দেশের সব মহল সম্যক অবগত আছেন, নানামুখী সহিংসতা-অরাজকতা-নাশকতাকে পরিপূর্ণ অবজ্ঞা করেই কিছু বিরোধী দল আহূত অবরোধ-হরতাল কর্মসূচিতে দেশব্যাপী গণপরিবহনসহ সবকিছুই প্রায় স্বাভাবিক পর্যায়ে সচল রয়েছে। নির্বাচন ঘিরে বিদেশি থাবার প্রভাব সম্পর্কে সম্মানিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার যে বার্তাটি দিয়েছেন, এতে মনে হয়- কিছু দেশ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অতিমাত্রায় উৎসাহী এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক অপরাজনৈতিক কর্মযজ্ঞে অবাঞ্ছিত-অনাকাক্সিক্ষত হস্তক্ষেপ করছে। হীনস্বার্থ চরিতার্থে দেশগুলোর এমন অপতৎপরতা সচেতন মহলসহ আপামর জনগণের কাছে বিভ্রান্তিমূলক অপচেষ্টা হিসেবে বিবেচ্য। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশপ্রেম-সাহসিকতা-নির্ভীকতার পরিচয় দিয়ে বিজয় অর্জন করেছে। লাল-সবুজ পতাকার প্রিয় মাতৃভূমি কখনো কোনো পরাশক্তির কাছে মাথা নত করেনি এবং ভবিষ্যতেও না করার ব্রত নিয়ে দেশবাসী ঐক্যবদ্ধ। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়’ প্রতিপাদ্য ধারণ করে পররাষ্ট্রনীতির অপূর্ব নিয়ামকের ভিত্তিতে দেশ আত্মমর্যাদা-আত্মনির্ভরশীলতায় পরিপূর্ণ বিশ্বাসী।
বিশ্ব পরিমণ্ডলে অদম্য অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ শুধু উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত নয়; আকাশচুম্বী অগ্রগতি-সমৃদ্ধি অর্জনে উঁচুমাত্রিকতায় মর্যাদাসীন। সব শর্ত পূরণ করে ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে পবিত্র জন্মভূমি। ৩০ লাখ শহীদান, ২ লাখ জননী-জায়া-কন্যার সর্বোচ্চ সম্ভ্রম ত্যাগের অবিনশ্বর অধ্যায় নির্মাণ করে বিশ্ব ইতিহাসে বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপনে অকুতোভয় জাতি দেশের ভবিষ্যৎকে অধিকতর অত্যুজ্জ্বল করার অভিপ্রায়ে অগ্রগণ্য রয়েছে। এই বিজয় মাসে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত পরিপূর্ণ স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার মহৎ উদ্দেশ্যে প্রচণ্ড প্রতিকূলতা সংহার করে মানবসম্পদ-অর্থনৈতিক উন্নয়ন-সামাজিক নিরাপত্তা বিধানসহ প্রতিটি উন্নয়ন সূচকে দেশ ইতোমধ্যেই বলিষ্ঠ সোপান রচনা করেছে। বঙ্গবন্ধুকন্যা ও প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গণতান্ত্রিক-অসাম্প্রদায়িক-মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার রোডম্যাপকে সফল এবং সার্থক বাস্তবায়নে ২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে। সরকারের ধারাবাহিকতা রক্ষায় অনভিপ্রেত কোনো বিচ্যুতি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়।
ইতোমধ্যেই দেশের সব নাগরিক, বিশেষ করে প্রচলিত আইনে বয়স কাঠামোয় যোগ্যতাসম্পন্ন ভোটাররা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে অতিশয় কৌতূহলী প্রণোদনায় উজ্জীবিত। কতিপয় বিরোধী দল বা জোট নির্বাচনে অংশগ্রহণে অনীহা প্রকাশ সত্ত্বেও ইতোমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে নির্বাচনী তফসিল। ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্ধারিত। তফসিলে বর্ণিত কর্মসূচি অনুযায়ী বিভিন্ন দল-জোট প্রার্থী মনোনয়পত্র সংগ্রহ ও জমাদানের বিষয়টি সম্পন্ন করেছে। নিজ নিজ অঞ্চলে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের অত্যন্ত উঁচুমার্গের উৎসবমুখর পরিবেশে ঢাকঢোল পিটিয়ে মনোনয়নপত্র জমাদান দেশবাসীকে অধিকমাত্রায় অনুপ্রাণিত করছে। একদিকে দলের মনোনয়ন ও অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমাদানের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচনের পূর্বাভাস অতিশয় অনুভূত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে ৩০০টি আসনের বিপরীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্রসহ মোট ২ হাজার ৭১৩ প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। তাদের মধ্যে নিবন্ধিত ২৯টি রাজনৈতিক দলের প্রার্থী ১ হাজার ৯৬৬ জন ও ৭৪৭ স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। উল্লেখ্য, পরিসংখ্যান অনুসারে মোট প্রার্থীর এক-চতুর্থাংশই স্বতন্ত্র এবং প্রতি আসনে গড় প্রার্থীর সংখ্যা ৯।
বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক বার্তায় এটিকে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ধরন হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। ওই বার্তায় বলা হয়, ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতীয় নির্বাচনের জন্য বিপুল সংখ্যক প্রার্থী ঘটা করে এবং উৎসবের মধ্য দিয়ে তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। অনেক আগ্রহ এবং উৎসাহ নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে প্রার্থীদের অংশগ্রহণ এখন পর্যন্ত অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রক্রিয়ার একটি বৈশিষ্ট্য- যা নির্বাচন কমিশন এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিএনপির সাবেক ৩৩ সংসদ সদস্যসহ স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে মনোনয়নপত্র জমাদান অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ধরন তুলে ধরে। ১ ডিসেম্বর এডুকেশন রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ (ইআরডিএফবি) আয়োজিত ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা তাদের অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচনকে ত্রুটিপূর্ণ বলা যাবে না। দেশের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দিলে সেটিই হবে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন।’
এটি অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী সুচারুরূপে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য অবাধ, সুষ্ঠু ও জনগণের অংশগ্রহণমূলক যৌক্তিক
ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সরকার গঠনের প্রক্রিয়াই রাজনৈতিক সংস্কৃতির প্রণিধানযোগ্য অনুষঙ্গ। নির্বাচন কমিশন যথার্থ দক্ষতা-যোগ্যতা-নিরপেক্ষতার সক্ষমতায় সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবেÑ এটিই কাম্য। কমিশনের শক্তিমানতাই নির্বাচন পরিচালনার জন্য অন্যতম নিয়ামক। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই চলমান সরকারের অধীন যথাযথ আইনি এখতিয়ারে নির্বাচন অনুষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধি নির্বাচন-সরকার গঠন একটি স্বাভাবিক পরিক্রমা। জনগণের সমর্থনের ওপর পূর্ণাঙ্গ আস্থার ভিত্তিতে ঘোষিত রায়ে ফল গ্রহণ এবং তদানুসারে রাষ্ট্র পরিচালনায় পরিপূর্ণ সহযোগিতা প্রদান প্রত্যেক নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য। সভ্যসমাজের ইতিহাস পর্যালোচনায় গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে পরবর্তী সরকার গঠনের সব কর্মকৌশল অবশ্যই প্রতিপালনযোগ্য। মূলত প্রাগ্রসর সমাজের দৃষ্টান্ত হিসেবে মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার প্রয়োগ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে যে কোনো ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ নির্বাচন কমিশনের ওপর বর্তায়। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণও এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দেশের আপামর জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানই নির্বাচন কমিশনের অবারিত সাফল্য।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধিই নির্বাচন কমিশনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্রতিভাত। কিছু সংখ্যক সরকারবিরোধী দলের ভোট বর্জন এবং আন্দোলনের মুখে ভোটারদের কেন্দ্রমুখী করে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ এবং দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই নির্বাচন কমিশনের মূল লক্ষ্য। এ জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে চায় সংস্থাটি। সংস্থাটির মতে, রাজনৈতিক পরিবেশ শান্ত ও নির্বাচন সহিংসতামুক্ত রাখা গেলে ভোটার উপস্থিতি বাড়তে পারে। ওই লক্ষ্য অর্জনে মাঠ প্রশাসনকে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনাররা ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগ সফর করে বিভাগীয়, আঞ্চলিক ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে কঠোর বার্তা দিয়েছেন। ডিসি-এসপিদের এক প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর প্রশাসন, পুলিশ এবং ইসি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘নির্বাচনে ভোট কম পড়লেও সমস্যা নেই। তবে ভোটকেন্দ্রে গণ্ডগোল ও অনিয়ম যেন না হয়। আইন ও বিধি মোতাবেক ভোটগ্রহণ করার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।’
গত ২ নভেম্বর নির্বাচন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত ৩০০ আসনভিত্তিক চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে দেশে মোট ভোটার সংখ্যা ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯, নারী ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ ও হিজড়া ভোটার ৮৫২ জন। সংসদ নির্বাচনে প্রথমবার ভোট দেবেন এমন ভোটারের সংখ্যা ১ কোটি ৫৪ লাখ ৫২ হাজার ৯৫৬। বিজ্ঞজনের মতে, তারাই দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ১৮ থেকে ৩৩ বছরের এসব ভোটারের সমর্থনেই ঠিক হবে কোন দল ক্ষমতায় বসবে। তাই তরুণ ভোটারের চিন্তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন ভাবনা শুরু করেছে রাজনৈতিক দলগুলো। সেভাবেই তৈরি করা হচ্ছে নির্বাচনের ইশতেহার। তা ছাড়া নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নেও তারুণ্যকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে নির্বাচন কমিশনও তরুণ ভোটার-প্রার্থী বিবেচনায় ভোটে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়েছে। নির্বাচনে ভোটাররা ঘরে বসে নিজ ভোটকেন্দ্র মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানতে পারবে।
এবারের নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ভর করছে তরুণ ভোটারদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ ও ভোটাধিকার প্রয়োগের ফলে সৎ-যোগ্য-দক্ষ-দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচন। আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক এবং গুণগত শিক্ষায় পর্যাপ্ত উন্নীত করে তরুণদের কর্মসংস্থান ও জীবনপ্রবাহের সচলতা সৃষ্টিতে আকর্ষণীয় যুগান্তকারী কর্মযজ্ঞই প্রত্যাশিত। শুধু বাচনিক কোনো প্রতিশ্রুতি নয়, প্রায়োগিক বিবেচনায় দৃশ্যমান সব উপযোগিতা তরুণ ভোটারদের উদ্দীপ্ত করার বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়