(দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে কিছু কাজ করার সুবাদে তৃণমূলে গিয়ে দেখেছি নেতাকর্মীদের ক্ষোভ। দ্বাদশ নির্বাচনে কে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবে- এমন প্রশ্ন করা হলে বর্তমান এমপিদের নাম তেমন কেউই বলেনই না; বরং তারা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রয়েছে তৃণমূলের শতভাগ নেতাকর্মীদের। তাহলে এমপি-মন্ত্রী বনে গিয়ে তারা কেন তৃণমূলে জনপ্রিয় নন, কেন তারা সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। দেশে ব্যাপক উন্নয়ন-অগ্রগতি সাধিত হওয়ায় পরেও কেন এমপি-মন্ত্রীরা এত অজনপ্রিয়। ইতোমধ্যে প্রায় ১৪০ জন এমপির নাম লাল সংকেতের তালিকায় রয়েছে; আমার হিসাবে এ তালিকা আরো দীর্ঘ হবে)
দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে এখন থেকেই মাঠ সরগরম হয়ে উঠছে। যদিও আগমী নির্বাচন ঘিরে অনেক শঙ্কা, সংঘাত ও সহিংসতার দুরভিসন্ধি উড়িয়ে দেওয়া যায় না; সংবিধান অনুযায়ী অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, তবুও দেশবিরোধী শক্তি এ নির্বাচন বানচালের চেষ্টা এখন পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে। দেশ পরিচালনার সাংবিধানিক দায়িত্ব কোনোভাবেই নির্বাচন ছাড়া পাওয়া যাবে না। আমার আজকের বিষয়বস্তু নির্বাচনের সামগ্রিক ব্যবস্থা নিয়ে নয়, আজকের লেখার বিষয়বস্তু আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব, অভ্যন্তরীণ বিষয়, তৃণমূলের ভাবনা এবং আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে দলটির করণীয় কী তা তুলে ধরা।
নির্বাচন নিয়ে সংবাদ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও পর্যালোচনার কারণে আওয়ামী লীগের এমপিদের অজনপ্রিয়তা, জনবিচ্ছিন্নতা ও তৃণমূলের কর্মীদের অবহেলাই আজকের দলটিকে চরম পরীক্ষায় ফেলেছে। দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে কিছু কাজ করার সুবাদে তৃণমূলে গিয়ে দেখেছি নেতাকর্মীদের ক্ষোভ। দ্বাদশ নির্বাচনে কে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবে- এমন প্রশ্ন করা হলে বর্তমান এমপিদের নাম তেমন কেউই বলেনই না; বরং তারা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রয়েছে তৃণমূলের শতভাগ নেতাকর্মীদের। তাহলে এমপি-মন্ত্রী বনে গিয়ে তারা কেন তৃণমূলে জনপ্রিয় নন, কেন তারা সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেননি। দেশে ব্যাপক উন্নয়ন-অগ্রগতি সাধিত হওয়ায় পরেও কেন এমপি-মন্ত্রীরা এত অজনপ্রিয়। ইতোমধ্যে প্রায় ১৪০ জন এমপির নাম লাল সংকেতের তালিকায় রয়েছে; আমার হিসাবে এ তালিকা আরো দীর্ঘ হবে।
একটু ইতিহাসের দিকে নজর দিলে এদেশে অনেক অবিসংবাদিত নেতার জন্ম হয়েছে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, জাতীয় চার নেতা তাঁরা কেউই অঢেল ধন-সম্পত্তির ধনীর সন্তান ছিলেন না, টাকা-পয়সা দিয়ে নেতা বনে যাননি। তাঁরা সবাই তৃণমূল থেকে উঠে এসেছেন, মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় তাঁদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে অবিসংবাদিত ও কালজয়ী নেতৃত্ব।
আজকের নেতৃবৃন্দ এ কালজয়ী নেতৃত্ব নিয়ে মুখে শুধু বুলি আউড়ায়। কিন্তু এ কালজয়ী নেতৃত্ব বুকে ধারণ করে না কিংবা অনুকরণ করার চেষ্টা করে না। তাই আজকের এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী প্রোথিত হয়নি। নেতৃত্বের একটি নির্মোহ দিক থাকে, অধিকাংশ এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যেই এ দিকটি উপেক্ষিত। দেশের সাধারণ মানুষকে ভালোবাসার মধ্যে যে অসাধারণ তৃপ্তি পাওয়া যায়- তা আজ আর অনেক এমপি-মন্ত্রীদের মধ্যে দেখা যায় না। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রান্তিক ভূমিহীন অসহায়-গরিব মানুষকে ইট-বালু-রড-সিমেন্টের পাকা ঘর তৈরি করে দিয়েও এমপি-মন্ত্রীদের রাজনীতির দীক্ষা দিতে পারেননি। স্থানীয় এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের সাধারণ মানুষকে ঘিরে যে রাজনীতি করতে হয়- তা তারা অনুধাবন না করে কেউ কেউ রাজনীতিকে টাকা কামানোর হাতিয়ার বানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্মোহ নেতৃত্বের প্রতি সম্মান দেখাননি। তাই আজ আওয়ামী লীগ সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আগামী নির্বাচনের মনোনয়ন নিয়ে ভাবতে হচ্ছে, এ ভাবনাটা জটিল, তাই তাঁকে জটিল করেই আবারো ভাবতে হচ্ছে। সাধারণ জনগণ ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও ভাবনার এ জটিল সমীকরণটা তাই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উপর বিশ্বস্ততার সঙ্গে ন্যাস্ত করেছে। তাই কাকে মনোনয়ন দেওয়া উচিত- এ নিয়ে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা মন্তব্য করতে রাজি নন; প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তেই তাদের অগাধ আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে।
আগামী দ্বাদশ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের করণীয় কী, কী করলে আওয়ামী লীগ সাধারণ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জন করতে পারবে- তার কয়েকটি দিকনির্দেশনা তুলে ধরছি। আগামী নির্বাচনে কেমন নেতৃত্বের বলয় তৈরি করতে হবে সে বিষয় নিয়ে কয়েকটি সুপারিশ নিম্নে উল্লেখ করা হল-
এক.
বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে যাঁরা অহর্নিশ নেতৃত্ব দিয়ে এ বদ্বীপ গঠনে অসামান্য অবদান রেখেছেন তাঁদেরকে যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে, ইতিহাসের পরম্পরায় আওয়ামী লীগকে এ নির্মোহ নেতৃত্বকে পুরোপুরিভাবে ধারণ করে সামনে এগোতে হবে, এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে কার্পণ্য করলে হবে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, জাতীয় চার নেতাসহ যাঁরা আবহমান বাংলার চিরায়ত সত্তা বিনির্মাণে ত্যাগ, রক্ত ও জীবন উৎসর্গ করেছেন, তাদের এ অবিনাশী চেতনা স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের অনুপ্রেরণার মূল অনুঘটক হিসেবে নিতে হবে।
দুই.
স্মার্ট বাংলাদেশের স্মাট নেতৃত্ব দিতে হলে স্মার্ট লিডারশিপ দরকার। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ বিনির্মাণে চারটি স্তম্ভ ঠিক করে দিয়েছেন- স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি এবং স্মার্ট গভর্নমেন্ট। আগামী নির্বাচনে এ স্তম্ভের ওপর ভিত্তি করেই নির্বাচনের মনোনয়ন দিতে হবে। কে স্মার্ট বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিতে পারবে এবং কে পারবে না তা পরিপূর্ণভাবে নির্ণয় করেই প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা মনোনয়ন দিবেন- এমনটাই তিনি বার বার উল্লেখ করে নির্দেশনা দিচ্ছেন। এই স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখায়ই অনেক এমপি-মন্ত্রীর কপাল পুড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ স্মার্ট বাংলাদেশের জন্য দরকার স্মার্ট লিডারশিপ, কিন্তু অনেক এমপি-মন্ত্রীরা বাংলাদেশের এ নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য নিজেদেরকে উপযোগী করে তুলেননি। তাই তাদের এমন অগ্নিপরীক্ষায় পড়তে হচ্ছে। এক্ষেত্রে স্মার্ট নেতৃত্বেও জন্য ক্লিন ইমেজের প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে হবে।
তিন.
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে অনেক ত্যাগী ও জনপ্রিয় নেতা আছেন যাঁরা অভিমান করে বসে আছেন, আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর চেতনা বুকে ধারণ করে নির্মোহভাবে অপেক্ষা করছেন, বিশ্বস্ততার বলয় ভাঙেননি, তাদেরকে দলে অন্তর্ভুক্ত করে দলকে আরো শক্তিশালী করত হবে। এক্ষেত্রে যাঁর নাম অগ্রভাগে আসে তিনি হলেন সোহেল তাজ। তাকে স্মার্ট বাংলাদেশের অংশীজন করলে দেশ উপকৃত হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
চার.
অভিজ্ঞ ও প্রবীণ রাজনীতির সঙ্গে মেধা ও তারুণ্যনির্ভর রাজনীতির সমন্বয় ঘটাতে হবে। অগ্রাধিকার দিতে হবে সৎ, নির্মোহ, ক্লিন ইমেজের প্রার্থীকে, মেধা-মননশীলতা-তারুণ্যদীপ্ত নেতৃত্ব বিকশিত করতে এখন থেকেই রাজনীতিতে নান্দনিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে, গণমানুষের আকাক্সক্ষা পূরণে সদা সোচ্চার থাকবে এমন নেতৃত্ব নির্মোহভাবে বাছাই করতে হবে।
পাঁচ.
রাজনীতিকে কখনোই টাকা কামানোর হাতিয়ার বানানো যাবে না। কাজেই যারা দুর্নীতিবাজ এমন এমপি-মন্ত্রীদের বাদ দিতে হবে। দেশের স্মার্ট ইকোনমি বিনির্মাণে দুর্নীতি উপরে ফেলতে হবে। এজন্য কালো টাকার মালিক, দুর্নীতিবাজ ও ব্যবসায়ীদের রাজনীতি থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে। রাজনীতিকে অবশ্যই সৎ ও আদর্শবান রাজনীতিকদের হাতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
ছয়.
রাজনীতিতে স্থানীয় প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে হবে। তৃণমূল কখনো শেকড়হীন প্রার্থীদের গ্রহণ করে না। যেসব প্রার্থীদের শেকড় নড়বড়ে তারা কখনোই প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনে জিততে পারবে না। প্রার্থীদের শেকড় যাচাই-বাছাইয়ে ঐতিহাসিক পরম্পরার দিকটি অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে।
সাত.
প্রত্যেকটি আসনে ডজন ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর তালিকা হতে পারে না। এমন দেখা যাচ্ছে রাজনীতিতে নেমেই অনেকেই মনোনয়ন চাচ্ছেন। কিন্তু জাতীয় সংসদের মতো আইন প্রণয়নের পরিকাঠামোর মধ্যে অবশ্যই অভিজ্ঞ ও যোগ্যদের বেছে নিতে হবে। ডজন ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অবশ্যই কঠোরভাবে সাবধান করে দিতে হবে, বলে দিতে হবে- আগে রাজনীতিতে পরিপক্কতা অর্জন করে মনোনয়ন নিতে আসেন। ডজন ডজন মনোনয়নপ্রত্যাশী হয়ে কোনোভাবেই তৃণমূলকে বিভক্ত করা যাবে না।
আট.
আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগ। অনেক সময় দেখা গেছে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নিজেও হেরেছে এবং দলীয় প্রার্থীকে হারিয়েছে। তাছাড়া দলীয় প্রার্থীকে হারানো জন্য বিরোধীদের পক্ষেও কাজ করছে অনেকেই- এমন ইতিহাস আওয়ামী লীগের অনেক নেতৃবৃন্দের মধ্যে আছে। কাজেই আওয়ামী লীগ আওয়ামী লীগের শত্রু এমন অপবাদ ঘোচাতে হবে।
নয়.
ব্যক্তি ইমেজ দ্বারা সাধারণ মানুষের কাছে যেতে পারবেন, তাদের আকৃষ্ট করতে পারবেন এবং তাদের ভোট নিজের পক্ষে নিতে পারবেন- এমন প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে হবে। শুধু প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা দিয়ে মনোনয়ন চাবেন- তা কোনোক্রমেই হতে পারে না। প্রার্থীর নিজ আসনে অবশ্যই তার নিজের জনপ্রিয়তা থাকতে হবে, জনসম্পৃক্ততা থাকতে হবে; নিজের ব্যক্তিত্ব ও ভালোবাসা দিয়ে সাধারণ মানুষের মন জয় করা নেতাকে মনোনয়ন দিতে হবে।
দশ.
আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ ছোট দলগুলোকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে ছোট দলগুলোকে কিছু আসন দিতে হবে। তবে এ আসনসংখ্যা কত হবে তা বিচার-বিশ্লেষণ নির্ধারণ করতে হবে। এছাড়া আরো একটি কৌশল নেওয়া যেতে পারে- ছোট ছোট দলগুলোকে স্থানীয় নির্বাচনে মেয়র, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান এবং ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচনে ছাড় দিয়ে তাদেরকে সুযোগ দেওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে ছোট দলগুলো স্থানীয় নেতৃত্বের সুযোগ পাবে, বিনিময়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের জেতানোর ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করতে পারবে।
আগামী দ্বাদশ নির্বাচন জাতির জন্য বড় একটি চ্যালেঞ্জ। সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বড় বাধা রয়েছে, দেশ-বিদেশে নির্বাচন বানচাল করার জন্য অব্যাহতভাবে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চলছে। এ চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ আবারও সাধারণ মানুষের ভোটে নির্বাচিত হয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ করবে- এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক