সোমবার ১৬ জুন ২০২৫ ২ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ১৬ জুন ২০২৫
জাতির জীবনে প্রেরণা
মামুনুর রশীদ
প্রকাশ: শুক্রবার, ১০ নভেম্বর, ২০২৩, ৪:২৫ PM
মানুষের জীবনে স্বর্ণযুগ সব সময় আসে না। আমরা যারা শিল্প-সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত তারা সব সময়ই জীবন থেকে প্রেরণা খুঁজি। একটা বড় প্রেরণার জায়গা তৈরি হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের সময়ে, যার একটা সফল সমাপ্তি হয়েছিল এবং আমরা আমাদের প্রিয় ভাষাকে রক্ষা করতে পেরেছি। এরপর ষাটের দশকের গণ-অভ্যুত্থান এবং যার পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধ। তারও একটা সফল সমাপ্তি ঘটেছিল। এই সবকিছুই এসেছিল রক্তের বিনিময়ে। কিন্তু পঁচাত্তরে এসে আবারও একটি রক্তক্ষয়ী প্রতিক্রিয়াশীল অভ্যুত্থান ঘটে। যার ফলাফল ১৫টি বছরের জন্য দেশটিকে নিয়ে পুনরায় বিপরীতমুখী প্রচেষ্টা চলে। এই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা রুখে দাঁড়াই এবং তারও একটা সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। এই সময়ে একটা প্রতিবাদী শিল্প-সাহিত্যের জন্ম নেয়। সব রাজনৈতিক শক্তি সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করেছিল। একমাত্র মৌলবাদী এবং একাত্তরের শত্রুদের সঙ্গে নেওয়া হয়নি।

কিন্তু গণতন্ত্রের এই সংগ্রামের একটা সফল সমাপ্তি হলেও সাম্প্রদায়িক শক্তির অবসান ঘটেনি। এরপর নিরবচ্ছিন্ন গণতান্ত্রিক শক্তির রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ ঘটে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সমাজে অনৈক্য থেকেই যায়। সেই অনৈক্য নানা ধরনের সংঘর্ষ এবং আন্দোলনের পথ ধরে জনজীবনে নতুন কোনো প্রেরণার সৃষ্টি করে না। এ এক দুঃখজনক ঘটনা এবং সব সময়ই জিম্মি হয়েছে মানুষ। যেমনÑ হরতাল, অবরোধ, দলে দলে সংঘর্ষ এবং রাষ্ট্রক্ষমতায় কখনো মৌলবাদীদের অংশীদারি আবার কখনো ব্যবসায়ীদের ব্যাপকভাবে অংশীদারি।

এই অনৈক্যের ফলে আমাদের সম্পদ বিপুলভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যায়। ব্যবসায়ীদের রাষ্ট্রক্ষমতায় অংশগ্রহণের ফলে একটা অসম্ভব কল্পনাতীত বিত্তের মালিক তাঁরা হয়ে যান। দেশটা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার যে অঙ্গীকার ছিল সমাজতন্ত্রের, তা থেকে ছিটকে গিয়ে একটা পুঁজিবাদী ধারার দেশে পরিণত হয়। এই পুঁজিবাদের যে বড় শক্তি তা হলো বৈষম্য। আর এই বৈষম্যের ফলাফল হচ্ছে একশ্রেণির লোক রাতারাতি বড়লোক হবে, অন্যদিকে কোটি কোটি মানুষ দারিদ্র্য বরণ করবে। আর এই পুঁজিবাদ রাষ্ট্রের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য এসব নাগরিক অধিকারকে বিপর্যস্ত করে ব্যক্তিগত ব্যবসার অন্তর্গত করে তুলবে। রাষ্ট্রমালিকানাধীন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপরীতে তারা ব্যক্তিগত বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলবে, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার তৈরি করে বিপুল বিত্তের মালিক বনে যাবে। আমাদের চোখের সামনেই ছোট্ট একটি ক্লিনিক মাত্র দুই দশকের মধ্যে সারা দেশে বিপুল অবকাঠামো তৈরি করে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় বা স্কুল-কলেজের শিক্ষাব্যবস্থাও একেবারেই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে গড়ে তুলে অকল্পনীয় বিত্তের মালিক হয়ে যাচ্ছে। এই ব্যবস্থাকে কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না। ফলে দুটো ব্যবস্থাই ব্যক্তি ব্যবসায়ীদের হাতে পড়ে একধরনের প্রায় লুটেরা সম্পদে পরিণত হয়েছে। এই শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থীরা দেশটাকে বসবাসের অযোগ্য মনে করছে। যেসব শিক্ষাঙ্গনে বিদেশে যাওয়ার সুযোগ বেশি, সেগুলোতে অভিভাবকেরা বিপুল অর্থ লগ্নি করছেন। এই লগ্নির টাকা কোথা থেকে আসে? একদিকে ব্যবসায়ীদের মাত্রাতিরিক্ত মুনাফা আর অন্যদিকে আমলা-রাজনীতিবিদদের অবৈধ অর্থ। শিক্ষার্থীদের বিদেশে পাঠাতে পারলে অর্থ পাচারের সুবিধা হবে। আর বিদেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটা শিক্ষা-বাণিজ্যের মধ্যে জড়িয়ে যায়। তাদেরও তৃতীয় বিশ্বের শিক্ষার্থীর দরকার। প্রয়োজনবোধে তারা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে অভিবাসনের আইন পর্যন্ত সংশোধন করতে পারে।

স্বাস্থ্যব্যবস্থাগুলোও তাই। দেশের ক্লিনিক ও হাসপাতালগুলো যখন অপ্রতুল সামর্থ্য দেখায়, তখন বিদেশের হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ইংল্যান্ড, আমেরিকার হাসপাতালগুলোতে দরিদ্র দেশ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের রোগী চিকিৎসার জন্য নিবেদিত হয়। ইতিমধ্যে প্রাইভেট মেডিকেল কলেজগুলোতে শিক্ষার অপ্রতুল ব্যবস্থা, শিক্ষকের অভাবÑ সব মিলিয়ে উপযুক্ত চিকিৎসক তৈরির ব্যবস্থাটিও ভেঙে পড়ে। তারপরেও নানান কৌশলে চিকিৎসকদের যথার্থ শিক্ষার সুযোগ আর অবশিষ্ট থাকে না। তাই মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং বিত্তহীন মানুষেরাও বাঁচার প্রয়োজনে অবশিষ্ট সব সম্পদ বিক্রি করে হলেও বাঁচার আপ্রাণ চেষ্টা করে। এমনও দেখা গেছে, চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে দেশে ও বিদেশে একটি পরিবার সম্পূর্ণভাবে পথে বসেছে। কিন্তু রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে অপচয়ের অভাব নেই।

দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ, শিক্ষিত মানুষ, আমলাÑ প্রত্যেকেই রাষ্ট্রের সব সুযোগ-সুবিধা নেবেন কিন্তু রাষ্ট্রের জন্য কোনো রকম ত্যাগ স্বীকার করবেন না। ঔপনিবেশিক আমলে আমলাদের জন্য উপজেলা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থাটি ছিল, তা অত্যন্ত বিলাসবহুল এবং অপ্রয়োজনীয়। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে শিক্ষা বা প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা নেই, তাই আমলাদের কথামতোই তাদের চলতে হচ্ছে। আর এর ওপর আছে তদবিরের চাপ। বাংলাদেশে উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের সবাই আত্মীয়স্বজন। এই আত্মীয়তার উদ্দেশ্য মহৎ কোনো কাজে নয়, একেবারেই ব্যক্তিগত কারণে এবং সেই কারণটি অবশ্যই অর্থনৈতিক স্বার্থে।

প্রযুক্তির অভাবিত উন্নতির ফলে এবং সমাজে সত্যিকারের প্রেরণার অভাবের কারণে মানুষের মধ্যে একটা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য এসে গেছে। এই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য একশ্রেণির লোকের মধ্যে শুধুই বিলাসিতা এবং ভোগের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই ভোগ আবার বল্গাহীন। এতই বল্গাহীন যে ভোগের ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে যেকোনো অবৈধ কাজ বৈধ হয়ে যায়। নিজের দেশ ছেড়ে এই ভোগ বিদেশ পর্যন্ত গড়ায়। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইংল্যান্ড, আমেরিকায় নাইট ক্লাব বা ক্যাসিনোতে কোটি কোটি টাকার জুয়ায় বাংলাদেশের একশ্রেণির মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায়।

আরও অবাক হওয়ার কথাÑ দেশে এত সংস্থা থাকার পরেও ইয়াবা, আইসপিলের মতো মাদকের আমদানিকে ঠেকানো যাচ্ছে না। অবাক হওয়ার বিষয়Ñ ক্রিকেট খেলা এখন শুধু একটি ক্রীড়া নয়, জুয়ার উৎস। প্রতি রানে রানে জুয়া ধরে বাংলাদেশের শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে শত শত পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রকৃতিও লুণ্ঠনের এক অপূর্ব জায়গা। পাহাড় কেটে তা দখল করা, বনভূমি উজাড় করে সেখানে বসবাসের ব্যবস্থা করা এবং বালু উত্তোলনের নামে নদীর সর্বনাশ ঘটানো—এগুলো নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিশুরা শিক্ষায় কোনো আনন্দ পাচ্ছে না, শুধু নম্বরের জন্য কোচিং সেন্টারে বিরক্তিকর সময় পার করছে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সত্যিকারের কোনো শিক্ষা হচ্ছে না।

বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছাত্ররাজনীতির চরম অধঃপতন ঘটেছে। ছাত্ররা ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছে এবং রাজনৈতিক দলের অন্তঃসারশূন্যতার সুযোগে সব কটি দলেরই ছাত্রসংগঠন নিজেদের ইচ্ছামতো বিভক্তি ডেকে আনছে এবং সেখানেও গভীর আত্মসচেতনতার অভাব। তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি বা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে যে ছাত্ররাজনীতির চিত্র পাওয়া যায়, সে রকম কোনো প্রেরণার জায়গা আজকের ছাত্রদের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না। সাধারণ ছাত্ররা সব সময় একটা ভয়ের মধ্যে থাকে, হল, হোস্টেলে একটি সিট পাওয়া ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। হাউস টিউটর করুণার পাত্র হিসেবে দিন যাপন করেন। কেউ কেউ এর সুযোগ নিয়ে শিক্ষক রাজনীতিতে একধরনের চাপ প্রয়োগ করে থাকে।

বর্তমান বাংলাদেশ সরকার ক্রীড়া হিসেবে ক্রিকেটকে বেছে নিয়েছে। কয়েকবার তারা বিজয়ী হলেও উপর্যুপরি পরাজয়ের ফলে জনগণও নিজেদের পরাজিত মনে করে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে এই ক্রীড়া সারা দিনের জন্য পুরো জাতিকে আটকে রাখে। এর বিকল্প কোনো ক্রীড়া সমাজে প্রেরণার সৃষ্টি করতে পারে কি না, তা নিয়ে কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো ভাবনা নেই। এই ক্রীড়ার ফলে অন্য সব ক্রীড়ায় সরকারি বিনিয়োগ একেবারে কমে গেছে। শুধু তা-ই নয়, ফুটবলের মতো একটি জনপ্রিয় খেলা নেতৃত্ব ও পরিকল্পনার অভাবে শুকিয়ে মরছে।

মানুষের সচেতনতা প্রয়োজন, সমাজের প্রতিটি বিষয়কে ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা তার থাকা প্রয়োজন এবং তার জন্য একটা মুক্তচিন্তার মাধ্যমে সমালোচনাও করা উচিত। কিন্তু প্রতিটি বিষয়ে যদি শুধু নিজের কথা ভাবা হয় তাহলে তা আত্মঘাতী হয়ে পড়তে পারে। সমাজে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বলতে যা বুঝি তাতে প্রেরণার কিছু খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সমাজে আন্দোলনও প্রয়োজন। তবে সেই আন্দোলন যদি প্রেরণার সৃষ্টি করতে না পারে, তাহলে তা বিরক্তিকর কালক্ষেপণ মাত্র। কিন্তু প্রেরণা ছাড়াই বা একটি জাতি কী করে বাঁচবে বা বিকশিত হবে?

লেখক : সংস্কৃতিজন ও নাট্যব্যক্তিত্ব  

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত