মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে তখন। পাকিস্থান সেনাবাহিনীর অত্যাচারে প্রতিদিনই এলাকা ছেড়ে পালাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বাস্তব সত্য কখনো কল্পকাহিনীকেও হার মানায়। বীর মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেনের বীরত্বের স্মৃতি কথা তেমনি অবিশ্বাশ্ব্য মনে হলেও সত্য। নওগাঁ জেলা সদর থেকে ৫৬ ৃকিলোমিটার উত্তরে ভারতের কোল ঘেঁষে ধামইরহাট উপজেলার জন্মস্থান। উমার ইউনিয়নের কাশিয়াডাঙ্গা গ্রামের কৃষকের সন্তান আফজাল হোসেন। তিনি ধামইরহাট উপজেলা পৌর শহরের দক্ষিন চকযদু টিএন্ডটি মহল্লার বাসিন্দা। তবে এখন তিনি ছেলের বাসায় জয়পুরহাট ও মেয়ের বাসা ধামইরহাট দুই জায়গাতেই থাকেন। একাত্তরের যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া লাখো মুক্তি সেনাদের তিনি একজন। ৭১-এর উত্তাল মার্চের কথা। ঢাকা শহরের মতো সারা দেশেই পাক সেনাদের চলছে তান্ডব। নওগাঁর সীমান্ত ঘেঁষা উপজেলা ধামইরহাট তখন এমনই এক তান্ডবময় এলাকা। এলাকার মানুষগুলোর অধিকাংশই তখন সীমান্ত পেড়িয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। সদ্য পাশ করা গ্রাজুয়েট আফজাল হোসেন দাঁড়িয়ে দেখছেন সে দৃশ্য। সীমান্তের ওপাড়ে যদি যেতেই হয়, তবে ফিরে আসব ট্রেনিং নিয়ে। রুখব পাক সেনাদের। কিন্তু ভাবনাটা বাস্তবে রূপ পাবার আগেই ছোট্র বাজারটাতে হানা দিয়েছে পাকিস্তানী বাহিনী। উপায়ন্তর না দেখে বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার দুরে আত্রাই নদীতে লুকিয়ে কাটান সারা দিন। তারপর কাউকে না জানিয়েই যুদ্ধ যাত্রা। মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন (০৯-০১-১৯৪৬ সালে তাঁর জন্ম) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন মুক্তিযোদ্ধা।
তার সংক্ষিপ্ত জীবনী আফজাল হোসেন ১৯৪৬ সালে নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার চকযদু (কাশিয়াডাঙ্গা) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মৃত ফারাজ উদ্দিন মন্ডল। আফজাল হোসেন নওগাঁর করনেশান হাই স্কুল (বর্তমানে নওগাঁ জেলা হাই স্কুল ) থেকে ১৯৬৩ সালে এসএসসি, নওগাঁর বিএমসি কলেজ থেকে ১৯৬৫ সালে আইএসসি এবং নওগাঁ ডিগ্রী কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে বিএসসি পাশ করেন। কিন্তু এলাকার মানুষের সেবা করার কথা চিন্তা করে তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা পেশায় জড়িয়ে পড়েন তিনি মাতৃভুমির স্বাধীনতার জন্যে ছুটে যান মুক্তিযুদ্ধে। তারপর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে প্রথমে ৭নং সেক্টরে বাঙ্গালিপুর কেম্পে ভর্তি হন। প্রাণের ঝুকি নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের জলপাইকুড়ি জেলার মুক্তিবাহিনীর ৭নং সেক্টরে যোগদান করেন। তিনি সেক্টর কমান্ডার রউফের অধীনে যুদ্ধ করেন। বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারন কৃতিত্ব দেখানোর কারনে তাকে নওগাঁর ধামইরহাট, রাঙ্গামাটি, র্ফাশিপাড়া, হিলি, চৌঘাট ডাঙ্গি এলাকার পাকহানার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করান। স্বাধীনতা ঊষালগ্নে বিজয় সুনিশ্চিত করেই তিনি ফিরেন পরিবারের কাছে।
যে ভাবে ট্রেনিং করেন তিনি ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের দিকে প্রথমে পাকিস্থানি সৈনিকের (পাজ্ঞাবি) তাড়া খেয়ে বাড়ি হতে কমপক্ষে ৫ মাইল দুরে আত্রাই নদীতে পানির নিচে মাথা বের করে ডুবে থাকেন। পরদিন বাড়ি ফিরে ধামইরহাট উপজেলার শেষ সীমানা আলতাদিঘীর পূর্ব পাড়ে পালিয়ে যান। তারপর মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য মন স্থির করেন। তারপর ১৯৭১ সালে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পিতা-মাতাকে না বলে বাঙ্গালিপুর ইয়থ ক্যাম্পে ভর্তি হন। পরদিন সেখানে ভর্তি হয় আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তারা হলেন, আব্দুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অনেকেই। সেখানে ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আবুল আজাদ। সেখানে এক মাসের ট্রেনিং দেওয়ার পর ১০০ জনের একটি টিমকে আর্মি ভ্যানে জলপাইগুড়ি অর্মি ক্যাম্পে নিয়ে যায় এবং সেখানে মেজর রেড্ডীর অধীনে ট্রেনিং করেন। জলপাইগুড়ি অর্মি ক্যাম্প থেকে ১৫ দিন পর সবাইকে বিমানে করে দর্জিলিং বিমান ঘাটিতে নিয়ে যায় এবং পরের দিন উত্তর প্রদেশের টান্ডুয়া দেরাদুন নামক স্থানে এক মাস ট্রেনিং হয় মেজর মালহুতরা ও মেজর চোয়ানের অধীনে।
যে ভাবে যুদ্ধ করেন তিনি তার দুঃসাহসী অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে আবার তেজোদীপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। ফিরে যান সেই অগ্নিঝরা দিনে। একের পর এক বলে যান অগ্নিঝরা দিনের স্মৃতির গৌরবময় অধ্যায়। যা আজো তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় একাত্তুরের রনাঙ্গনে। ট্রেনিং শেষে আফজাল হোসেন, আব্দুর রউফ, জয়নাল আবেদীন, আব্দুল কুদ্দুছ, বদিউজ্জামান, শফিউল, ইদ্রিস আলীসহ অন্তত ৫০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধাদের ধামইরহাট এলাকার কালুপাড়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পাঠানো হয় এবং বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। ১০ ডিসেম্বর চৌঘাট ডাঙ্গী নামক স্থানে যুদ্ধের অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আত্রাই নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটু একটু করে শত্রুর অবস্থানের দিকে এগোতে থাকেন। এমন সময় তাঁর মাথার উপর দিয়ে গুলি হচ্ছিল ঠিক তখন তিনি লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ার সময় বাম হাতটি ভাঙ্গে যায় এবং বাম পায়ের হাঁটুর নিচে সামান্য গুলির ছটা লাগে। এখন সেই হাতটি ভালো হলেও আজও বাঁকাই আছে এবং পায়ের গুলির দাগটি এখনও চিহ্ন বহন করে। এভাবে এগোতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত ঐ সময় সামনা সামনি যুদ্ধে শত্রুর একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় তার প্রানের বন্ধ লোকমানের দেহ। একই সময় কয়েকজন পাকিস্থানি সৈনিকও মারা যায়। তার অল্প কিছু দিন পর দেশ স্বাধীনের আভাস শুনতে পান। তখন ছিল ১৪ ডিসেম্বর তার ২দিন পর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিজয়ের কথা জানতে পারেন তিনি। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা ছাড়া দেওয়া হয়নি কোন খেতাব প্রাপ্ত পদবি। ধামইরহাটে পাক বাহিনীর দুর্গে আঘাত হানার পেছনে অসম সাহসী মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে অবিস্বরনীয় ভুমিকা রেখেছেন আফজাল হোসেন। তিনি বর্তমানে নিজ বাড়িতে ও জয়পুরহাটে ছেলের বাড়িতে বসবাস করছেন। যখনই যাকে কাছে পান তখনই বলতে থাকেন ৭১-এ ফেলে আসা সেই অগ্নিঝরা দিনগুলোর কথা। আফজাল হোসেন এখনও বেঁচে আছেন শরীরে যুদ্ধদিনের সেই ক্ষত নিয়ে। বেঁচে আছেন শহীদ লড়াকু সব মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি নিয়ে।