ঘূর্ণিঝড় রেমাল আমাদের উপকূলীয় অঞ্চল বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেছে। ২৯ মে এবং এর আগের দিন প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ অন্য সংবাদমাধ্যমে রেমালের অভিঘাতে সৃষ্ট ক্ষতের যে চিত্র উঠে এসেছে এর উপশম এত সহজ নয়। জনজীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতির পাশাপাশি আমাদের প্রাকৃতিক সুরক্ষাপ্রাচীর সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যেও ব্যাপক অভিঘাত লেগেছে।
সিডরের পর অধিকতর কম ক্ষমতাশালী রেমালে জলোচ্ছ্বাস হয়েছে বেশি উচ্চতায়। এবারও বরাবরের মতোই প্রাকৃতিক সুরক্ষা বা নিরাপত্তাপ্রাচীর হিসেবে খ্যাত সুন্দরবন ঢাল হয়ে অনেকটাই রক্ষা করেছে উপকূলবাসীকে। প্রবল ঘূর্ণিঝড় রেমাল ২৭ মে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের স্থলভাগ স্পর্শ করে। বিশ্লেষকরা বলছেন, এটি দেশের স্থলভাগে প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে চিহ্নিত এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ও তাপমাত্রা বৃদ্ধির বড় কারণগুলোর জন্য রেমাল ক্ষতি করেছে বেশি। এপ্রিল-মে মাসে ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রপৃষ্ঠ দুয়েরই তাপপ্রবাহ অনেক বেড়েছে এবং তীব্র গরম প্রলম্বিত হয়েছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উষ্ণতা বাড়লে সমুদ্রে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়।
নিম্নচাপ প্রথমে লঘুচাপ, মৃদুচাপ এবং ক্রমান্বয়ে লঘু নিম্নচাপে রূপ নেয়। ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরকে সুপার সাইক্লোন বলে অভিহিত করা হয়। ঘূর্ণিঝড় রেমালের গতি সিডর থেকে কম ছিল। সচরাচর ৮৯ থেকে ১২০-১৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা বেগের ঘূর্ণিঝড় হলে ১০ নম্বর মহাবিপদসংকেত জারি করা হয়। রেমালের গতিবেগ পর্যালোচনায় একে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলে অভিহিত করতে হয়। সুপার সাইক্লোনের আগের পর্যায়টিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলা হয়। রেমাল যখন উপকূলীয় অঞ্চলের কাছাকাছি চলে আসে তখন এর গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১১১ কিলোমিটার সর্বোচ্চ। আগে থেকেই রেমালের অভিঘাতের যে ব্যাপকতার আশঙ্কা করা হয়েছিল প্রকৃতপক্ষে হয়েছে তা-ই।
আমরা জানি, ঘূর্ণিঝড় স্থলভাগের সংস্পর্শ পেলে দ্রুতবেগে পার হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড়ের নিজস্ব গতিপথ থাকে। আকস্মিকভাবে এ গতিপথ পাল্টে যাওয়ার নজিরও রয়েছে। ২০০৭ সালে সিডরের ক্ষেত্রে ভূমিতে ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৩৫-৪০ কিলোমিটার হলেও রেমালের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৫-৭ কিলোমিটার। গতিবেগের এ বিরাট পার্থক্যের কারণে ঘূর্ণিঝড় রেমালে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। রেমাল যেহেতু ধীরগতিতে স্থলভাগ অতিক্রম করেছে তাই বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়েছে এবং একই সঙ্গে জলোচ্ছ্বাসও বেড়েছে।
জলোচ্ছ্বাসের সঙ্গে যুক্ত হলো জোয়ার। জলবায়ু দুর্যোগের এ তিন নাজুকতা একসঙ্গে হওয়ায় উপকূলবর্তী এলাকায় রেমালের ভয়াবহতার ব্যাপকতাও বেশি হয়েছে। চট্টগ্রামে ২০৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে রাত ৮টা পর্যন্ত। ৮টার পর সারা রাত মৃদু বৃষ্টিপাত হয়েছে। উপকূলবর্তী এলাকাগুলোয় গড়ে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত ঘটেছে। অবিরাম বর্ষণ, জলোচ্ছ্বাস আর জোয়ারের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠ স্ফীত হয়ে পড়ায় উপকূলবর্তী অঞ্চল, পার্বত্য এলাকা এবং চট্টগ্রামে অভিঘাত লেগেছে বেশি। উপকূলবর্তী ১৯ জেলার মধ্যে ১৭টি জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
উল্লিখিত তিনটি নাজুকতাকে শক্তি জোগায় ঝোড়ো বাতাস। ঝোড়ো বাতাসের কারণে বৃষ্টির পানি, জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস আরও বেশি শক্তি জুগিয়ে বেড়িবাঁধে আঘাত হানে। বাঁধ ভেঙে পড়ায় বিস্তীর্ণ জনপদ প্লাবিত হয়ে পড়ে। এ রকম নাজুকতা আমরা সিডর কিংবা আইলার ক্ষেত্রে দেখিনি। সুপার সাইক্লোন সিডর অতিদ্রুত স্থলভাগ অতিক্রম করে চলে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম হয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চল রক্ষা করেছে। কিন্তু ঘূর্ণিঝড় রেমালে ঝুঁকি ছিল বেশি। ইউনিসেফের তথ্য অনুসারে, রেমালে উপকূলীয় অঞ্চলের ৮৪ লাখ মানুষ ঝুঁকির মধ্যে ছিল। ইতোমধ্যে উপকূলের বাঁধ ভেঙে জনপদ পানিতে তলিয়ে গেছে। ফসল, গবাদি পশুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, সুপেয় পানির আধার পুকুরগুলোও সমুদ্রের নোনা পানিতে ছেয়ে গেছে।
ঘূর্ণিঝড় রেমালের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র ব্যাপক। উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরায় এবার প্রায় দেড়শ টন আমের ফলন পাওয়ার কথা ছিল। ইতোমধ্যে এর অর্ধেক আম জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের কারণে সরাসরি কেউ মারা না গেলেও গাছচাপা পড়ে, পানিতে ডুবে অনেকে মারা গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে ঘূর্ণিঝড়-বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশের সাফল্য রয়েছে বলে দাবি করা হয়। যদিও সার্বিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে তার পরও প্রায় ৯ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। অনাকাক্সিক্ষত কিছু মৃত্যু হয়েছে বটে, তবে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে এমনটি হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অবিরাম বৃষ্টিপাতের ফলে রাতে বিদ্যুৎ ও টেলিযোগাযোগ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। কোনো কোনো এলাকায় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু এড়াতেই কর্তৃপক্ষ বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। টেলিফোন পরিষেবা ঘূর্ণিঝড়ে পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। জোয়ারের পানি স্ফীত হওয়ায় রাতে আশ্রয়কেন্দ্রের দিকেও অবস্থা কিছুটা নাজুক হয়েছে। হাতিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা জলাকীর্ণ হয়ে পড়ে। অতীতের কোনো ঘূর্ণিঝড়ে এত বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এত নাজুকতা ঘটেনি।
বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে আটলান্টিক ও ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ ও ভয়াবহতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এপ্রিল-মে মাসেই ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ বাড়ে। বিগত কয়েক বছরেও আমরা এমন চিত্রই দেখেছি। ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও আইলাও মে মাসেই হয়েছিল। মূলত প্রচণ্ড গরমে সমুদ্রপৃষ্ঠে যে জলীয় বাষ্প তৈরি হয় তা ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের সঙ্গে চলে আসে এবং এ জলীয় বাষ্পই বৃষ্টি ঘটাচ্ছে। জলীয় বাষ্প যত বেশি বাতাস শোষণ করতে পেরেছে, তত বেশি বৃষ্টিপাত ঘটেছে। ঘূর্ণিঝড় রেমালের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য নতুন আঙ্গিকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। এজন্য অন্যান্য সাইক্লোন থেকে এটি ভিন্ন।
২৮ মে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, কয়েকটি জেলার প্রায় ৭০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ক্ষতি হয়েছে। আগেই বলা হয়েছিল, উপকূলীয় অঞ্চলের বেশিরভাগ বেড়িবাঁধ অত্যন্ত দুর্বল এবং এগুলো রক্ষণাবেক্ষণে নজরদারি অনেক কম। উপকূলীয় মানুষের বড় দুর্ভোগের কারণ যেকোনো দুর্যোগে বেড়িবাঁধ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। এত দিনে মানুষ আগের তুলনায় অনেক সচেতন। উপকূলবাসীর একটিই দাবি- টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ। বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলেই হবে না। উপকূলবাসীকে রক্ষার ক্ষেত্রে বাঁধগুলোকে বিবেচনা করা হয়। নিকট অতীতে সরকার বাঁধ স্লাব দিয়ে বাঁধাই এবং বাঁধের উচ্চতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মূলত ঘূর্ণিঝড়ের ঘাত-অভিঘাত ঠেকাতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, অজ্ঞাত কারণে এ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হয়নি। বাঁধ পাকাপোক্ত ও টেকসই করা গেলে উপকূলীয় অঞ্চলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশেই কমে আসত। টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের সিদ্ধান্ত পরিকল্পনা পর্যায়েই আটকে আছে।
আমাদের নিকটবর্তী দেশ ভারতের বাঁধগুলোর দিকেই তাকানো যাক। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বাঁধ তুলনামূলক বেশি। ওড়িশা থেকে শুরু করে পশ্চিমবঙ্গের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে অনেক বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি বাঁধই টেকসইয়তার নিরিখে নির্মাণ করা হয়েছে। রেমালের আঘাতে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি এমন বলা যাবে না। তবে ওইখানে বাঁধগুলো তুলনামূলক কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর দেশের ৪ হাজার কিলোমিটার বিস্তীর্ণ বাঁধ ধ্বংস হয়েছে। বাঁধগুলোকে টেকসইয়তার ভিত্তিতে নির্মাণ করা হলে আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আরও ভালো হবে। তবে শুধু বাঁধ নির্মাণ করে আত্মতুষ্টিতে ভুগলে হবে না। বাঁধের রক্ষণাবেক্ষণ ও তদারকিতেও সমান গুরুত্ব দিতে হবে। যদি তা না করা যায়, তাহলে শুধু অর্থেরই অপচয় ঘটবে তা নয়, সম্পদহানিও ঘটবে ব্যাপকভাবে।
রেমালে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক এবং এর সঠিক পরিসংখ্যান এত দ্রুত ও সহজে পাওয়াও ভার। আপাতত ক্ষয়ক্ষতির যে চিত্র পাওয়া গেছে তা-ই অনেক স্ফীত। এ সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সেবা ও পুনর্বাসনের বিষয়ে এখন সর্বাধিক জোর দিতে হবে। বিশেষত ঘূর্ণিঝড় রেমাল আমাদের সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ সম্পর্কে যে সতর্কবার্তা দিয়ে গেছে তা আমলে নিতে হবে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে টেকসইয়তার আশ্রয় নিতে হবে এবং এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অবলম্বন বাঞ্ছনীয় মনে করি। দুর্যোগের প্রস্তুতি তাৎক্ষণিক নেওয়ার বিষয়ের পাশাপাশি সুষ্ঠু অবকাঠামো নির্মাণের বিষয়েও সচেষ্ট হতে হবে। দুর্বল বেড়িবাঁধ নিয়ে দুর্যোগের পর বারবারই কথা হয়, কিন্তু এর জন্য যা যা দরকার সেদিকে মনোযোগ সেভাবে লক্ষ করা যায় না। তা ছাড়া অনিয়ম-দুর্নীতির অপচ্ছায়াও এ ক্ষেত্রে কম প্রলম্বিত নয়। এসব বিষয়েই সমগুরুত্বে নজর দিতে হবে।
লেখক : প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস ও অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়