শুক্রবার ৪ জুলাই ২০২৫ ২০ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ৪ জুলাই ২০২৫
পোশাক শিল্পে নতুন মাত্রা যোগ
নাজিফা নাওয়ার
প্রকাশ: শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৫:৩২ PM
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধান বাজারগুলোতে পোশাক রপ্তানিতে ফের ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। দেশের তৈরি পোশাক খাতের প্রকৃত রপ্তানিতেও হঠাৎ করে বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে। সর্বশেষ গত জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে তৈরি পোশাক খাতে প্রকৃত রপ্তানি ছিল মোট রপ্তানির প্রায় ৭১ শতাংশ। গত বছরের একই প্রান্তিকে এ খাতে প্রকৃত রপ্তানি আয় ছিল মোট রপ্তানির সাড়ে ৫১ শতাংশ। সেই হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে প্রকৃত রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ২০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

প্রতিবেদন মতে, গত জুলাই–সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি বাবদ মোট আয় ছিল এক হাজার ১৬২ কোটি ডলার। এর বিপরীতে আমদানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৩৩৯ কোটি ডলার। তাতে এ খাতের মোট রপ্তানি আয় দাঁড়ায় ৮২২ কোটি ডলারে, যা এ খাতের মোট আয়ের প্রায় ৭১ শতাংশ। অথচ ২০২২–২৩ অর্থবছরের একই সময়ে (জুলাই–সেপ্টেম্বর) এক হাজার ২৭ কোটি ডলারের রপ্তানি আয়ের বিপরীতে কাঁচামাল আমদানি বাবদ ব্যয় ছিল ৪৯৮ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে এ খাতে প্রকৃত রপ্তানি আয় ছিল ৫২৯ কোটি ডলার, যা মোট আয়ের সাড়ে ৫১ শতাংশ। পোশাক শিল্পের রপ্তানি আয়ে এত বড় ধরণের প্রবৃদ্ধি আগে দেখেনি বাংলাদেশ।

নিট পোশাকের রপ্তানি বাড়ছে দ্রুত : পোশাকখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওভেন পোশাকের চেয়ে নিট পোশাকে মূল্য সংযোজনের পরিমাণ বেশি। ওভেন পোশাক রপ্তানি করে যে আয় হয় তার প্রায় ৬০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানির পেছনে ব্যয় হয়ে যায়। আর নিট পোশাকের ক্ষেত্রে রপ্তানি আয়ের ১৫ শতাংশের মতো খরচ হয় কাঁচামাল আমদানিতে। এ কারণে দেখা যাচ্ছে, কয়েক বছর ধরে ওভেনের তুলনায় নিট পোশাক রপ্তানিতে ভালো করছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে পোশাক খাতের ১ হাজার ১৬২ কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে নিট পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬৭৬ কোটি ডলার। আর একই সময়ে ওভেন পোশাকের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪৮৫ কোটি ডলার। চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রায় সাড়ে ৪৯ শতাংশই ছিল নিট পোশাকের, আর ওভেনের সাড়ে ৩৫ শতাংশ।

গত ২০১৯-২০ অর্থবছরেও নিট এবং ওভেন পোশাকের রপ্তানি ছিল প্রায় সমান সমান। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ওভেনকে ছাড়িয়ে যায় নিট পোশাকের রপ্তানি। এরপর প্রতি অর্থবছরই নিট পোশাকের রপ্তানি বেড়েছে। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে পোশাক খাতের রপ্তানি আয়ের প্রায় সাড়ে ৪৬ শতাংশ ছিল নিট খাতের আর ওভেন খাতের ছিল সোয়া ৩৮ শতাংশ।

রপ্তানিকারকেরা বলছেন, করোনার পর থেকে বিশ্ববাজারে নিট পোশাকের চাহিদা অনেক বেড়েছে। এমনকি করোনাকালেও নিট পোশাকের চাহিদা ছিল অনেক বেশি। কারণ, করোনা সংক্রমণের প্রথম ঢেউয়ের সময় দেশে দেশে লকডাউন জারি করা হয়। স্কুল, কলেজ, অফিস, আদালত, ভ্রমণ বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ঘরের বাইরে পরার পোশাকের চাহিদা ব্যাপকভাবে কমে যায়। বিক্রি না থাকায় বিদেশি ক্রেতারাও ক্রয়াদেশ কমিয়ে দেন। অন্যদিকে ঘরে পরার নিট পোশাকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিও বাড়তে থাকে। নিট পোশাক বলতে সাধারণত গেঞ্জির কাপড়ের তৈরি পোশাকই বোঝায়। যেমন টি-শার্ট, পলো শার্ট, সোয়েটার, ট্রাউজার, জগার্স, শর্টস প্রভৃতি।

নয় দেশে বড় বাজার : বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন বলছে, গত জুলাই-সেপ্টেম্বরে দেশের তৈরি পোশাকের মোট রপ্তানি আয়ের ৭০ শতাংশই এসেছে মাত্র নয়টি দেশ থেকে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর রয়েছে যথাক্রমে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস ও কানাডা। এ সময়ে এ নয়টি দেশ থেকে পোশাক রপ্তানি বাবদ আয় হয়েছে ৮১১ কোটি ডলার। উল্লিখিত ৯ দেশের বাইরের দেশগুলো থেকে পোশাক রপ্তানি বাবদ আয় ছিল ৩৫২ কোটি ডলার।

বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্যের আসনটি যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন যাবত ধরে রেখেছে। পোশাক রপ্তানি আয়ের প্রায় ২১.৫ শতাংশ এই বিশাল বাজার থেকে এসেছে। বাংলাদেশ সাশ্রয়ী মূল্যে মানসম্পন্ন পণ্য সরবরাহ করে, অন্যদিকে মার্কিন ক্রেতারা গার্মেন্টেসের নিরাপত্তার মান নিয়ে খুশি। অন্যান্য দেশের মতো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও একটি  অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবের মুখোমুখি হচ্ছে এবং সেখানে সুদের হার এবং জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে স্বস্তির বিষয় হলো সেখানকার মানুষ এখনো কাপড় ক্রয়ে আগ্রহী। দেশটির আমদানি পরিসংখ্যানও নির্দেশ করছে যে, মার্কিন শিল্প ও অর্থনীতি কোভিড -১৯ সংকট থেকে দ্রুতগতিতে পুনঃরুদ্ধার হচ্ছে।

বাংলাদেশ দ্বিতীয় শীর্ষস্থানীয় দেশ হিসেবে সর্বত্র প্রয়োজনীয় পোশাক রপ্তানি করছে এবং এই চাহিদা ইউরোপের বাজারে অনেকাংশে বেড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অবসানের আলামত দৃশ্যমান হওয়ায় ইইউ প্লাস দেশ, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি ক্রমাগত বৃদ্ধির প্রত্যাশা করা যায়। আবার, আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি  ক্রমবর্ধমান থাকবে বলে ধরে নেওয়া যায়, কারণ চীন নিজেই নিজের পোশাকের চাহিদা পূরণ করছে কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র প্রধান আমদানি উৎস হিসেবে চীন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে। রপ্তানিকারকরা আরও বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে চীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় বাংলাদেশ এর সুফল পাচ্ছে। মিয়ানমার ও ইথিওপিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অতিরিক্ত ক্রয়াদেশ পাচ্ছে, যা আমাদের জন্য ইতিবাচক।

কোভিডকালীন সময়ে সরকার ও উদ্যোক্তাদের নানামুখী পদক্ষেপ এবং কমপ্লায়েন্স পরিস্থিতি ভাল হওয়ায় বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতাদের পোশাক কেনার আগ্রহ বেড়েছে। চলমান বৈশ্বিক মন্দায় ইউরোপীয় দেশগুলিতে চাহিদা হ্রাসের হুমকি সত্ত্বেও মার্কিন বাজারে রপ্তানি অব্যাহত রাখা বাংলাদেশের সামগ্রিক পোশাক খাতের জন্য আশা জাগানিয়া খবর। একই সঙ্গে টাকার তুলনায় মার্কিন ডলার শক্তিশালী হয়েছে, যা দেশগুলোর ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করেছে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পুরানো এবং বিশ্বস্ত বাণিজ্য অংশীদার। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায়, বাংলাদেশ এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করা পোশাক পণ্যের উপর সর্বোচ্চ শুল্ক প্রদান করে, যা মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের তুলনামূলক প্রতিযোগিতাকে ব্যাপকভাবে হ্রাস করে। বিগত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি বা সংক্ষেপে টিকফার সপ্তম বৈঠক বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। এতে বলা হয়, রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে শ্রমিকদের সংগঠন করার স্বাধীনতা ও যৌথ দর-কষাকষি করতে পারার অধিকার সম্প্রসারণে বাংলাদেশকে উৎসাহিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে আমেরিকা থেকে আমদানি করা তুলা দিয়ে যে পোশাক তৈরি হবে এবং সেই পোশাক যখন আমেরিকায় রপ্তানি হবে তখন শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়ার কথা বলা হয়েছে। আশা করা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র আবারো বাংলাদেশের জন্য শুল্কমুক্ত রপ্তানির পথ খুলে দিবে। জিএসপি সুবিধা পুনরায় চালু না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কাঙ্ক্ষিত মাত্রা অর্জনে নিরলস কাজ করে যেতে হবে।

লেখক : গবেষক

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত