এটি সর্বজনবিদিত যে, চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধসহ নানামুখী উদ্ভূত সমস্যায় বৈশ্বিক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা প্রায় পর্যুদস্ত। ফলে বিশ্বব্যাপী নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতি ও ডলার-জ্বালানি সংকটে জনজীবন ওষ্ঠাগত। বিরাজিত এই বিশ্বমন্দা ও ডলার সংকট কেটে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত হলেও বাস্তবে তার প্রতিফলন দৃশ্যমান নয়। অধিকন্তু বিশ্বরাজনীতি জটিল থেকে জটিলাকার রূপ পরিগ্রহ করে চলছে। এই সংকট খুব শিগগিরই দূরীভূত হওয়ার নয়।
এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ঋণ সংকট বিরাজমান ডলার সমস্যাকে আরও তীব্র ও দীর্ঘায়িত করছে। প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশেও ডলার সংকটের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, খেলাপি ঋণ, পণ্য আমদানি-রপ্তানি, রাজস্বসহ কোনো সূচকেই সন্তোষজনক অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে না। দেশের মুদ্রাবাজারে চরম অস্থিরতায় ব্যাংকের বাইরে খোলাবাজারে ডলারের দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রারও সংকট তৈরি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকেও অর্থনীতির বেশকিছু সূচকে অবনতির চিত্র সুস্পষ্ট। সামগ্রিকভাবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। টালমাটাল বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুরবস্থায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসী আয় গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে প্রতিভাত। প্রবাসীদের অতি কষ্টার্জিত রেমিট্যান্সের ওপর ভর করে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ মজবুত হয়েছে অর্থনীতির ভিত। দেশের জিডিপিতে অবদান রাখা এই রেমিট্যান্স পরিণত হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য অংশীদার। করোনাকালীন অর্থনীতিতেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল এই রেমিট্যান্স।
প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে উন্নয়নে বিস্ময়কর অর্জনে বিশ্বস্বীকৃত বাংলাদেশের এই সংকটময় মুহূর্তে সরকারের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর বাস্তবায়নে অর্থনীতির চাকাকে সচল করার গৃহীত সব উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত। বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধিতে প্রবাসীদের সিআইপি সম্মাননা, প্রবাসী আয়ের বিপরীতে প্রণোদনা, রেমিট্যান্স আহরণ-বিতরণ প্রক্রিয়া দ্রুতকরণ, দেশে আবাসন খাতসহ বিশেষ বিনিয়োগ স্কিম চালু ও প্রশিক্ষিত লোক পাঠানোর মতো নানা ধরনের কর্মতৎপরতা অতিশয় দৃশ্যমান। সর্বশেষ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মধ্যস্থতায় ব্যাংকের নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ও বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনকারী ব্যাংকের সংগঠন বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস (বাফেদা) কর্তৃক ডলার এবং সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের প্রণোদনাসহ রেমিট্যান্স কেনার সর্বোচ্চ দর নির্ধারণ করে দেওয়ায় ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স তথা প্রবাসী আয় প্রবাহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ১৫ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে মোট ১১৩ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স এসেছে। গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ৯২ কোটি ডলার। পুরো মাসে এ ধারা অব্যাহত থাকলে তা আবারও ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।
১৫ নভেম্বর ২০২৩ গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন মতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে টানা রেমিট্যান্স কমার পর অক্টোবর মাসে রেমিট্যান্স আসে প্রায় ১৯৮ কোটি ডলার। ২০২২ সালের অক্টোবর মাসের তুলনায় যা প্রায় ৩০ শতাংশ এবং ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় ৪৮ শতাংশ বেশি। ২০২২ সালের পুরো নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৬০ কোটি ডলার। উল্লেখ্য যে, বাফেদা এবং এবিবি গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ডলারের দাম নির্ধারণ করে আসছে। তবে প্রবাসী আয়ে সরকারের আড়াই শতাংশের পাশাপাশি ব্যাংকও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারে। ৫ শতাংশ প্রণোদনার ফলে ব্যাংকগুলো প্রবাসী আয়ে প্রতি ডলারে সর্বোচ্চ দাম দিতে পারছে। জুলাই ৩, ২০২৩ প্রকাশিত সংস্থাটির অন্য প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৬১ কোটি ৬ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ৫০ পয়সা হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২ লাখ ৩৪ হাজার ৪৭৫ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, করোনাকালে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রবাসী তাদের সঞ্চয়ের অর্থ নিয়ে দেশে ফিরে আসায় ২০২০-২১ অর্থবছরে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয়ের প্রবাহ লক্ষ করা যায়। যার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ১০৩ কোটি ১৬ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। আমাদের সবার জানা, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের গুরুত্ব বিবেচনায় বিদেশে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত আয় দেশে বৈধ উপায়ে প্রেরণে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ওয়েজ আর্নার্স রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে সরকার ১ জুলাই ২০১৯ থেকে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। এরই আলোকে ২০১৯ ও ২০২০ সালে করোনা অতিমারী ক্রান্তিকালে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্য-পর্যটনশিল্পে ধস ও রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা প্রতিকূলতায় সংকটে পড়া মধ্যপ্রাচ্যসহ প্রবাসীদের নিয়োগদাতা দেশগুলোয় কর্মী ছাঁটাই ও বেতন বন্ধসহ বহুবিধ সমস্যায় প্রবাসে কর্মসংস্থান হ্রাস পেলেও বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি পায়। পরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধকল্পে সরকার ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে রেমিট্যান্সের বিপরীতে নগদ প্রণোদনার হার ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
২০২২ সালে প্রবাসীদের পাঠানো আয়ের ভিত্তিতে প্রণীত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রবাসী আয় অর্জনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ভারত ও পাকিস্তান। উভয় দেশ ২০২২ সালে প্রবাসী আয় পেয়েছে যথাক্রমে ১০০ বিলিয়ন ও ২৯ বিলিয়ন ডলার। যা বিশ্বের মোট প্রবাসী আয়ের ১২ দশমিক ৬০ ও ৩ দশমিক ৬৫ শতাংশ। বাংলাদেশের পর দক্ষিণ এশিয়ায় চতুর্থ প্রবাসী আয় আহরণকারী দেশ হলো নেপাল। নেপালের জিডিপির ২১ দশমিক ৮ শতাংশ অবদান প্রবাসী আয়ের। ২০২২ সালে দেশটির প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ছিল ৮ বিলিয়ন ডলার। ৩ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার আয় নিয়ে পঞ্চম স্থানে আছে শ্রীলংকা। যা বিশ্বের মোট রেমিট্যান্সের দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং দেশটির জিডিপির ৪ দশমিক ৯ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান ও ভুটানের প্রবাসী আয় যথাক্রমে দশমিক চার বিলিয়ন ও দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংগঠনের (আইওএম) তথ্যানুযায়ী, অভিবাসী প্রেরণে বিশ্বের শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বিশ্বের ১৪৩টি দেশে বাংলাদেশের অধিকাংশ অভিবাসন প্রত্যাশীদের গন্তব্য হলেও প্রায় ৯০ শতাংশ অভিবাসী যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। শুধু সৌদি আরবে গত তিন বছরে বাংলাদেশি প্রবাসীর সংখ্যা চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান মতে, ২০২০ সালে ১ লাখ ৬১ হাজার ৭২৬ বাংলাদেশি কাজের সন্ধানে সৌদি আরব গমন করেন। ২০২১ ও ২০২২ সালে এ সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৪ লাখ ৫৭ হাজার ২২৭ ও ৬ লাখ ১২ হাজার ৪১৮ জনে। এ ছাড়া ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশির সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৭ হাজার ৬১০ জন।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এই ধরিত্রীর বিভিন্ন দেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত অর্থ-রেমিট্যান্স যারা দেশে পাঠাচ্ছে তাদের দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের প্রতি বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতা-অভিযোগের অন্ত নেই।
অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (বামারু) প্রতিবেদনেও প্রবাসী কর্মীদের নানা দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্যমতে, উপসাগরীয় দেশগুলোতেই বেশি মৃত্যু হচ্ছে প্রবাসী কর্মীদের। বিদেশের মাটিতে অনেক প্রবাসীর দাফন হচ্ছে। কিন্তু এসব মৃত্যুর কারণ নিয়েও কখনো অনুসন্ধান করেনি মন্ত্রণালয়। মৃত্যু সনদে গণহারে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বা ‘হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধে মৃত্যু’ লিখে দেওয়ায় অর্ধেকের বেশি মৃত্যুর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এতসব উত্থাপিত অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মহলের আমলে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। সরকারের পর্যাপ্ত উদ্যোগ গ্রহণের সঙ্গে প্রবাসী উপার্জন বৈধভাবে দেশে প্রেরণ এবং ডলার সংকটে এর প্রভাব বিস্তার অতিশয় তাৎপর্যপূর্ণ। সার্বিক আর্থিক ব্যবস্থাকে সহনীয় পর্যায়ে সচল রাখতে সরকারি ও বেসরকারি সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমদানি খাতকে শক্তিমান করার জন্য ডলার সংকট থেকে পরিত্রাণ অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়