্তরাষ্ট্র যা করছে তা আওয়ামী লীগের বিপক্ষে যাবে আর ওদিকে আওয়ামী লীগ বলছে, এ নীতি বিএনপির আগুনসন্ত্রাসের বিপক্ষে। বাম দল দুই দিকেই আছে অথচ কেউ বলছে না একটা স্বাধীন-সার্বভৌম দেশকে এভাবে নির্দেশ দেওয়া যায় না।

ছয়.
সুতরাং বাংলাদেশ সম্ভবত সাম্প্রতিককালের ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময় পার করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে মূল্যস্ফীতি, রিজার্ভ এবং অন্যান্য কারণে অর্থনীতি চাপের মধ্যে, তার ওপর চলমান রাজনৈতিক সহিংসতা গোদের ওপর বিষফোড়া হয়ে আসছে। সংকট সমাধানের উপায় হচ্ছে সরকারি ও বিরোধী দলের সংযম প্রদর্শন এবং পারস্পরিক আস্থা স্থাপন। বাংলাদেশের বহমান অর্থনৈতিক উন্নয়নধারা ধরে রাখতে এবং অর্থনৈতিক সংকটের অবনতি ঠেকাতে সংলাপের কোনো বিকল্প আছে বলে আপাতত মনে হয় না। সাধারণ নাগরিকরা অন্তত তাই মনে করে।  রাজনীতি যার যার, কিন্তু  দেশটা সবার মনে রেখে দুই পক্ষকেই এগিয়ে আসতে হবে সংলাপে। 

কবি রবার্ট ফ্রসটের কথায়, ‘ দ্য উডস আর লাভলি, ডার্ক অ্যান্ড ডিপ,/ বাট আই হ্যাভ প্রমিস টু কিপ,/ অ্যান্ড মাইলস টু গো বিভোর আই স্লিপ,/ অ্যান্ড মাইলস টু গো বিফোর আই স্লিপ।’

লেখক : অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত