শনিবার ৫ জুলাই ২০২৫ ২১ আষাঢ় ১৪৩২
শনিবার ৫ জুলাই ২০২৫
রাজনীতিও একটি শিল্প, তবে সহজ শিল্প নয়
ড. আব্দুল ওয়াদুদ
প্রকাশ: সোমবার, ২৭ নভেম্বর, ২০২৩, ৩:৫৫ PM
নির্বাচনি উৎসবের আমেজে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের জন্য ৩ হাজার ৩৬২টি ফরম বিক্রি করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এতে দলটির আয় হয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখ টাকা। ৩০০ আসনের বিপরীতে প্রতিটিতে গড়ে ১১ জনের বেশি মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন ক্ষমতাসীন দলে। দলের নেতা, মন্ত্রী, এমপি ছাড়াও শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক, চলচ্চিত্র ও ক্রীড়াঙ্গনের জনপ্রিয় তারকাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ফরম কিনেছেন। গত নির্বাচনে ৪ হাজার ২৩টি ফরম বিক্রি করেছিল আওয়ামী লীগ। সারা দেশের ৩০০ আসনে প্রতিটির জন্য গত নির্বাচনে প্রায় ১৩ জন করে প্রার্থী ছিলেন। এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মোট ২ হাজার ৬০৮ জন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম কিনেছিলেন।

প্রশ্ন হলো মনোনয়নপ্রত্যাশী সবাই কেন এমপি হতে চান? আগ্রহীরা এই প্রশ্নের জবাবে গণমাধ্যমকে বলেছেন, তারা জনসেবা ও দেশের জন্য কাজ করতে চান। তাহলে বিষয়টা কি এমন যে, এমপি না হয়ে জনসেবা বা দেশের জন্য কাজ করা যায় না? নাকি এমপি ছাড়া অন্য কেউ জনসেবা বা দেশের জন্য কাজ করেন না? সংসদ সদস্যের সংখ্যা সর্বমোট সাড়ে ৩০০, যা দেশের মোট জনসেবকের তুলনায় অতি সামান্য। এক্ষেত্রে যারা এমপি নন, তারা কীভাবে জনসেবা করছেন? প্রত্যেকেই তার নিজের জায়গা থেকে জনসেবা করতে পারেন। প্রত্যেকে যদি নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজনের ও পাড়াপ্রতিবেশীর সেবাটুকুও ঠিকমতো করেন, তাহলেই তো দেশ বদলে যাওয়ার কথা!

সংবিধানের বর্তমান বিধান অনুযায়ী সরাসরি ৩০০ জন এবং সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর প্রাপ্ত আসনের আনুপাতিক হারে বাকি ৫০টি সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। নিশ্চিত লাভের আশায় প্রায় সবাই দৌড়াচ্ছেন । ব্যানার, পোস্টার আর ফেস্টুনে অপরূপ সেজেছে নির্বাচনি এলাকা। সারা বছর জনবিচ্ছিন্ন নেতারাও এখন জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছেন ত্রাণ। এলাকার মসজিদ ও মন্দিরে গিয়ে লোক দেখানো দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে চলছেন। অনলাইন পত্রিকা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক অনেককে ইতিমধ্যে প্রায় এমপি বানিয়ে ফেলেছে। তবে জনগণের মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, সবাই কেন এমপি হতে চাইছেন?

আগে শুধু রাজনীতিবিদরা এমপি হতে চাইতেন দেশের সেবা করার জন্য। নিজেদের পকেটের পয়সা শেষ হলে বাপ-দাদার জমিজমা বিক্রি করে সবাই রাজনীতি করতেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ডাক্তার এস এ মালেক থেকে শুরু করে একানব্বই সাল পর্যন্ত সবাই রাজনীতিকে সেবামূলক কাজ মনে করতেন। একানব্বই সাল থেকে এ দেশের সংসদীয় রাজনীতিতে বিপুলসংখ্যক ব্যবসায়ীর প্রবেশ শুরু হয়। বিএনপি নিজেদের সুবিধার্থে ব্যাবসায়ীদের ঢালাওভাবে মনোনয়ন প্রদান করে এবং তারা নির্বাচনে জয়লাভ করে মহান জাতীয় সংসদের সদস্য হয়ে যান। তারপর থেকেই ব্যবসায়ীদের দখলে মহান জাতীয় সংসদের বেশির ভাগ সদস্যপদ।
একানব্বই সালের নির্বাচনের পর থেকে কোনো সংসদীয় আসন খালি হলে সবাই হামলে পড়ছেন দলীয় মনোনয়ন পেতে। সাবেক এমপির স্ত্রী, স্বামী, পুত্র, কন্যা, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাগনে, শ্যালক, শ্যালিকা, পিএস, এপিএস, ড্রাইভার সবাই দলীয় মনোনয়ন পেতে লেগে পড়েন। এমপি হওয়ার তালিকায় হারিয়ে গেছেন রাজপথের পোড় খাওয়া নেতাকর্মীরা। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মহান জাতীয় সংসদ পরিণত হবে রাজনীতি সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা না থাকা ব্যবসায়ীদের ক্লাবে, যারা শুধু লাভ-ক্ষতির হিসাব বোঝেন।

সংসদের অধিবেশনে নতুন নতুন আইনের পরিবর্তে তৈরি হবে ব্যাবসায়িক নীতিমালা, পরিণত হবে পারিবারিক আড্ডাখানায়। সংসদ সদস্য পদকে এখনই অলাভজনক পদ বা সেবামূলক পদ হিসেবে গড়ে না তুললে দেশের সবাই এমপি হতে চাইবে।

এমপি মানে মেম্বার অব পার্লামেন্ট; বাংলায় সংসদ সদস্য, যার মূল কাজ আইন প্রণয়ন করা। সুতরাং আইনকানুন বোঝেন বা বোঝার মতো জ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান আছে, এমন ব্যক্তিরাই এমপি হবেন—এটিই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী এমপি হওয়ার জন্য তার আইনকানুন বোঝা তো দূরে থাক, ন্যূনতম পড়ালেখা জানাও শর্ত নয়। বয়সের সীমারেখা থাকলেও শিক্ষাদীক্ষা একজন নাগরিকের সংসদ সদস্য হওয়ার পথে কোনো বাধা নয়, শর্ত নয়। সেক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি বহুদিন ধরেই একাডেমিক পরিসরে আছে সেটি হলো, পড়ালেখা না জানা মানুষ যখন আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়ার ভেতরে ঢুকে যান; বিশেষ করে সংশ্নিষ্ট মন্ত্রী আইনের খসড়া (বিল) সংসদে উত্থাপনের পরে স্পিকার যখন সেটি পরীক্ষানিরীক্ষার জন্য সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠান, সেখানে ঐ এমপিরা কী ভূমিকা পালন করতে পারেন? ঐ বিলের ওপরে কমিটির প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপনের পর বিলের ওপরে যে আলোচনা হয়, সেখানেই-বা তারা কী ভূমিকা রাখতে পারেন? তাদের কাজ কি শুধু ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলা?

স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে যখন সংবিধান প্রণয়ন করা হয়, তখন সংবিধান প্রণেতারা এমপি হওয়ার শর্তের মধ্যে শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি কেন রাখেননি, সেটি বোঝা যায়। কারণ তখন দেশে শিক্ষার হার ছিল যথেষ্ট কম এবং ঐ সময়ে যারা রাজনীতি করতেন, তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতেন। সেখানে তাদের ব্যক্তি ইমেজ, মানুষের জন্য কাজ করা, তাদের বিপদ-আপদে পাশে থাকা, সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে যুক্ত থাকা; সর্বোপরি পারিবারিক পরিচিতিই ছিল মুখ্য। কিন্তু গত অর্ধশতকে চিত্র পালটে গেছে।

সুতরাং পরিবর্তনের সূচনা এখনই করা দরকার। সংসদের আগামী অধিবেশনেই যে সংবিধান সংশোধন করে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে, তা নয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে একাডেমিক পরিসরে তো বটেই, রাজনীতিবিদদের মধ্যে, এমনকি সংসদেও আলোচনার সূত্রপাত হওয়া দরকার। দেশ যেহেতু নানা খাতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং দিন শেষে রাজনীতিবিদরাই যেহেতু দেশ পরিচালনার মূল দায়িত্বটি পালন করেন, সেই বাস্তবতা মাথায় রেখে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোয় না হলেও অন্তত সংসদ সদস্য হওয়ার জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার একটি শর্ত সংবিধানে থাকা উচিত বলে মনে হয়।

রাজনীতিতে নেতার অপরিহার্যতা অনস্বীকার্য। কাউকে না কাউকে তো নেতা হতেই হবে। কিন্তু সে নেতা হওয়ার প্রক্রিয়াটি কি খুব সহজ? আমাদের এই উপমহাদেশের রাজনীতির দিকে চোখ ফেরালেই এ সত্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, এযাবৎ যারা নেতা হিসেবে সমাদৃত হয়েছেন, তারা গাছে পোস্টার-ফেস্টুন ঝুলিয়ে বা নেতার পেছনে দাঁড়িয়ে টিভি-ক্যামেরায় মস্তক দেখিয়ে ঐ মর্যাদার আসনে আসীন হননি। এজন্য তাদেরকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে, জীবনের সোনালি সময়কে ব্যয় করতে হয়েছে। বাস করতে হয়েছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী—তারা কেউই হঠাৎ করে নেতা বনে যাননি। রাজনীতির মাঠে পদচারণার শুরুতে তারা কর্মীই ছিলেন।

মহাত্মা গান্ধী পেশাজীবনের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের দুর্দশা দেখে প্রতিবাদী ভূমিকায় নেমেছিলেন। সে কারণে তাকে জেল খাটতে হয়েছিল। এমনকি শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তার জীবন সংকটাপন্ন হয়েছিল। মওলানা ভাসানী তরুণ বয়সে জমিদারের শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে এলাকা থেকে বিতাড়িত হয়ে আসামে চলে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। টুঙ্গিপাড়ার সাহসী ও দুরন্ত ছেলে শেখ মুজিবুর রহমান গাছে পোস্টার ঝুলিয়ে কিংবা বড়নেতার পেছনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে ‘বঙ্গবন্ধু’ হননি। এজন্য তাকে পার হতে হয়েছে অনেক দুর্গম পথ। জীবনের তেরোটি বছর কাটাতে হয়েছে পরিবার-স্বজনহীন অবস্থায় কারান্তরালে। কোনো কোনো সময় মৃত্যু তার খুব কাছাকাছি চলে এসেছিল। কিন্তু তিনি তার জীবনের ব্রত থেকে সরে যাননি এতটুকু। কিন্তু আজ কষ্ট করে নেতার পর্যায়ে যেতে কেউ আগ্রহী নন। তারা নেতা হতে চান ঠিকই, তবে আপন কর্মের ফলে নয়।

একটি আসন থেকে এক জনের বেশি ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া সম্ভব নয়। মনোনয়ন না পেয়ে রাতারাতি গিরগিটির মতো রং পালটে দলের বিরুদ্ধ আচরণ করতেও কুণ্ঠিত হন না অনেক বসন্তের কোকিল সুবিধাবাদী নেতা। এমপি হওয়াটাই শেষ কথা নয়। এমপি না হয়েও জনসেবা করা যায়, মানুষের কল্যাণে কাজ করা যায়। নেলসন ম্যান্ডেলা মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘সুসময়ে নেপথ্যে থেকে অন্যদের সুযোগ করে দেওয়া উত্তম এবং দুঃসময়ে সামনে এসে নেতৃত্বের হাল ধরলে জনগণের বেশি প্রশংসা ও আস্থা অর্জন করা যায়।’

পৃথিবীতে সবকিছুই শিখতে হয়, জানতে হয় এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে অনুশীলন করতে হয়। রাজনীতিও আকৈশোর সচেতনভাবে মানসিক ও ব্যাবহারিকভাবে অর্থাৎ বিশ্বাসে, কর্মে, আচরণে, অনুশীলনের মাধ্যমে শিখতে হয়। একজন রাজনীতিবিদকে জনদরদে, জনপ্রিয়তায়, উপচিকীর্ষার উপায় ও পন্থা উদ্ভাবনে মনোযোগী, দক্ষ, নিপুণ, সুরুচিপূর্ণ, সময়সচেতন, দেশপ্রেমী ও মানবসেবী হতে হয়। রাজনীতি একটি শিল্প। এত সহজ নয় এ শিল্প।

রাজনীতি হওয়া উচিত মানুষ ও সমাজসেবার ব্রত। রাজনীতি বৃহত্তর পরিসরে মহত্তর কাজ। রাজনীতি হলো ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী, দেশ তথা বিশ্বের কল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করা। আমরা নতুন করে বাঁচতে শিখি। পুরোনো ও পশ্চাৎপদ ধ্যানধারণাকে পেছনে ফেলে নতুন আলোর পথে অগ্রসর হই। প্রগতির রাজনীতি, প্রগতির সংস্কৃতিচর্চা হোক শব্দময়, আলোকিত ও প্রকাশ্য। আজ গোটা দেশের যে অস্থির রাজনৈতিক আবহ, তাতে এটুকুই চাওয়া।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও প্রেসিডিয়াম সদস্য, বঙ্গবন্ধু পরিষদ

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত