মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫ ১০ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ২৪ জুন ২০২৫
একুশের কাছে ঋণ
আহমদ রফিক
প্রকাশ: শনিবার, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, ৫:২৭ PM আপডেট: ০৩.০২.২০২৪ ৬:০৯ PM
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে আমাদের প্রাপ্তি কী-এমন প্রশ্নের মুখোমুখি এ যাবৎ বহুবার হয়েছি। এক কথায় প্রাপ্তি কম নয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলা এটা যেমন একটি প্রাপ্তি, তেমন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস; সেটাও প্রাপ্তি। কিন্তু অপ্রাপ্তিও আছে। 

আমাদের স্লোগান ছিল সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলন। তা আজও হয়নি। স্লোগান আরও ছিল। প্রথম স্লোগান ছিল যেমন, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, এর পরই স্লোগান ছিল, ‘রাজবন্দিদের মুক্তি চাই’। তার পরের স্লোগানটা আবার বাংলা ভাষা নিয়েই। ওই স্লোগান ছিল, ‘সর্বস্তরে বাংলা চালু কর’। আজকের প্রেক্ষাপটে বলতে হয়, শেষোক্ত স্লোগান আজও প্রাসঙ্গিক, খুবই প্রাসঙ্গিক। উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞানশিক্ষা, উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন না হওয়া এসবই মুখ্যত রাজনৈতিক ব্যর্থতা। বায়ান্নর আন্দোলন নিছক আবেগনির্ভর ছিল না। মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, বায়ান্নর সড়ক ধরেই আমরা উপনীত হই মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্বে এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পাঁচ দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন এখনও দাবি হিসেবেই রয়ে গেল।

বায়ান্নর আন্দোলন আমরা ক্ষমতার জন্য করিনি। ক্ষমতার প্রশ্ন সেখানে কোনোভাবেই ছায়া ফেলেনি। প্রশ্ন ছিল, দাবি ছিল- রাষ্ট্রভাষা বাংলা, সর্বস্তরে বাংলা; আর এর জন্যই ঘটেছিল স্বতঃস্ফূর্ত জাগরণ। এ প্রেক্ষাপটগুলো বিশ্লেষণ করলে দ্বিধাহীন চিত্তে উচ্চারণ করতে হয়, একুশের কাছে আমাদের ঋণ অনেক। একুশের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ে সাহিত্য ও শিল্পে। ফিরে তাকাই পেছনে। কুমিল্লায়, ঢাকার কার্জন হলে, কাগমারীতে একুশের পর যেসব সম্মেলন হয়েছিল, তা আমাদের সংস্কৃতিকে আরও ঋদ্ধ হওয়ার সড়ক নির্মাণ করেছিল। সেসবই ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। একুশের প্রথম সংকলন প্রকাশ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আমাদের সংস্কৃতির প্রতিবাদী রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিত্রও অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। সন্দেহ নেই, একুশ জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছে। আরও যদি গভীরভাবে লক্ষ করি, তাতেও স্পষ্টতই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরোধিতা ও সমাজ পরিবর্তনের যে লক্ষ্য পুষ্ট হয়ে উঠেছিল তা-ও একুশকে ধারণ করেই। তবে শুধু বাংলার জন্যই আমাদের সংগ্রাম ছিল না; সব ভাষার অধিকার নিয়েই ছিল ওই আন্দোলন-সংগ্রাম। এ প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করলে বলতে হয়, একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সেই অর্থে যথার্থই ভূষিত হয়েছে। একুশ যেমন আমাদের চেতনা ও মূল্যবোধ নতুন করে অধিকতর পুষ্ট করে তেমন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে উচ্চারণও দৃঢ় করে। অখণ্ড ভারতে এবং অখণ্ড বঙ্গে যে সাম্প্রদায়িকতা ছিল অভিশাপ সেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন তুঙ্গে উঠে ধাপে ধাপে এবং চূড়ান্ত পর্বে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে সমাধিস্থ হলেও স্বার্থান্বেষী রাজনীতির অপচ্ছায়ায় তা আবার উঁকি মারতে শুরু করল। সাম্প্রদায়িকতা আজও যে বিষবাষ্প ছড়ায় তাতে প্রশ্ন জাগেÑ বায়ান্ন-একাত্তরের চেতনা কেন এবং কীভাবে হারিয়ে গেল? এর উত্তর অনুসন্ধান জটিল কিছু নয়।

আমি স্কুলজীবন থেকে ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত, অবিভক্ত বঙ্গে বাম রাজনীতি করেছি ১৯৪৭ সালে কলেজজীবনেও তাই। এরপর ১৯৪৯ সালে ঢাকায় এসে স্বভাবতই অংশগ্রহণ করেছি সাংস্কৃতিক ও সব গণ-আন্দোলনে এবং সেই ধারাবাহিকতায়ই যোগদান ভাষা আন্দোলনে। ভাষা আন্দোলনের যে দুটো মাইলফলক প্রথমত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ এবং দ্বিতীয়ত পুলিশের গুলিবর্ষণে আন্দোলনকারী কয়েকজন শহীদ হওয়া। এ দুটো প্রেক্ষাপটেই আমাদের আরও তীব্র আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এক দিনের মধ্যে চূড়ান্ত পর্বে গণ-আন্দোলনে রূপ নেয়, যা ইতিহাসসচেতন মানুষমাত্রই জানা। ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে দ্বিমত ছিল। কিন্তু সংগ্রামী ছাত্ররা একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ঐতিহাসিক আমতলায় জমায়েত হয়ে সিদ্ধান্ত নেয়, যেকোনো মূল্যে ১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে। সংগ্রামের মনোভাব আরও প্রবল হয়ে ওঠে। আমার মনে পড়ে রক্তাক্ত দুজনকে হাত লাগিয়ে ওপরে তুলে দিয়েছিলাম মেডিকেলের ইমারজেন্সিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য। তখনকার চিকিৎসাব্যবস্থা তো এত উন্নত ছিল না। তাই ওদের বাঁচানো গেল না। চিকিৎসক হিসেবে আমার বিশ্বাস অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তাদের প্রাণহানি ঘটে। ভালো চিকিৎসা দেওয়া গেলে বরকতকে হয়তো বাঁচানো যেত, জব্বারকেও বাঁচানোর সম্ভাবনা ছিল। একে একে শহীদের তালিকা দীর্ঘ হলো এবং ‘শহীদ দিবস অমর হোক’ স্লোগান উঠতে থাকল।

ভাষাশহীদ রফিকের লাশ হুমায়ূন কবির, মোশাররফ হোসেন, মোরশেদুল হক আরও অনেকে নিয়েছিলেন। যারা রফিকের লাশ বহন করেছিলেন তাদের কেউ বেঁচে নেই। আমি জব্বারের লাশে হাত লাগিয়ে তুলে দিয়েছিলাম বটে কিন্তু বহন করিনি। আমার বন্ধু গাজীউল হক লিখে, ‘ভুলব না ভুলব না একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলব না’ আর আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী লিখে, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’, যে গানটি আমাদের প্রভাতফেরির অনুষঙ্গ। অসাধারণ করুণ হৃদয় স্পর্শ করা এ গানটি জনপ্রিয় হয়।

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছি আমি কিন্তু পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস আমার পক্ষে লেখা সম্ভব নয়। কোনো ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব নয় বলে মনে করি। এর জন্য যে অর্থশক্তি-জনশক্তি প্রয়োজন তা কোনো একজন ব্যক্তির পক্ষে সহজ নয়। আর আমার মতো অনেকেরই এখন সে শক্তিও নেই। তবে মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, ইতিহাসের চেয়ে দলিলপত্রের গুরুত্ব অনেক বেশি। পরবর্তীকালে দলিলপত্রের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষকরা গবেষণা করতে পারবেন। ভাষাসংগ্রামীদের তালিকা করার চেষ্টা হয়েছে, উচ্চ আদালতও তা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এত বছর পর কি এ তালিকা সঠিকভাবে করা সম্ভব? ভাষাসংগ্রামীদের মধ্যে কতজনই বা জীবিত আছেন? যারা প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিবাদকারী তাদের সংখ্যাই বা কত? তবে এখনও বলি, তালিকা চূড়ান্তকরণের ক্ষেত্রে আগে দরকার ছিল ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলোকে আরও উচ্চ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ঘটনার শেষ নেই। এ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনের ওপর যা লেখা হয়েছে এর বাইরেও রয়ে গেছে আরও অনেক বিস্তৃত অধ্যায় যা জেলা শহর, মহকুমা শহর, থানা পর্যায় এমনকি শিক্ষায়তনকেন্দ্রিক গ্রাম পর্যন্ত ওই আন্দোলনে প্লাবিত হয়েছিল। ভাষা আন্দোলন নিয়ে আমার দুঃখ, অনেক রাজনৈতিক নেতাই স্বীকার করেন ভাষা আন্দোলন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজতলা। কিন্তু দুঃখজনক হলো, সেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে ইতিহাস-সচেতনতার পরিচয় দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

প্রত্যেক নৃগোষ্ঠীরই নিজস্ব ভাষা রয়েছে। তাদেরও অধিকার রয়েছে মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের। তবে ছোট ছোট ভাষাকে তো আর রাষ্ট্রভাষা করা যায় না, কিন্তু একটি স্তর পর্যন্ত তাদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাদের সেই অধিকারের সুযোগ দেওয়া উচিত। তাদের স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা রক্ষায় রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকার প্রয়োজন। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে না পারলে তা দেশের শাসকগোষ্ঠীর জন্য বড় রকমের ব্যর্থতা হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বাংলা বাংলাদেশে শুধু রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে থাকবে তা হতে পারে না।

সদিচ্ছার অভাব প্রচুর যে বাংলা ভাষা এত ত্যাগের বিনিময়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলো তার প্রতি আজও এত অবহেলা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। শুধু কথা আর অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতির গণ্ডিতে মূল কাজটি আটকে আছে। ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক ও একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতিলাভের পর কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচলনে গুরুত্বপূর্ণ কাজটিই রয়ে গেছে বাকি। যত দিন তা না হবে তত দিন ভাষা আন্দোলনের মূল দাবিগুলোর বাস্তবায়ন হবে না। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন করতে হবে। দায়িত্বশীল প্রত্যেককে কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের বর্ণমালাই শুধু রক্তস্নাত নয়, আমাদের স্বাধিকার অর্জনের পথেও বায়ান্নর ফেব্রুয়ারির আন্দোলন বিশেষ করে একুশে ফেব্রুয়ারি শক্তিশালী স্তম্ভ। 

লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্রগবেষক, প্রাবন্ধিক ও কবি

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত