বিশ্বব্যাপী এক জটিল সমস্যায় পরিণত হয়েছে অর্থপাচার। উন্নত-অনুন্নতনির্বিশেষে সব দেশ থেকেই কমবেশি অর্থপাচার হচ্ছে। এই সমস্যা সবচেয়ে জটিলতা সৃষ্টি করেছে উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত দেশের অর্থনীতিতে। যে অর্থ নিজ দেশের উন্নয়নকাজে ব্যয়িত হতে পারত, সেই অর্থ অননুমোদিতভাবে অন্য দেশের অর্থনীতিতে ব্যবহূত হচ্ছে।
অর্থপাচার বলতে বৈধ কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়া এক দেশ থেকে অন্য দেশে অর্থ স্থানান্তরকে বোঝায়। অর্থপাচার একটি দ্বিপাক্ষিক লেনদেন কার্যক্রম। কোনো দেশ এককভাবে চেষ্টা করলেই অর্থপাচার বন্ধ করতে পারবে না, যদি পাচারকৃত অর্থগ্রহীতা দেশ এ ব্যাপারে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, অনেক দেশ পাচারকৃত অর্থ তাদের দেশে প্রবেশে কোনো রকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে না, বরং নানাভাবে তাদের দেশে অর্থ বিনিয়োগে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
মালয়েশিয়া বা থাইল্যান্ডে ‘সেকেন্ড হোম’ প্রকল্পের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। দেশটিতে কোনো বিদেশি নাগরিক একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ নিয়ে গেলে কিংবা বিনিয়োগ করলে তাকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। বছর দুই আগে তুরস্ক মালয়েশিয়ার অনুকরণে সেকেন্ড হোম প্রকল্প কার্যক্রম শুরু করেছে। এই প্রকল্পে অংশগ্রহণের জন্য আবেদনকারীদের মধ্যে অন্তত ২০০ জন বাংলাদেশি রয়েছেন বলে পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল।
কানাডার ‘বেগমপাড়া’য় অনেক বাংলাদেশির বাড়ি ও ফ্ল্যাট রয়েছে। এসব বাড়ি ও ফ্ল্যাট অনেকগুলো হয়তো-বা ক্রয় করা হয়েছে পাচারকৃত অর্থ দিয়ে। তাছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন বা ইংল্যান্ডে ও আয়ারল্যান্ডে অনেকেই টাকা পাচার করে বাড়িঘর কিনেছেন বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলে ‘গ্রিন কার্ড’ পাওয়া যায় এবং কোনো একটি প্রতিষ্ঠান ঐ দেশে গড়ে তুললে এবং তাতে যদি তিন জন মার্কিন লোকের কর্মসংস্থান হয়, তাহলেও ‘গ্রিন কার্ড’ পাওয়া যায়। ‘গ্রিন কার্ড’ হলে বৈধভাবে থাকা যায় এবং পাঁচ বছর পর মার্কিন নাগরিকত্ব মেলে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও অর্থপাচার মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে চলেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর উন্নতি সাধন করেছে। জাতিসংঘের রেটিংয়ে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ কার্যকরভাবে উন্নয়নশীল দেশের চূড়ান্ত তালিকায় উত্তীর্ণ হবে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এসব অর্জন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত এবং প্রশংসিত হচ্ছে। কিন্তু তার পরও আমরা অর্থপাচার রোধ করে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনতে পারছি না। বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থপাচার কোনোভাবেই সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে একে নিয়ন্ত্রণ করে সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা যেতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর কী পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ যারা অর্থপাচার ও মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে যুক্ত, তারা কখনোই তাদের আয়ের উৎস এবং উপার্জিত সম্পদের পরিমাণ কারো কাছে প্রকাশ করে না। তবে পাচারকৃত অর্থের পরিমাণ যে কম নয়, তা অনুমান করা যায়। কয়েক বছর আগে ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটি (জিএফআই) তাদের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিল, বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে।
পণ্য রপ্তানিকালে ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ এবং পণ্য আমদানিকালে ‘ওভার ইনভয়েসিংয়ের’ মাধ্যমে বছরে বাংলাদেশ থেকে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। জিএফআইয়ের এই তথ্যকেও চূড়ান্ত বলে গণ্য করার কোনো অবকাশ নেই। কারণ তাদের দেওয়া পরিসংখ্যানও অনেকটাই অনুমাননির্ভর। তবে প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা নিশ্চিত করে বলা যায়।
অনেকের মধ্যে একটি সাধারণ ধারণা প্রচলিত আছে যে, বাংলাদেশ থেকে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরাই সবচেয়ে বেশি অর্থপাচার করেন। কিন্তু আমি একসময় কানাডার বেগমপাড়ায় যেসব বাংলাদেশির বাড়ি ও ফ্ল্যাট আছে, তাদের বিষয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে বেসরকারিভাবে জানতে পেরেছিলাম, সেখানে সম্পদ ক্রেতাদের মধ্যে চাকরিজীবী, ব্যাংক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী এমনকি আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের সংখ্যাই বেশি।
অর্থপাচার হয় সাধারণত বৈদেশিক মুদ্রায়। কার্ব মার্কেটে মার্কিন ডলারের বিনিময় হার ব্যাংকিং চ্যানেলের চেয়ে অনেক বেশি হওয়ার পেছনেও অর্থ পাচারের অবদান রয়েছে বলে অনেকের ধারণা। কারণ যারা বিদেশে অর্থ পাচার করেন, তারা বৈধ চ্যানেলে স্থানীয় মুদ্রার বিনিময়ে মার্কিন ডলার ক্রয় করেন না। তারা সাধারণত কার্ব মার্কেট থেকে উচ্চমূল্যে মার্কিন ডলার সংগ্রহ করেন। কারণ বৈধ চ্যানেল থেকে মার্কিন ডলার ক্রয় করতে গেলে নানা ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। হুন্ডি ব্যবসায়ীরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে তা কার্ব মার্কেটে বিক্রি করেন।
বিদেশে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য একাধিক বার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বাজেটে ৭ শতাংশ শুল্ক প্রদানের বিপরীতে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, যারা এই সুযোগ গ্রহণ করবেন, তাদের অর্থের উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করা হবে না। কিন্তু এই উদ্যোগ খুব একটা কার্যকরী হয়নি। খুব সামান্য পরিমাণ পাচারকৃত অর্থই দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়েছিল।
শোনা যাচ্ছে, আগামী অর্থবছরের (২০২৪-২০২৫) জাতীয় বাজেটে ১০ শতাংশ কর প্রদান সাপেক্ষে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনার সুযোগ দেওয়া হতে পারে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ ধরনের সুযোগ দানের পক্ষপাতী নই। তবে জাতীয় স্বার্থে যদি এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তাহলেও আরোপিত ট্যাক্সের পরিমাণ নিয়মিত ট্যাক্স প্রদানকারীদের চেয়ে বেশি হওয়া উচিত। সেটা করা না হলে নিয়মিত ট্যাক্স প্রদানকারীদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা হবে।
অর্থপাচার বন্ধ বা সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য ঘটনা-উত্তর ব্যবস্থা গ্রহণের চেয়ে পূর্বসতর্কতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করাই উত্তম। যথাযথ কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন ছাড়া কেউ যাতে দেশ থেকে অর্থ বিদেশে নিয়ে যেতে না পারে, তার ব্যবস্থা করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থপাচার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। দেশটির কোনো নাগরিক যদি ১০ হাজার মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ অন্য কোনো দেশে নিয়ে যায় এবং তা দিয়ে সম্পদ ক্রয় অথবা সংশ্লিষ্ট দেশের ব্যাংকে আমানত হিসেবে সংরক্ষণ করেন, তাহলে সেই তথ্য সংগ্রহপূর্বক মার্কিন কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
বাংলাদেশেও এ ধরনের আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। এ ধরনের একটি আইন প্রণয়ন করা গেলে তা অর্থ পাচার রোধে অনেকটাই সহায়ক হতে পারে। আমি সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির মিটিংয়ে এ ধরনের আইন প্রণয়নের জন্য একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছি। তাছাড়া প্রত্যেক অফিসার, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও ব্যাংকারের আয় ও ব্যয়ের বার্ষিক হিসাব নেওয়া দরকার এবং যেখানেই ফারাক অনেক বেশি হবে, তা তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের সম্মুখীন করা প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করলে দুর্নীতি যেমন কমবে, বিদেশে টাকা পাচারও কমবে বইকি।
বর্তমান সরকারের একটি নির্বাচনি অঙ্গীকার হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ে তোলা। এজন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এই নীতি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে নিশ্চিতভাবেই দুর্নীতি সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। আর দুর্নীতি কমে এলে অর্থ পাচারও হ্রাস পাবে। কারণ মানুষ অসৎভাবে উপার্জিত অর্থ প্রশ্নাতীতভাবে দেশের অভ্যন্তরে ব্যবহার করতে পারে না বলেই তা বিদেশে পাচার করে থাকে। তাছাড়া স্থানীয় ব্যাংক-ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা কম থাকায় তারা বিদেশি ব্যাংকে টাকা ডিপোজিট করে রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
একইভাবে উন্নয়নকাজে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে অর্থায়ন-সক্ষমতা বাড়ানোর ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বাংলাদেশের প্রচলিত ট্যাক্সেশন সিস্টেম খুবই দুর্বল। ফলে কোনো বছরই রাজস্ব আদায়ের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয় না। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উন্নয়নকাজে অর্থায়ন করা না গেলে একটি দেশকে বৈদেশিক সহায়তা ও ঋণের ওপর নির্ভর করতে হয়।
অতিমাত্রায় বৈদেশিক ঋণনির্ভরতা একটি দেশের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক বিবেচিত হতে পারে না। পৃথিবীর যেসব দেশে ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও সবচেয়ে কম, বাংলাদেশ তাদের মধ্যে অন্যতম। বাংলাদেশের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও ৮ শতাংশেরও কম। অথচ নেপালের ট্যাক্স-জিডিপি রেশিও আমাদের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। যারা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বারধারী (টিআইএন), তাদের সবাইকে বছরান্তে ট্যাক্স রিটার্ন দাখিলে বাধ্য করতে হবে। এছাড়া উচ্চহারে ট্যাক্স আরোপ না করে প্রয়োজনে ট্যাক্সের হার কমিয়ে করের আওতা বাড়াতে হবে। যারা উচ্চমাত্রায় আয় করেন, তাদের অনেকেই ট্যাক্স ফাঁকি দেন, এটা বন্ধ করতে হবে। আমাদের দেশে পরোক্ষ করের পরিমাণ বেশি। তবে প্রত্যক্ষ করারোপের পরিমাণও বাড়াতে হবে।
লেখক : সংসদ সদস্য, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান