মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫ ৩ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১৭ জুন ২০২৫
একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অপেক্ষায়
ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
প্রকাশ: শনিবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৫:১১ PM
কয়েকদিন আগে একটি জাতীয় দৈনিকের জন্য এ রকমই একটি কলাম লিখতে গিয়ে লিখছিলাম, আমাদের দেশে প্রতিটি নির্বাচনের একটি ক্যারেক্টার আছে। যেমন- ২০০৯ সালের যে নির্বাচন, এর মূল ক্যারেক্টারটাই ছিল হারিয়ে ফেলা গণতন্ত্রটি পুনরুদ্ধার করা। এলো ২০১৪ সাল। আমাদের মূল লক্ষ্য ওই বছর আগুনসন্ত্রাসী আর রাজাকারদের পৃষ্ঠপোষকদের পরাজিত করে একাত্তরে শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করা। আর এর পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালে আমরা চেয়েছিলাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা- যাতে উন্নয়নের সূচিত ধারাটিকে সচল রাখতে পারি। সামনের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ক্যারেক্টারটি অন্যান্য যে কোনো নির্বাচনের চেয়ে একেবারেই আলাদা। এবারের লক্ষ্য একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করা। লক্ষ্যটি যে সবার- তেমনটি বলা অবশ্য ঠিক হবে না; বরং বলা ভালো, এটি দেশের সিংহভাগ মানুষের প্রত্যাশা। কারণ এ দেশে এমন কিছু মানুষ আছে যারা যে কোনো মূল্যে সামনের নির্বাচনটিকে প্রতিহত করতে কোমরে গামছা বেঁধে নেমেছেন। সবকিছু ছাপিয়ে তাদের উদ্দেশ্য এখন নির্বাচনটি ঠেকানো। কারণটিও খুবই স্পষ্ট। এবারের নির্বাচনটি ভালোয় ভালোয় অনুষ্ঠিত হয়ে গেলে আমরা এ দেশে একটি রাজনৈতিক সম্প্রদায়কে বিলুপ্ত হতে দেখব- যেমনটি এ দেশ দেখেছিল ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টের সরকার গঠিত হওয়ার প্রেক্ষাপটে রাজনীতির ময়দান থেকে মুসলীম লীগের বিলুপ্তির মধ্যে।

একটু ভেঙেই বলা যাক। এ দেশে রাজনীতি বরাবরই দুই কেন্দ্রিক। এর একটি স্বাধীনতার পক্ষের আর অন্যটি বিপক্ষের। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই স্বাধীনতার পক্ষের অর্থাৎ সেদিনের বাংলাদেশমুখী অংশের মূল প্রতিনিধি হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে ’৭৫-পরবর্তী দীর্ঘ সময়ে দলটি হয়তো কোণঠাসা হয়েছিল। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক, স্বাধীনতাপ্রেমী বাঙালি হৃদয়ের মসনদে আওয়ামী লীগের স্থানটি কখনই চ্যুত হয়নি। অন্যদিকে এক সময়কার পাকিস্তানপ্রেমী এবং ’৭১-পরবর্তী স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির প্রতিনিধি এ দেশে বিভিন্ন সময় পরিবর্তন হয়েছে। এক সময় ওই জায়গাটিতে ছিল মুসলীম লীগ। পরে সেখানে এসেছিল জামায়াতে ইসলামী, নেজামী ইসলাম, পিডিপি ইত্যাদি। ’৭৫-এর পর থেকে এ আসনটি পাকাপাকিভাবে বিএনপির জন্য নির্ধারিত। মাঝে কিছুদিন অবশ্য জাতীয় পার্টি জায়গাটি দখলে নিয়েছিল। তবে নিজেদের ভুলে দফায় দফায়, একের পর এক নির্বাচন বর্জনের রাজনীতি এবারের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপিকে অস্তিত্ব সংকটের জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছে। দলটির বেশকিছু ‘নামজাদা’ ও ‘নট সো নামজাদা’ নেতা এবার বিভিন্ন দল এবং জোটের নামে-বেনামে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, নির্বাচনের পর হয়তো বিএনপির দলছুটদের অফ শুট তৃণমূল বিএনপি সংসদের প্রধান বিরোধী দলের জায়গাটি জাতীয় পার্টির কাছ থেকে কেড়েও নিতে পারে। বিএনপি নির্বাচনে এলে জিয়া পরিবারের দণ্ডিত কোনো সদস্যই সংসদে যেতে পারছেন না। আর না এলে সংসদে বিরোধী দলের তকমাটা জুটছে তৃণমূল বিএনপি বা বিএনপি থেকে বেরিয়ে আসা কোনো জোট অথবা আবারও জাতীয় পার্টির ললাটে। তাই এ নির্বাচনের প্রয়োজনটি কী? সম্ভবত এমন বিবেচনা থেকেই দ্বাদশ নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপির এই ধরনের পোড়ামাটি নীতি।

প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি না আসায় নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক হতে যাচ্ছে কিনা? আমার কাছে উত্তরটি অবশ্যই ‘হ্যাঁ’। নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলকই হবে। তবে সেখানে একটি ‘যদি’ আছে। ওই ‘যদি’টা বিএনপি নয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নির্বাচনেই ওই সময়কার সব প্রধান রাজনৈতিক দল অংশ নেয়নি। ’৭০-এ অনুপস্থিত ছিল ন্যাপ আর ’৭৩-এ জাসদ। ’৭৯ আর ’৮৬-তে আওয়ামী লীগের নৌকা ব্যালটে মুদ্রিত থাকলেও আওয়ামী লীগকে মোটামুটি হাত-পা বেঁধে নদীতে সাঁতার কাটতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল- যেমনটি করা হয়েছিল ’৯১-এ জাতীয় পার্টিকে আর আবারও ২০০১-এ আওয়ামী লীগকে। মাঝে ’৮৮-তে ব্যালটে ছিল গৃহপালিত কম্বাইন্ড অপজিশন পার্টির ছড়াছড়ি। সবশেষ গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির ভূমিকা ও অংশগ্রহণ নিয়ে না হয় আর কালি খরচ না-ই করলাম।

মোদ্দা কথা, নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়াটি কোনো রাজনৈতিক দলের অংশ নেওয়ার ওপর নির্ভর করে না। আর করলেও বা কী? সামনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তো দেশের ৪৪টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩০টিই অংশ নিচ্ছে।

কোনো নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলো কি, হলো নাÑ তা মূলত নির্ভর করে ওই নির্বাচনে ভোটারদের টার্ন আউটের ওপর। আমাদের পবিত্র সংবিধানে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছে জনগণের ওপর। জনগণ জাতীয় নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জাতীয় সংসদে যে জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচিত করেন, তারাই জনগণের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন। কাজেই নির্বাচনে জনগণের বৃহদাংশের অংশগ্রহণই নির্ধারণ করে ওই নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলক ছিল কিনা।

সম্প্রীতি বাংলাদেশ আর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মতো সামাজিক-নাগরিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা এবং এই সুবাদে দেশের নানা অঞ্চলে আমার নিয়মিত যাতায়াত। শিকড়ের টানে ও চিকিৎসাদানের সুবাদে আমার আরও ঘন ঘন সিলেটে যাওয়া আর রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে শতাধিক মানুষের সঙ্গে যে প্রাত্যহিক সাক্ষাৎ; এসবের আলোকে কোনো প্রিন্ট, অনলাইন বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এতটুকুও চোখ না বুলিয়েও হলফ করে বলে দিতে পারিÑ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে নির্বাচনের রব উঠে গেছে। দেশে আপামর মানুষ এখন ৭ জানুয়ারি কেন্দ্র করে নির্বাচনী উৎসবে মাতার অপেক্ষায় উন্মুখ হয়ে আছে। কাজেই যে যা-ই বলুন আর ভাবুন না কেন, নিশ্চিত থাকতে পারেনÑ সামনে নির্বাচনটি অংশগ্রহণমূলকই হতে যাচ্ছে।

লেখক : ডিভিশনপ্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয় 

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত