সিবগাতুল্লাহ সিবগা বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি ছিলেন। বর্তমানে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় অফিস সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, ছাত্র-জনতার জুলাই আন্দোলনে ঢাবি ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা নিপীড়নের শিকার হলেও এর বিরুদ্ধে অনেকগুলো স্টেক হোল্ডার চমৎকারভাবে কাজ করেছে। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা সাংবাদিকতা করেছেন তারা ছাড়াও ফ্রিল্যান্সার ও ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত গণমাধ্যম কর্মীদেরও সহযোগিতা পেয়েছি।
ছাত্র রাজনীতির বাস্তব চিত্র, আন্দোলনের অন্তর্গত কৌশল এবং ভবিষ্যৎ ছাত্র রাজনীতির রূপরেখা নিয়ে তিনি কথা বলেন বাসসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে।
প্রশ্ন : ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবির নিষিদ্ধ থাকার সময় কীভাবে কাজ করতেন?
সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় ভিন্নমতের কাউকে সহ্য করা হতো না। তারা বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের ওপরও দমন-পীড়ন চালাত। ছাত্রদলের কেউই ক্যাম্পাসে থাকতে পারত না। শিবিরসহ অন্য কোনো দলও সংগঠনের পরিচয়ে টিকতে পারেনি। কিন্তু শিবির কোনো দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেনি। ছাত্রশিবিরের কাজ মূলত নৈতিক ও অ্যাকাডেমিক। আমরা পড়াশোনা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় ফোকাস করি। মিছিল-মিটিং আমাদের খুব বেশি প্রয়োজন হয় না, সেগুলো সচরাচর করিও না। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ, নিয়মিত বৈঠক এবং শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো বজায় রাখা- এই বিষয়গুলোতে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দেই।
প্রশ্ন : বাম-ডান সব মতাদর্শের দল আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। সবাই একত্রিত হওয়ার পেছনে কী কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন?
সিবগাতুল্লাহ সিবগা : কোটা ব্যবস্থা বাতিল হোক, এটা সব শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলের চাওয়া ছিল। কিন্তু যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামা ছাত্রদের ওপর যখন গুলি চালানো হলো, তখন তারা দ্রোহ করেছে। সরকারের উদ্দেশ্যে বলেছে, আমরা তোমাদের মানি না। ছাত্রদের বক্তব্য ছিল, আমরা দাবি আদায়ের জন্য নামবো আর তুমি (সরকার) গুলি করবা! তাতো হবে না। বিশেষ করে আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়াসহ সমসাময়িক অসংখ্য ঘটনায় সব শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। আর তাদের সাথে সংহতি জানাতে নেমে আসে সকল রাজনৈতিক দল।
প্রশ্ন : ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ভিসি চত্বরে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। আপনারা দলীয়ভাবে যুক্ত ছিলেন কি? কিভাবে প্রতিরোধ করেছেন?
সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ঘটনার শুরু মূলত ১৪ জুলাই। ওইদিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাধারণ শিক্ষার্থীদের রাজাকারের বাচ্চা বলেছিলেন। তখন আমি ক্যাম্পাসে ছিলাম না, কিন্তু খবর পাই রাতে কয়েকটি হলে এর প্রতিবাদে বিক্ষোভ হয়েছে। ‘রাজাকারের বাচ্চা’ ট্যাগ দিয়ে শেখ হাসিনা যে ফ্রেমিং করেছিলেন সেটিকে সবাই নিজের ওপর নিয়ে স্লোগান দেয় ‘তুমি কে, আমি কে, রাজাকার, রাজাকার!!’ এর প্রতিবাদে পরদিন পুরো ক্যাম্পাসে মিছিল হয়, সেখানে আমরাও ছিলাম। হলের মেয়েরাও তালা ভেঙে যোগ দেয়। প্রায় সব শিক্ষার্থী মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন। তখন অবশ্য মনে হয়েছিল, ক্যাম্পাসে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ সাধারণ শিক্ষার্থীরা আওয়ামী বয়ানের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল।
১৫ তারিখে যখন খবর আসে ‘বিজয় ৭১’ হল থেকে কাউকে বের হতে দিচ্ছে না, তখন রাজুতে অবস্থান নেয়া মিছিলের একটি অংশ ক্যাম্পাসের দিকে মুভ করে। আপনারা জানেন, সেই মিছিলেও হামলা চালানো হয়। হামলার অসংখ্য ফুটেজ কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের হাতে আসে। সেখানে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে নারীদের ওপর হামলা চালানো হয়েছিল। এসব ফুটেজ সবগুলো সংগ্রহ করে পুরো দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
প্রশ্ন : ১৫ জুলাই শহীদুল্লাহ হলে মূলত অবরুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছিল। বলা হয়, শিবিরের শক্ত ভূমিকার কারণেই ছাত্রলীগ সেদিন সেখানে ঢুকতে পারেনি।
সিবগাতুল্লাহ সিবগা : সেদিন শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয় এমনকি হাসপতালেও হামলা চালানো হয়েছিল। ওই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয় সভাপতি আমাকে ফোন দিয়ে সব জানায়। দেখলাম হামলায় আহতরা চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে গেছে; কিন্তু সেখানেও হামলার শিকার হচ্ছেন। সে সময় ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ও ঢাকা মহানগর পূর্বসহ বেশ কয়েকটি শাখাকে ঘটনাস্থলে পাঠিয়েছিলাম হামলাকারীদের প্রতিরোধ করতে।
তাদেরকে বলি, মিছিল নিয়ে মেডিক্যাল হয়ে শহীদুল্লাহ হলের পাশ দিয়ে চলে যেতে। একই সাথে জানানো হয়, সমন্বয়করা ভয় পাচ্ছেন পরদিনের কর্মসূচি দেয়া নিয়ে। কারণ সেখানে পর্যাপ্ত লোক না থাকলে কর্মসূচি ঘোষণাটা একটু কঠিন হতে পারে। পরবর্তীতে দুই মহানগরীর কিছু জনশক্তি এসে ছাত্রলীগকে ধাওয়া দেয়। ওই সময়টাতেই মূলত সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
প্রশ্ন : সরকার পতনের সময় অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। সে সময় ছাত্রশিবির কোন কোন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছিল নির্দিষ্ট করে জানাবেন।
সিবগাতুল্লাহ সিবগা : ১৬ জুলাই ক্যাম্পাসের অবস্থা ছিল বেশি ক্রিটিক্যাল। ওইদিন সবচেয়ে ভয়াবহ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছিল। ওই দিনের পর থেকে আন্দোলনটা অন্য মাত্রায় মোড় নেয়। আরেকটা বিষয়, কোন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে কোটা ইস্যুতে সবচেয়ে বড় মিছিলটিও হয়েছিল ওইদিনই। সেটি শিবিরই করেছিল। দেশের সব গণমাধ্যমেই এ খবরটি প্রচার করা হয়। মিছিলের পর আমাদের জনশক্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবস্থান নিতে থাকে। মহানগরসহ কয়েকটি কলেজ শাখার জনশক্তি ঢাকা কলেজ, সিটি কলেজ ও সায়েন্স ল্যাবে অবস্থান নেয়।
আমাদের মূল ফোকাস ছিল, সবার দৃষ্টি ওই স্থানগুলোতে আকৃষ্ট করা। যাতে ক্যম্পাসের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালিত হতে পারে। নির্দেশনা ছিল মিছিল করে পরে সবাই ক্যাম্পাসের দিকে আসবে। কিন্তু ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রসীদের গুলির মুখে সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
একই সাথে চানখাঁরপুল এলাকায় যে মারমারি হয়, সেখানে হাজী সেলিমের একটা গ্রুপও ছিল। তখন শিবির মূলত সেখানে ঢাল হিসেবে দাঁড়িয়েছিল যাতে হাজী সেলিমের লোকজন ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারে। একই সময়ে শিক্ষার্থী প্রচুর লাঠি সংগ্রহ করে জড়ো করে ক্যম্পাসে ও শহীদ মিনারে। এর মধ্যে একটা বড় অংশ বাইরে থেকে আমাদের জনশক্তির সরবরাহ করা। সেদিন সারা দেশে আবু সাঈদসহ কমপক্ষে ৬ জন শাহাদত বরণ করে। ওই ঘটনার পর ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা লাঠিসহ হলে প্রবেশ করে। রাতের বেলা তারা ঐক্যবদ্ধভাবে একের পর এক হল এবং ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়িত করে।
প্রশ্ন : আপনি কি কখনো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন? এ রকম কোনো ঘটনা থাকলে বলুন।
সিবগাতুল্লাহ সিবগা : হ্যাঁ, আছে। ৪ তারিখের ঘটনা বলি। আমরা বেলা ১১টার দিকে শাহবাগে পৌঁছাই। তখন পিজি হাসপাতালের পাশ থেকে ছাত্রলীগ গুলি চালানো শুরু করে। তখনো সেখানে জনসমাগম হয়নি; আমরা মাত্র কয়েকজন ছিলাম। গুলি শুরু হলে আমরা ইট-পাটকেল ছুড়ে প্রতিরোধ করি। তাদের গুলিতে আমাদের কয়েকজন আহত হন। তারপরও আমরা তাদের হঁটাতে সক্ষম হই। এর ফলে ৪ তারিখ শাহবাগে ভালোভাবে অবস্থান নেয়া সম্ভব হয়। বিকেলে খবর আসে সায়েন্স ল্যাব ও ঝিগাতলায় ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে। তখন শাহবাগ থেকে আমরা প্রায় ৭-৮ শতাধিক মানুষ নিয়ে ঝিগাতলার দিকে যাই। সেখানে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও অন্যদের সাথে সংঘর্ষ চলে মাগরিব পর্যন্ত।
প্রশ্ন : কখন জানলেন শেখ হাসিনা চলে গেছেন?
সিবগাতুল্লাহ সিবগা : আমরা ৩ তারিখ রাতেই বুঝেছিলাম বড় কিছু হতে যাচ্ছে। ৫ তারিখ শাহবাগে গিয়ে দেখি সেনাবাহিনী মোতায়েন। একে একে শিক্ষার্থীরা জড়ো হচ্ছিল এবং ভাবছিল কিভাবে শাহবাগে প্রবেশ করবে। তখন আমি বলি, ‘মেইন রাস্তায় দাঁড়ানো সম্ভব নয়, চলুন ভেতরের দিকে যাই।’ এরপর আমরা পিজি হাসপাতালের দিকের গলিতে অবস্থান নেই, সেখানে তিন-চার হাজার মানুষ একত্রিত হয়। কিছুক্ষণ পর খবর আসে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন। তারপর মিরপুর ও উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা গ্রুপগুলোকে শাহবাগে আসতে বলা হয়। সেখান থেকে কয়েকটি দল গণভবনের দিকে অগ্রসর হয়। এরপর বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগ করি। রাতের বেলা তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কাকে চাচ্ছি কী চাচ্ছি তা নিয়ে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করি।
প্রশ্ন : গণ-অভ্যুত্থানের পর নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে কি?
সিবগাতুল্লাহ সিবগা : অবশ্যই, বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। যে কারণে ফ্যাসিবাদী শক্তি বাংলাদেশে উত্থান হয়েছিল সেটির সংস্কার দরকার। কিন্তু এখন যা দেখছি, তা হলো ক্ষমতায় পরিবর্তন হলেও শুধু জনবল বদলাবে, সিস্টেম আগের মতোই থেকে যাবে। আওয়ামী লীগের জায়গায় অন্য কেউ আসবে; কিন্তু আবারো ফ্যাসিবাদী শাসনের দিকেই যাবে। জনমতকে উপেক্ষা করা, তাদের দাবি না শোনা, সবই আগের মতো রয়ে গেছে। আমি মনে করি, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে একটি গভীর পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আসেনি।