মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫ ২৪ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫
তৈরি পোশাকখাত
শিল্পের সুরক্ষাতেই সবার স্বার্থরক্ষা
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৩, ৩:৩৯ PM
দেশের রপ্তানি আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস ও প্রধান খাত পোশাক শিল্পে প্রায়শই বেতনভাতা পরিশোধের দাবিতে বিক্ষোভ বা বেতনভাতা বৃদ্ধির জন্য কারখানায় হামলা-ভাঙচুরসহ নানামুখী অস্থিরতা-বিশৃঙ্খলার দৃশ্যাদৃশ্য অধিক মাত্রায় পরিলক্ষিত। বিদ্যমান বৈশ্বিক সংকট ও অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যায় এই খাত নানাবিধ চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। প্রতি পাঁচ বছর পর পর বেতন পুনর্নির্ধারণের যে বিধান রয়েছে, এর বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার এবারও মজুরি বোর্ড গঠন করার পরও হঠাৎ করে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পোশাক শ্রমিকদের আন্দোলন-জ্বালাও-পোড়াও ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। সংশ্লিষ্টদের মতে, পোশাক শিল্পে বিরাজিত চরম বিশৃঙ্খলা এই খাতকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। নতুন মজুরি ঘোষণা করার পরও ১২ নভেম্বর রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকরা। তাদের বক্তব্য, নূন্যতম বেতন বাড়ানোর ঘোষণায় তারা সন্তুষ্ট নন। তাছাড়া সবার বেতন সমান হারে বাড়েনি, এও তাদের অভিযোগ। কারখানা মালিকদের দাবি, কিছু শ্রমিক নেতা এবং বিদেশি অস্থিরতায় ইন্ধন দিচ্ছেন। তারা আরও বলেন, ‘যারা মারামারি করছে, কারখানা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, তারা সবাই বহিরাগত। যারা দেশের অগ্রগতি চায় না তারাই এসব কাজ করছে। করোনায় ৩ মিলিয়ন ডলারের অর্ডার বাতিল হয়েছে। সে জায়গা থেকে যখন ঘুরে দাঁড়াব তখন আবার সংকট। এই সময়টি অত্যন্ত সেনসেটিভ। সবাই চাচ্ছে এটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে।’

৮ নভেম্বর ২০২৩ ‘বাংলাদেশ ডেনিম এক্সপো’র ১৫তম আসরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি বলেছেন, ‘বেতন বৃদ্ধির পরও পোশাক কারখানায় আন্দোলন-সংগ্রাম ও অস্থিরতা চলতে থাকলে এ শিল্পের বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে। তাদের গন্তব্যের কোনো অভাব নেই। যেভাবে তারা শ্রীলঙ্কা থেকে মুখ ফিরিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা সেক্টরে বেতন ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি একটি ইতিহাস। তারপরও কিছু কিছু শ্রমিক নামধারী নেতা এটাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা অশুভ রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতায় জড়িয়ে ফায়দা নিতে চাচ্ছে। আমাদের শ্রমিক ভাইয়েরা অত্যন্ত সুশৃঙ্খল, ভদ্র। এ দেশকে আশির দশক থেকে এ পর্যন্ত নিয়ে আসার ক্ষেত্রে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আমরা অস্বীকার করি না।’ তৈরি পোশাক শিল্পে শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের এখন নিরাপত্তা ও কমপ্লায়েন্স প্রতিপালন বিষয়ে কোনো সমস্যা নেই। এ শিল্পে সুন্দর কর্মপরিবেশ বিরাজ করছে। তবে নির্বাচন সামনে রেখে কুচক্রী মহল তাদের অপতৎপরতা বাড়িয়েছেÑ এই অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া যায় না। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের চিহ্নিত নেতাদের অনেকেরই বিলাসবহুল জীবনযাপনের প্রবল জনশ্রুতি রয়েছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে ইতোমধ্যে শ্রমিক নেতা নামধারী ৩৬ জনের তালিকা প্রকাশ পেয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, এসব নেতা গার্মেন্টসে চাকরি করেন না, গার্মেন্টস শিল্পের সঙ্গেও জড়িত নন। কিন্তু তারা স্বার্থান্বেষী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট নেতা। তারা বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শ্রমিক সংগঠনের নামে কোটি কোটি টাকার আর্থিক অনুদান পেয়ে থাকেন। খাদ্যসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর জোরালো দাবি থাকলেও এ নিয়ে বড় ধরনের কোনো ক্ষোভ বা অসন্তোষ দৃশ্যমান নয়। তবে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষ মহল দেশের পোশাক শিল্প-অধ্যুষিত এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষের নামে বিক্ষোভ কর্মসূচি চালাচ্ছে। দেশের স্পর্শকাতর এই খাতের দিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের উন্নত রাষ্ট্রের ক্রেতাদের নজর থাকায় এই খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারলে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট করা যাবে, এও অনেকের অভিমত।

সত্তর দশকের শেষার্ধ থেকে একটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়ন সাধিত হয়। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাকের (ওভেন শার্ট) প্রথম চালানটি রপ্তানি হয় ১৯৭৮ সালে। পরবর্তী সময়ে বিদেশি ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়ায় দ্রুততর সঙ্গে এই শিল্প বিকশিত হয়। ১৯৮১-৮২ সালে মোট রপ্তানি আয়ে এই খাতের অবদান ছিল মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ। আশির দশকের শেষ পর্যায়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্যের আয়কে পেছনে ফেলে পোশাক শিল্প রপ্তানি আয়ে প্রথম স্থানে অধিষ্ঠিত হয়। ১৯৯১-৯২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক রপ্তানি প্রথমবারের মতো বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে এই শিল্প খাতে সরাসরি কর্মসংস্থান হয় ১ দশমিক ৪ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের, যার মধ্যে প্রায় ৮০ শতাংশ মহিলা। ১৯৮২ সালে দেশে পোশাক কারখানার সংখ্যা ৪৭টির বিপরীতে বর্তমানে তা ৫ হাজার ছাড়িয়েছে এবং কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ। প্রায় তিন যুগ ধরে পণ্য রপ্তানিতে তৈরি পোশাক শিল্প নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান বিশ্বে একক দেশ হিসেবে পোশাক রপ্তানিতে দ্বিতীয় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। ২০২০ সালে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে এলেও; এক বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ তা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানার সংখ্যা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। এই প্রেক্ষাপটে শিল্পের সুরক্ষাই সবার স্বার্থরক্ষা তা আমলে রাখা বাঞ্ছনীয়। কোনো দেশে এত পরিবেশবান্ধব কারখানা নেই। কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্পের পথ অমসৃণ করতে নানা অপতৎপরতার খবর আমাদের পীড়িত না করে পারে না। চলমান শ্রমিক আন্দোলনে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কত শ্রমিক কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এই বিষয়টি কি আন্দোলনকারীরা ভেবে দেখেছেন? এর ফলে ক্ষতি তো হলো বহুপক্ষের।

পোশাক শিল্পের হাত ধরে দেশের অর্থনীতি অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে বিশ্ব স্বীকৃত বাংলাদেশের দারিদ্র্যবিমোচন-কর্মসংস্থান-তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের কর্মদক্ষতা বাড়িয়েছে এই পোশাক শিল্প খাত। সামগ্রিক গুরুত্ব বিবেচনায় দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের উন্নয়নের অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বর্তমান সরকার আর্থিক প্রণোদনা, কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে নিয়মিত প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। পোশাক শিল্পসহ সব শিল্প-প্রতিষ্ঠানের নিরাপত্তায় সরকার শিল্প পুলিশ গঠন করেছে। শিল্প বিকাশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০টি স্পেশাল ইকোনমিক জোন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পর্যুদস্ততার মধ্যেও দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকার ভারসাম্য রক্ষার্থে বর্তমান সরকারের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর বাস্তবায়নে অর্থনীতির চাকাকে সচল করার গৃহীত সব উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত। দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থে বিকশিত এই শিল্পের সুরক্ষার দায়-দায়িত্বও সব পক্ষেরই।  বিদ্যমান সংকট নিরসন করে উৎপাদনের চাকা আরও গতিশীল করা জরুরি। আড়ালে থেকে কোনো মহল শ্রমিকের স্বার্থ পুঁজি করে নিজেদের হীনস্বার্থ চরিতার্থ করতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকেÑ এই অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রতিবিধান নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত