অবশেষে ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল। জাতির উদ্দেশে দেয়া বেতার ও টিভি ভাষণে তিনি নির্বাচনী তফসিল ছাড়াও সব রাজনৈতিক দলকে নিজেদের মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতা করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের আহ্বান জানিয়েছেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী ৭ জানুয়ারি ২০২৪ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আওয়ামী লীগসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল নতুন তফসিলকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনকারী এবং ইসলামী আন্দোলন নতুন নির্বাচনের তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে। নতুন তফসিল ঘোষণা না করা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের ওপর বিরোধীদের চাপ ছিল। ঘোষণা করা হলে হামলা, অবরোধ ইত্যাদির হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করা হয়েছিল। আতঙ্ক ছড়ানো হয়েছিল দেশব্যাপী নৈরাজ্য সৃষ্টি করার। ঢাকা শহরেও টানটান উত্তেজনা ছিল। অনেকেই সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন। বেশ কিছু সময়ের জন্য যানবাহন কমে গিয়েছিল। যদিও বুধবার যুগপৎ আন্দোলনকারীদের পঞ্চম মেয়াদের অবরোধের প্রথম দিন ছিল। কিন্তু অবরোধে যাত্রীবাহী বাস কম ছাড়া অন্যান্য যানবাহন দিনভর অনেকটাই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সন্ধ্যার আগমুহূর্ত থেকে রাতে কয়েক ঘণ্টা যানবাহন কমে গিয়েছিল। কারণ অনেকেরই ধারণা, বিরোধীদের হুঙ্কার অনুযায়ী যানবাহনের ওপর তাদের চড়াও হওয়ার আশঙ্কা করা হয়েছিল। তবে গোটা দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়া নিরাপত্তা জোরদার করায় কিছু কিছু জায়গায় হামলা ব্যতীত শহরগুলোতে বিরোধীদের তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। রাতে ৮ জেলায় কিছু যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল। রাত ৩টার দিকে টাঙ্গাইল কমিউটার ট্রেনের দুটি বগিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। যুগপৎ আন্দোলনকারীদের অন্যতম ঐক্যজোট গণতন্ত্র মঞ্চ বৃহস্পতিবার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ও বাম গণতান্ত্রিক জোট সকাল-দুপুর হরতাল ডাকে। কিন্তু বৃহস্পতিবার সারা দেশে অবরোধ ঢিলেঢালাভাবে হলেও হরতাল পালিত হওয়ার দৃশ্য তেমন একটা দেখা যায়নি। যানবাহন চলেছে, দোকানপাটও খুলেছে। বিরোধীদের কর্মসূচি আগামী সপ্তাহেও আসছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বিরোধীরা অনেক দিন থেকে আন্দোলন করছে। তাদের দাবি বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এসব দাবি বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু সংবিধান পরিবর্তন করার মতো রাজনৈতিক বাস্তবতা আন্দোলনকারী দলগুলো সৃষ্টি করতে পারেনি। ১৯৯৬ সালে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কিন্তু এ ব্যবস্থাও প্রত্যাশিত সুফল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে দিতে পারেনি। ২০০১ এবং ২০০৬-০৭ সালে নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় প্রমাণিত হয়েছে, এটি রাষ্ট্রের জন্য নানা বিপদ বয়ে আনে- যা ঘটেছিল ২০০৭-এর ১/১১-এর ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা দেশের সর্বোচ্চ আদালত অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক বলে এর বিরুদ্ধে রায় প্রদান করেন। ফলে পঞ্চদশ সংশোধনীতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় গৃহীত হওয়ার পর নতুন করে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অন্তর্ভুক্তি করা সাংবিধানিকভাবে সাংঘর্ষিক বলে বিবেচিত হয়। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারী দলগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোনো রূপরেখা কিংবা প্রস্তাবনা হাজির না করেই এর পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে আসছিল। নির্দলীয় কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি নিয়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের মতামত নেয়ার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেই পথ বাদ রেখে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করার মাধ্যমে বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা যা পেতে চেয়েছিল তাতে রাজি হয়নি ক্ষমতাসীন দল এবং সরকার। এ নিয়ে বিএনপির নেতৃত্বে নামসর্বস্ব বেশ কিছু রাজনৈতিক দল আন্দোলন করে আসছিল। ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ ডাকা হয়েছিল। তাতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নেতা-কর্মীদের জড়ো করা হয়েছিল সরকার পতনে ঢাকার রাজপথসহ বিভিন্ন স্থাপনা এবং সরকারি অফিসসহ সবকিছু অচল করে দেয়ার লক্ষ্যে। কিন্তু ২৮ তারিখ জড়ো হওয়া নেতা-কর্মীরা পুলিশ হত্যা, আক্রমণ, সাংবাদিকদের মারপিট, দেশের প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও বিচারপতিদের লাউঞ্জ ভাঙচুর, রাজারবারগ পুলিশ হাসপাতাল আক্রমণ, যানবাহন পুড়িয়ে দেয়াসহ ব্যাপক সংহিংস কর্মকাণ্ড সংঘটিত করার ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাস্তা থেকে আন্দোলনকারীদের সরিয়ে দিতে বাধ্য হয়। সে দিন সমাবেশে মিয়া আরেফি নামক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের একজন ভুয়া উপদেষ্টার বক্তৃতা দেয়ারও আয়োজন ছিল। যেখানে তাকে দিয়ে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী বা কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি, স্যাংশননীতি ঘোষণা করার পরিকল্পনা ছিল বলে জানা যায়। ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপি হরতাল, অবরোধ ডেকে দেশে গাড়ি ভাঙচুর ও পোড়াপুড়ির বেশ কিছু ঘটনা ঘটিয়েছে। এর ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেককে গ্রেপ্তার করেছে। যানবাহনে আগুন, ভাঙচুর, পুলিশ হত্যা ও বিভিন্ন জায়গায় অগ্নিসংযোগের সঙ্গে জড়িতদের সিসিটিভির মাধ্যমে চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীদের এতদিনকার আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ। কিন্তু ২৮ তারিখের মহাসমাবেশটিতে সরকার পতনের প্রস্তুতি নিয়েই কর্মী-সমর্থকদের জড়ো করা হয়েছিল। সেখান থেকেই এই আন্দোলন সহিংস রূপ ধারণ করে।
অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সব মহলকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু অবরোধ প্রত্যাহার কিংবা যানবাহনে হামলা বন্ধ হয়নি। নির্বাচনের দিনক্ষণও সংবিধান অনুযায়ী নিকটবর্তী হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু একটি চিঠি আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি বরাবর ঢাকাস্থ রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের মাধ্যমে প্রদান করেন। চিঠিতে ডোনাল্ড লু শর্তহীন আলোচনায় তিন দলকে বসার আমন্ত্রণ জানান। শর্তহীন আলোচনার কথা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বেশ আগেই বলেছিলেন। কিন্তু বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে তা নাকচ করে দেয়া হয়েছে। ডোনাল্ড লুর পত্র আসার পরও বিএনপি শর্তহীন আলোচনার ব্যাপারে রাজি হয়নি। অবশ্য বিএনপির অনেক নেতাই এখন কারাগারে কিংবা আত্মগোপন অবস্থানে রয়েছেন। পিটার হাস ১৫ নভেম্বর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের হাতে ডোনাল্ড লুর দেয়া চিঠি হস্তান্তর করেন। ওবায়দুল কাদের শর্তহীন আলোচনার বিষয়ে তার ব্যক্ত করা আহ্বানটি স্মরণ করিয়ে জানিয়েছেন যে, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার এই মুহূর্তে নতুন করে আলোচনা করার সময় নেই। ফলে ডোনাল্ড লুর চিঠিটি নিয়ে দেশের সব মহলেই যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, তা হলো এই চিঠি আরও আগে কেন দেয়া হয়নি। এখন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার দিন এমন চিঠির বিষয়ে কে সংলাপের উদ্যোগ নেবে তাও সুনির্দিষ্ট করা নেই। সুতরাং এই চিঠির তাৎপর্য অনেকের কাছেই বোধগম্য হয়নি। তাছাড়া অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হাতে। বিএনপি এবং যুগপৎ আন্দোলনকারীরা এই নির্বাচন কমিশনকেই মানে না। নির্বাচন কমিশনের কোনো আমন্ত্রণেই তারা অংশ নেয়নি, সাড়াও দেয়নি। তারা তাদের দাবিতে অনড়। ফলে শর্তহীন আলোচনা বা সংলাপের উদ্যোগ সরকারের পক্ষ থেকেও নেয়ার অভিজ্ঞতা সুখকর হওয়ার কোনো সম্ভাবনা কেউ দেখছে না। তারপরও অনেকে আশা করেছিলেন যে, বিএনপি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়ার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দেবে। নির্বাচনে অংশ নিলে দলের প্রার্থী, নেতা-কর্মীরা জনসাধারণের কাছে ভোট চাইতে যেতে পারতেন। নির্বাচনে তারা হয়তো ভালো ফলও অর্জন করতে পারতেন। নির্বাচন যদি অবাধ ও সুষ্ঠু না হয়, তাহলে দেশবাসীসহ সব মহলই দেখতে পেত। তখন যুগপৎ আন্দোলনকারীরা যেকোনো আন্দোলনের ডাক দিলে তার প্রতি জনসমর্থনও থাকত। তবে বেশিরভাগ রাজনৈতিক বিশ্লেষকের কাছেই মনে হচ্ছে যে, নির্বাচন কমিশন, সরকার এবং অংশীজন হিসেবে সব রাজনৈতিক দল যখন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে, তখন নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনেকটাই ত্রুটিমুক্ত হবে বলে সব মহলই আশা করছে। সে ক্ষেত্রে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনকারীদের এখনও হাতে কিছু সময় আছে তাদের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করার। তারা নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন এবং সরকারের সঙ্গে প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে হলেও আলোচনা করতে পারে। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তটি সম্পূর্ণ তাদের কোর্টে অবস্থান করছে। এখন বিরোধীরা ২০১৩-১৪-এর মতো জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন দাঁড় করাতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু চোরাগোপ্তা হামলা করে জনগণের সম্পদহানি ঘটাতে পারে, যানবাহন আক্রমণ করতে পারে, মানুষের চলাচলের বাধা সৃষ্টি করতে আতঙ্কও জিইয়ে রাখতে পারে। এটি নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির কোনো দলের কাজ হতে পারে না। এর ফলে দেশের রাজনীতি, নির্বাচন, অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু তাতে রাজনৈতিকভাবে যুগপৎ আন্দোলনকারীদের লাভ কতটা হবে, তা নিয়ে মস্ত বড় প্রশ্ন থেকেই যাবে। বিএনপির অভ্যন্তরে অনেকেই রয়েছেন যারা নির্বাচন করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তারা এখন কী করবেন? দল ২০১৩ সালের মতো নির্বাচন বানচাল করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বস্তুত দলের ভাবমূর্তি, কর্মকাণ্ড এবং রাজনীতি বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এবার নির্বাচনে অংশ না নিলে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলেই রাজনীতি সচেতন মহল মনে করে। ধারণা করা হচ্ছে, বিএনপির অনেক নেতাই স্বতন্ত্র প্রার্থী কিংবা অন্য কোনো দলের প্রার্থী হয়ে অংশ নিতে পারে। তেমনটি ঘটলে গ্রামেগঞ্জে নির্বাচনী আবহ সৃষ্টি হতে পারে। ভোটার উপস্থিতিও তখন বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে। আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং ত্রুটিমুক্তভাবে অনুষ্ঠিত হোক, সেটি সবারই একান্ত চাওয়া।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষক