শনিবার ৫ জুলাই ২০২৫ ২১ আষাঢ় ১৪৩২
শনিবার ৫ জুলাই ২০২৫
পৃথিবীর স্তর নিয়ে বিজ্ঞানীদের চিন্তা-ভাবনা
প্রদীপ সাহা
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৩, ৫:১৪ PM
আমরা জানি যে, আমাদের পৃথিবী পেঁয়াজের মতো অনেকগুলো স্তর দিয়ে গঠিত। আর শুধুমাত্র প্রথম স্তরেই প্রাণের অস্তিত্ব আছে। এই প্রথম স্তরকে বলা হয় ‘ক্রাস্ট’ বা ‘ভূ-ত্বক’। এই স্তরে রয়েছে গুহা বা গর্তে ছোট আকারের নিশাচর প্রাণী। এর চেয়ে গভীরে গেলে পাওয়া যাবে ‘নাইল ক্রোকোডাইল’ নামে এক ধরনের কুমির। এরা মাটির নিচে ১২ মিটার গভীর গর্ত বা গুহায় থাকতে পারে। এই প্রথম স্তরে রয়েছে বেশ কিছু প্রাচীন ভূগর্ভস্থ শহর।

যেমন তুরস্কের এলেনগুবু (বর্তমানে এ শহরটি ডেরিনকুয়ু নামে পরিচিত)। এটি ভূ-ত্বক থেকে ৮৫ মিটারের বেশি গভীরে অবস্থিত। ১৮টি স্তরের টানেল দিয়ে নির্মিত গোলক ধাঁধাঁর মতো বিস্তৃত এ শহরটিতে ২০ হাজারের বেশি মানুষ ধারণের ক্ষমতা ছিল। ধারণা করা হয় যে, খ্রিস্টপূর্ব ৩৭০ সালে এ শহরটি গড়ে তোলা হয়েছিল। এরপর হাজার হাজার বছর ধরে এটি ক্রমাগতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে গভীরতম খনি চার কিলোমিটার পর্যন্ত গভীর। দক্ষিণ আফ্রিকার স্বর্ণখনির শ্রমিকরা মাটির দু’কিলোমিটার গভীরে জীবন্ত কীট খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু তিন কিলোমিটার গভীরতার পর আর কোনো প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। এছাড়াও রয়েছে ‘কোলা’ নামে রাশিয়ায় খনন করা বিশ্বের গভীরতম কূপ। অনেকে একে ‘নরকের দ্বার’ বলে মনে করে। স্থানীয়রা দাবি করে, এখানে তারা নির্যাতিত আত্মার চিৎকার শুনতে পায়। ৩০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গভীরে গিয়ে আমরা আরেকটি স্তর দেখতে পাই। যাকে বলা হয় ‘ম্যান্টল’ বা ‘বিচ্ছুরিত স্তর’। এটি আমাদের গ্রহের সবচেয়ে বড় অঞ্চল। এটি পৃথিবীর আয়তনের ৮২ ভাগ এবং ভরের ৬৫ ভাগ জুড়ে বিস্তৃত। এটি উত্তপ্ত শিলা দিয়ে গঠিত, যা আমাদের কাছে কঠিন মনে হলেও খুব ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়। জানা যায়, বছরে এটি মাত্র কয়েক সেন্টিমিটার স্থান পরিবর্তন করে। 

মাটির নিচের এই খুব ছোট পরিবর্তন পৃথিবীর উপরিভাগ বা ভূ-ত্বকে ভূমিক¤েপর সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়াও রয়েছে একটি উজ্জ্বল সাগর। এ সাগর এত বিশাল যে, পুরো পৃথিবীর সব সাগরের পানি ধারণ করার ক্ষমতা রয়েছে এখানে। এতে এক ফোটাও তরল নেই। বরং এটি খনিজ অলিভাইনে জমে থাকা পানির সমন্বয়ে গঠিত। ম্যান্টল বা বিচ্ছুরিত স্তরের উপরিভাগের ৫০ ভাগই এটি দিয়ে গঠিত। আরও গভীরভাবে বলা যায়, এটি আকাশী-নীল রঙের ম্যাগনেসিয়াম সিলিকেটের স্ফটিকে পরিণত হয়। এটি একটি ঘূর্ণায়মান জায়গা, যেটি ক্যালিডোস্কোপের স্ফটিকের মতো বস্তু রয়েছে। এখানে শিলা প্লাস্টিকের মতো নমনীয়। খনিজগুলো এতটাই বিরল যে, সেগুলো পৃথিবীর উপরিভাগে কোনো অস্তিত্বই নেই। প্রকৃতপক্ষে সেখানে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় থাকা ‘ব্রিজম্যানাইট’ এবং ‘ডেভমাওইট’ নামে খনিজগুলো গঠিত হওয়ার জন্য ভূ-অভ্যন্তরের অতি উচ্চ চাপের দরকার হয়। এগুলো পৃথিবীর উপরিভাগে উঠিয়ে নিয়ে আসা হলে ভেঙ্গে পড়বে। আর ২ হাজার ৯০০ কিলোমিটার গভীরে পৌঁছানোর পর আমরা ম্যান্টল বা বিচ্ছুরিত স্তরের শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পারব।  
 
‘লার্জ লো শিয়ার ভেলোসিটি প্রভিন্স’ বা ‘এলএলএসভিপি’ হাজার হাজার কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। পৃথিবীর আয়তনের ৬ ভাগ এগুলো দিয়ে গঠিত। এগুলোর অবশ্য আরও নাম রয়েছে। যেমনÑ ‘টুজো’ আফ্রিকা অঞ্চলের নিচে অবস্থিত এবং ‘জেসন’ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিচে অবস্থিত। এগুলোর উচ্চতা কতÑ তা নিয়ে আলাদা ধারণা প্রচলিত রয়েছে। তবে ‘টুজো’ ৮০০ কিলোমিটার উঁচু বলে মনে করা হয়। অর্থাৎ ৯০টি হিমালয় পর্বতকে পর¯পরের ওপর বসালে যে উচ্চতা হবে, এটি তার সমান। ‘জেসন’-এর উচ্চতা ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার। অর্থাৎ এটি প্রায় ২০৩টি এভারেস্ট পর্বতের মিলিত উচ্চতার সমান। তবে এগুলোর আয়তন কত বড়, সেই তথ্য ছাড়া এগুলো নিয়ে আর তেমন নিশ্চিত কিছু জানা যায়নি। অর্থাৎ এগুলো কীভাবে গঠিত হয়েছে, এগুলো কী দিয়ে তৈরি, এগুলো কীভাবে আমাদের গ্রহকে প্রভাবিত করে এসব কোনো কিছুই জানা সম্ভব হয়নি। 

জুল ভার্ন-এর ক্লাসিক উপন্যাসে অধ্যাপক লিডেনব্রক পুরো একটি আলাদা ভূগর্ভস্থ দুনিয়ার সন্ধান পান, যার মধ্যে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক সময়ের প্রাণী এবং ভূগর্ভস্থ মহাসাগর। যদিও ডাইনোসর থাকার বিষয়টি একটু অতিরঞ্জিতই ছিল। তারপরও সেখানে গলিত ধাতুর সাগর, যার গরম লাল স্রোত ধীরে ধীরে বয়ে চলেছে। এই চলাচল একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করা, যা ছাড়া পৃথিবীর উপরিভাগে জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। চৌম্বকীয় এই স্তর সূর্যরশ্মির ক্ষতিকর বিকিরণ এবং অন্যান্য উপাদান থেকে রক্ষা করে। এটি না হলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ধ্বংস হয়ে যেতো। 

পরিশেষে চূড়ান্ত স্তরÑ যেটি ‘ইনার কোর’ বা ‘আন্তঃকেন্দ্র’ বলে পরিচিত। এটি এখনো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় রহস্যের বিষয়। এটি কঠিন লোহা ও নিকেলের তৈরি অতি ঘন একটি উত্তপ্ত বল, যার উত্তাপ সূর্যের উপরিভাগের তাপের মতোই ধরা হয়। এটি আকারে চাঁদের চেয়ে কিছুটা ছোট। এর চাপ এতই বেশি যে, এর কারণে ধাতু স্ফটিকে পরিণত হয়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে একটি নিরেট স্তর তৈরি করেছে। এটি এমন একটি স্তর, যেখানে আমরা কখনওই পৌঁছাতে পারব না। এখানকার তাপমাত্রা ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং চাপ ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন অ্যাটমোস্ফিয়ার। এখানকার পরিবেশ এত বেশি রুক্ষ যে, সেখানে কোনো কিছুই টিকতে পারে না। 

ধাতব সাগরে আটকে থাকা এই স্ফটিক জগত অর্থাৎ পৃথিবী আমাদের কাছে সবসময় রহস্যময় ছিল এবং সম্ভবত সবসময় রহস্যই থাকবে। ভূ-পৃষ্ঠ থেকে বিজ্ঞানীরা এটি নিয়ে অনর্গল গবেষণা করছেন। মাঝে মাঝে মনে হয় যে, আরও বেশি তথ্য আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, এগুলো এখনো খুব একটা বোঝা সম্ভব হয়নি। অবশ্য বিজ্ঞান আর কল্পনার আসলে কোনো সীমারেখা নেই।  

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত