একে একে কারাগার থেকে মুক্তি পাচ্ছেন দাগি ও শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। দুই দশক জেলবন্দি থাকার পর সর্বশেষ গত মঙ্গলবার মুক্তি পান শীর্ষ সন্ত্রাসী শেখ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম। এক সময় তিনি ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করেছেন। গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন তিনি।
এর আগে গত ১২ আগস্ট কারাগার থেকে মুক্তি পান আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস। এ ছাড়া ১৫ আগস্ট কারামুক্ত হন আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হোসেন ওরফে হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল। অথচ এই তিনজনের নাম ইন্টারপোলের লাল তালিকায় ঝুলছে মোস্ট ওয়ান্টেড হিসেবে। এর পরও তারা কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন। তাদের মুক্তিতে অনেকের মধ্যে নিরাপত্তা শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এদিকে আন্ডারওয়ার্ল্ডে আলোচনায় থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ এ ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেননি। এ ছাড়া রাজধানীর মতিঝিলের আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীরা সম্প্রতি কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
সরকার পতনের পর দেশের বাইরে অবস্থান করছেন টিপুর স্ত্রী ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর ফারজানা ইসলাম ডলি। তিনি মোবাইল ফোনে সমকালকে বলেন, সরকার এসেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সব আসামিকে জামিন দিয়ে দিয়েছে। এ ছাড়া নেত্রী দেশে না থাকায় আমিও দুই সন্তান নিয়ে দেশের বাইরে আছি। বিচার পাওয়ার আশা একরকম ছেড়েই দিয়েছি।
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ আমিনুল গণি টিটো বলেন, বিচারাধীন মামলায় যদি দীর্ঘ বছর সাক্ষী হাজির না হয় এবং সে কারণে মামলা নিষ্পত্তি করা না গেলে আসামি জামিন পেতে পারেন। এ ছাড়া সাজা হলেও আপিল শুনানি অপেক্ষমাণ থাকলে সে ক্ষেত্রেও আসামির জামিন পাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
ইন্টারপোলের রেড নোটিশের তালিকা ঘেঁটে দেখা যায়, মোস্ট ওয়ানটেডের তালিকায় বাংলাদেশের ১৮ জন সন্ত্রাসীর নাম ঝুলছে। তারা হলেন– টোকাই সাগর, মানিক, আগা শামীম, লিয়াকত হোসেন, পিচ্চি হেলাল, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, আরমান, কামাল পাশা, কিলার আব্বাস, আব্দুল জব্বার মুন্না, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, ইমাম হোসেন, খোরশেদ আলম রাসু, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, ফ্রিডম সোহেল, খন্দকার নাইম আহমেদ টিটন ও কালা জাহাঙ্গীর। তানভীরুল ইসলাম গত এপ্রিলে মালয়েশিয়ায় মারা যান।
ইন্টারপোলের তালিকায় নাম ঝুললেও গত ১২ আগস্ট জামিনে কারামুক্ত হয়েছেন কিলার আব্বাস। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনের সামনে ও কাফরুল থানার কচুক্ষেত এলাকায় প্রকাশ্যে দুই ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তাঁর নামে মামলা হয়।
২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রেপ্তার হন তিনি। সেই থেকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের হাই সিকিউরিটি সেলে বন্দি ছিলেন। তিনি জামিনে বের হওয়ায় আতঙ্কে রয়েছেন বৃহত্তর মিরপুরবাসী।
আব্বাস আলী কারাবন্দি অবস্থায় মিরপুর, কাফরুল, পল্লবী ও ভাসানটেক এলাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন। তিনি স্মার্ট মোবাইল ব্যবহারসহ অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়েছিলেন। কারাগারে বসেই করতেন হত্যার ছক।
ইন্টারপোলের তালিকায় থাকা সু্ইডেন আসলাম গত মঙ্গলবার জামিনে কারামুক্ত হয়েছেন। হত্যাসহ একাধিক মামলার এ আসামির বাড়ি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার ছাতিয়ায়। তিনি থাকতেন ফার্মগেট এলাকায়। কারাগার সূত্র থেকে জানা গেছে, আসলাম ২০০৫ সালের ৩১ জানুয়ারি গ্রেপ্তার হন। ২০১৪ সাল থেকে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি ছিলেন।
জানা যায়, আসলামের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ১৯৯৭ সালের এপ্রিলে তেজগাঁওয়ে গালিব নামে যুবলীগ নেতাকে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়। ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে আদালতে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। মামলাটি বিচারাধীন। এই মামলায় জামিন পেয়ে কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন তিনি।
হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, আদালত থেকে আসা কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে আসলামকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
২০২১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২৩ জন শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা প্রকাশ করে। তারা হলেন–আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, ইমামুল হোসেন ওরফে হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, সুব্রত বাইন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর, জাফর আহমেদ ওরফে মানিক, শামীম আহমেদ ওরফে আগা শামীম, লিয়াকত হোসেন, মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ, আরমান, কামাল পাশা, কালা জাহাঙ্গীর, পিচ্চি হান্নান, আলাউদ্দিন, মশিউর রহমান, আবদুল জব্বার মুন্না, ফ্রিডম সোহেল, খোরশেদ আলম রাসু, নাঈম আহমেদ টিটন, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, ইমাম হোসেন ওরফে ফ্রিডম ইমাম, হারিস আহমেদ ও ভিপি হান্নান। তাদের মধ্যে পিচ্চি হান্নান, আলাউদ্দিনসহ কয়েকজন বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর গুঞ্জন শোনা গেলেও তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
শীর্ষ সন্ত্রাসী ফ্রিডম সোহেল ও আরমান কাশিমপুরে হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রয়েছেন। অনেকেই বিদেশে পলাতক। তালিকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ছাড়াও অনেক সন্ত্রাসী বিদেশে বসে দেশে অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানিয়েছে, মিরপুরের জব্বার মোল্লা ভারতে ও জিসান দুবাইয়ে পলাতক। খিলগাঁও, শাহজাহানপুর, রামপুরা, বনশ্রী, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার আতঙ্ক জিসান বিদেশে বসে বাহিনী নিয়ন্ত্রণ করছেন।
২০০৩ সালের মে মাসে মালিবাগে একটি হোটেলে জিসানকে গ্রেপ্তারের জন্য অভিযানে গিয়ে গুলিতে নিহত হন ডিবি পুলিশের দুই কর্মকর্তা। এর পর তিনি দেশ থেকে পালিয়ে যান। মগবাজার, মালিবাগ, মৌচাক, কাকরাইল, রমনা ও শান্তিনগরের ত্রাস ছিলেন এই জিসান।
কারওয়ান বাজার এলাকার আশিক অবস্থান করছেন থাইল্যান্ডে, পুরান ঢাকার কচি কখনও দুবাই, কখনও মালায়েশিয়ায় অবস্থান করেন। মিরপুরের শাহাদাৎ পলাতক আছেন ভারতে। সন্ত্রাসী ইব্রাহিম, তাজ ও রনিকে ওয়ান-ইলেভেনের সময় সরকারিভাবে ভারত থেকে দেশে আনা হয়। পরে জামিনে কারামুক্ত হয়ে ইব্রাহিম ভারতে এবং রনি মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যান।
সন্ত্রাসী বিকাশ রয়েছেন ইউরোপের কোনো একটি দেশে। জাফর আহমেদ মানিক যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেন। টোকাই সাগর আছেন যুক্তরাষ্ট্রে। হান্নান ইউরোপের কোনো একটি দেশে আছেন।
চট্টগ্রামের নাছির উদ্দিন চৌধুরী ওরফে ‘শিবির নাছির’কারামুক্ত হয়েছেন। ১৯৯৮ সালের ৯ এপ্রিল থেকে কারাগারে ছিলেন নাছির। দীর্ঘ ২৬ বছর পর গত ১১ আগস্ট তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পান। তাঁর বিরুদ্ধে জোড়া খুন, চাঁদাবাজি, অপহরণ ও অস্ত্র আইনের ৩৬টি মামলা ছিল। পর্যায়ক্রমে ৩১টিতে খালাস পান। র্যাব-পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী নাছির এক সময় শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় ‘শিবির নাছির’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন।