লক্ষ্মীপুর জেলার ৪ টি সংসদীয় আসনে নৌকার মাঝি হতে দলীয় মনোয়নপত্র সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন ৩৩ জন। এরা আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। এদের তালিকায় বর্তমান সংসদ সদস্য আছেন দুইজন। সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য আছেন একজন, সাবেক সংরক্ষিত নারী সদস্যও একজন আছেন।
এতে কেন্দ্রীয়, জেলা ও উপজেলা আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠের হেভিওয়েট নেতারাও রয়েছেন। মঙ্গলবার (২১ নভেম্বর) বিকেল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ধানমন্ডি কার্যালয় থেকে লক্ষ্মীপুরের ৩৩ নেতা মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন।
নৌকায় ছড়তে এসব নেতারা অবস্থান করছেন ঢাকায়। এদের মধ্যে কেউ কেউ গত একবছর ধরে এলাকায় প্রচার-প্রচারণাসহ নেতাকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। আবার কেউ ছিলেন একেবারে নিষ্ক্রিয়। তফসিল ঘোষণার পর হয়েছেন সক্রিয়। আবার একাধিক মনোনয়ন প্রত্যাশী রয়েছেন, যারা এ জেলার বাসিন্দা নন।
তবে তৃণমূল নেতাকর্মীরা চাচ্ছেন, দলের ত্যাগী, কর্মীবান্ধব এবং একনিষ্ঠ নেতাকে দেওয়া হোক দলীয় মনোনয়ন। বিশেষ করে হাইব্রিড এবং অন্য জেলার বাসিন্দাদের মনোনয়ন দেওয়া বিষয়ে আপত্তি রয়েছে লক্ষ্মীপুর-৪ আসনের দলীয় নেতাকর্মীদের।
লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) : এ আসন থেকে ১০ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। তারা হলেন বর্তমান এমপি রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আনোয়ার হোসেন খান, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সফিকুল ইসলাম, রামগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র আবুল খায়ের পাটওয়ারী, রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শফিক মাহমুদ পিন্টু, কেন্দ্রীয় যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য হাবিবুর রহমান পবন, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক এমএ মমিন পাটওয়ারী, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শহীদ উল্যাহ, রামগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি শামছুল হক মিজান, সাবেক কর কমিশনার সুলতান মাহমুদ ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ব্যারিস্টার তৌহিদুল ইসলাম বাহার।
এদের মধ্যে অনেকেই বিগত সময়ে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিজেদের সম্পৃক্ত রেখেছেন৷ নিজ নিজ সমর্থমকদের নিয়ে পৃথক পৃথক সভা সমাবেশ পালন করতেন তারা। তবে অন্তঃকোন্দল ছিল দৃশ্যমান। বিভক্তি রয়েছে দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝেও।
লক্ষ্মীপুর-২ (রায়পুর ও সদরের একাংশ) : এ আসন থেকে ৬ জন আওয়ামী লীগের মনোয়নপত্র সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। বর্তমান এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরউদ্দিন চৌধুরী নয়ন, আমরা ক'জন মুজিব সেনার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এএফ জসিম উদ্দিন আহমেদ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. এহসানুল কবীর জগলুল, কেন্দ্রীয় যুবলীগের উপ পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক শামছুল ইসলাম পাটওয়ারী, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক উপকমিটির সদস্য নেওয়াজ শরীফ ও সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলাম এ আসনে নৌকা নিয়ে লড়তে চান।
বর্তমান সংসদ সদস্য নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়ন সুসংগঠিত রেখেছেন তৃণমূল নেতাকর্মীদের। কাজী শহিদ ইসলাম পাপুলের সংসদ সদস্য পদ বাতিলের পর ২০২১ সালের ২১ জুন অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে নৌকা নিয়ে জয়ী হন নয়ন। আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী সাবেক ছাত্রনেতা এএফ জসিম উদ্দিন দলীয় কর্মাকাণ্ডে তেমন একটা সম্পৃক্ত না থাকলেও সামাজিক কর্মকাণ্ড পালন করতেন রীতিমতো। শামছুল ইসলাম পাটওয়ারীকে মাঝেমধ্যে দলীয় কর্মকাণ্ডে দেখা গেলেও ডা. এহসানুল কবীর জগলুলকে দলীয় কর্মকাণ্ডে দেখা যেত না। অপরিচিত মুখ হলেন নেওয়াজ শরীফ। আর সেলিনা ইসলাম আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য এবং মানব ও অর্থ পাচারের দায়ে কুয়েতের কারাগারে বন্দি থাকা কাজী শহীদ ইসলাম পাপুলের স্ত্রী। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে পাপুল এমপি হওয়ার পর সেলিনা ইসলাম হয়েছেন স্বতন্ত্র কৌটায় সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য। পাপুল কারাগারে যাবার পর সেলিনা ইসলামের দেখা মেলেনি লক্ষ্মীপুরে। তফসিল ঘোষণার পর তিনি এখন নৌকার মাঝি হতে চাচ্ছেন।
লক্ষ্মীপুর-৩ (সদর) : এ আসন থেকে ১০ জন আওয়ামী লীগের মনোয়নপত্র সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। এর হলেন বর্তমান এমপি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম ফারুক পিংকু, ঢাকার মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের এমএ সাত্তার, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য এমএ হাসেম, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপকমিটির সদস্য খোকন চন্দ্র পাল, জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি নুরুল হুদা পাটওয়ারী, সাবেক এমপি প্রয়াত একেএম শাহজাহান কামালের স্ত্রী ফেরদৌসী কামাল, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক শিল্প বিষয়ক সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য শওকত হায়াত, জেলা সেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি বেলায়েত হোসেন বেলাল ও চন্দ্রগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আইনুল আহমেদ তানভীর।
এ আসনের উল্লেখ যোগ্য প্রার্থী হলেন, গোলাম ফারুক পিংকু, এমএ হাসেম, এমএ সাত্তার। গোলাম ফারুক পিংকু সদ্য অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তবে সংসদে যাবার সুযোগ হয়নি তার। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কয়েক ঘণ্টা আগে তিনি এমপি হিসেবে শপথ নেন৷ এ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এমএ হাশেম ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে বিএনপি প্রার্থীর কাছে হেরে যান। নির্বাচনের পর জেলার রাজনীতিতে কখনো দেখা যায়নি তাকে। দূরত্ব রয়েছে তৃণমূলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ লোকজনের সাথে। আরেক মনোনয়ন প্রত্যাশী এমএ সাত্তার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নিজ বলয়ের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। সামাজিক কাজও করেছেন তিনি। জেলার রাজনীতিতে তাকে তেমন একটা দেখা যায়না।
লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর): এ আসন থেকে ৭ জন আওয়ামী লীগের মনোয়নপত্র সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন। এরা হলেন আওয়ামী লীগের কৃষি বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও সাবেক এমপি আব্দুল্লাহ আল মামুন, রামগতি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াহেদ, ঢাকা উত্তর যুবলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক তাসবীরুল হক অনু, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপকমিটির সদস্য ইস্কান্দার মির্জা শামীম, কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া বিষয়ক উপকমিটির সদস্য আব্দুজ্জাহের সাজু ও আওয়ামী লীগ নেতা শরীফ উদ্দিন।
এরমধ্যে ফরিদুন্নাহার লাইলী আসনটির সাবেক সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য ছিলেন। তবে এ জেলার বাসিন্দা নন তিনি৷ বিগত সময়ে দলীয় কর্মকাণ্ডে তার সরব উপস্থিতি ছিল। আব্দুল্লাহ আল মামুন ছিলেন এ আসনের সাবেক এমপি। এলাকায় নিজের উপস্থিতি কম থাকলেও মাঝেমধ্যে অনুষ্ঠিত দলীয় পোগ্রামে তার উপস্থিতি ছিল। তাসবীরুল হক অনু রামগতির বাসিন্দা হলেও রাজনীতি ছিল রাজধানী কেন্দ্রীক। উপজেলার রাজনীতিতে অনেকটা অনুপস্থিতি ছিল তার। তবে রামগতিতে নিজস্ব কিছু কর্মী সমর্থক রয়েছে এ নেতার। আব্দুল ওয়াহেদ উপজেলা আওয়ামী লীগের পদে থাকার সুবাদে দলীয় কর্মকাণ্ডে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখতেন। আর ইস্কান্দার মির্জা শামীমের বাড়ি নোয়াখালী হলেও পড়ালেখার সুবাদে ছাত্রজীবন কেটেছে রামগতিতে। গত দেড় থেকে দুই বছর ধরে পদচারণা ও প্রচারণা চালিয়েছেন কমলনগর-রামগতিতে। দান অনুদান করে প্রচার করছেন তিনি। এটাকে পুঁজি করে এ আসন থেকে নৌকা নিয়ে নির্বাচন করতে চান এ ঠিকাদার। যদিও এ আসনের রাজনীতিতে কোন ভূমিকা নেই তার। এ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য বিকল্প ধারার মহাসচিব মেজর (অবঃ) আবদুল মান্নান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের হয়ে প্রার্থী হয়েছেন তিনি। ফলে আওয়ামী লীগ তখন কোন প্রার্থী দেয়নি। এমএ মান্নানের বাড়ি পাশ্ববর্তী জেলা নোয়াখালীতে। নানার বাড়ি লক্ষ্মীপুরের রামগতিতে।
এদিকে নির্বাচনে অংশ নিতে জাতীয় পার্টির নেতারাও মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। বুধবারের তথ্য অনুযায়ী লক্ষ্মীপুর-১ আসন থেকে লাঙ্গল প্রতীক পেতে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি মাহমুদুর রহমান মাহমুদ। লক্ষ্মীপুর-২ আসন থেকে সংগ্রহ করেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য বোরহান উদ্দিন মিঠু ও শেখ ফয়েজ উল্যা জিসান। লক্ষ্মীপুর-৩ আসন থেকে জেলা জাতীয় পার্টির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রাকিব হোসেন মনোনয়ন পত্র সংগ্রহ করে জমা দিয়েছেন।