সোমবার ২৩ জুন ২০২৫ ৯ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ২৩ জুন ২০২৫
শীতে কাবু হচ্ছে শিশুরা, হাসপাতালে দ্বিগুণ চাপ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২২, ৭:১৫ PM
দেশেরে উত্তর অঞ্চলে তীব্র শীত পড়া শুরু হয়েছে। পৌষ শুরু হতে এখনো বাকি ৯ দিন। এরই মধ্যে অগ্রহায়ণের শেষ লগ্নে উত্তরের জেলাগুলোতে বাড়ছে শীতের প্রকোপ। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে জেঁকে বসছে শীত। এতে নাজেহাল শিশুসহ বয়স্করা। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, শ্বাসকষ্ট, জ্বর-সর্দিসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ ছড়িয়ে পড়েছে। রংপুর বিভাগের হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে শিশু ও বয়স্ক রোগীর সংখ্যাও। তবে হঠাৎ করে অতিরিক্ত রোগীর চাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় হিমশিম খেতে হচ্ছে হাসপাতালে দায়িত্বরতদের।

গত ২৪ ঘণ্টায় রংপুর বিভাগের আট জেলায় শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ৪৯২ শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আর পুরো বিভাগজুড়ে গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন হাসপাতালে তিন হাজারের বেশি শিশু ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে শুধু রংপুর মেডিকেল কলেজ (রমেক) হাসপাতালে গত ১ থেকে ৬ ডিসেম্বর সকাল পর্যন্ত নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয় ২৭১ জন। এদের মধ্যে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তাদের সবার বয়স ১ মাস থেকে দেড় বছরের মধ্যে।

মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) দুপুরে হাসপাতালের তৃতীয় তলায় শিশু ওয়ার্ডের ৯ নম্বর ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি শয্যায় একাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে। শয্যা না পেয়ে মেঝেতে বিছানা পেতে শিশুদের রাখা হয়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন শিশু রোগীর চাপে ব্যস্ততা বাড়ছে নার্স ও চিকিৎসকদের। তবে শয্যা সংকুলান না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন অভিভাবকসহ স্বজনরা।

হাসপাতালের শিশু বিভাগের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইনচার্জ ও সিনিয়র স্টাফ নার্স মোছা. শিখিলী খাতুন জানান, এবার কোল্ড ডায়রিয়ায় শিশুরা বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। প্রতিদিন ভর্তির তালিকা বাড়তে থাকায় চাপও বেড়েছে। চলতি মাসে প্রতিদিনই কম বেশি ৫০-৬০ জনের বেশি শিশু নিউমোনিয়া ও ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছে। গত ছয় দিনে হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে শীতজনিত রোগ নিয়ে ভর্তি হওয়া দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে বলেও জানান তিনি।

শিশু ওয়ার্ডে তিন মাস বয়সী শিশু নিবিড়কে নিয়ে এসেছেন মোসলেমা খাতুন। নীলফামারীর জলঢাকা থেকে আসা এই নারী জানান, তার নাতির কয়েক দিন ধরে সর্দি-কাশির সঙ্গে শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে। হঠাৎ অবস্থার অবনতি হওয়ায় গতকাল হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। শীতের কারণে নিউমোনিয়া হয়েছে বলে চিকিৎসকরা তাকে জানিয়েছেন।

এদিকে রংপুর ছাড়াও কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, দিনাজপুর ও পঞ্চগড়সহ বিভাগের অন্য জেলার হাসপাতালগুলোর বেশির ভাগ ওয়ার্ডে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যাই বেশি বলে জানা গেছে। কোথাও কোথাও হাসপাতালের বহির্বিভাগে জনবল সংকটের কারণে রোগীদের সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসকরা। শীতের প্রকোপ বাড়লে এমন চাপ আরও কয়েকগুণ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

জানা গেছে, দিনাজপুর সদর হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন শতাধিকের বেশি শিশুকে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। শিশু ওয়ার্ডে ২০ শয্যার বিপরীতে প্রতিদিন ভর্তি রোগী হচ্ছেন ৫০ থেকে ৬০ জন। মঙ্গলবার সেখানে শিশু রোগীর সংখ্যা ছিল ৫৭। 

কর্তব্যরত চিকিৎসক ও নার্সরা জানিয়েছেন, শীতজনিত রোগের কারণে ১ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী বেশির ভাগ শিশুই এখন জ্বর, সর্দি, কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়ারিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। গত এক মাসে এই হাসপাতালে শীতজনিত রোগে আক্রান্তদের মধ্যে মারা গেছে একজন রোগী।

দিনাজপুর অরবিন্দ শিশু হাসপাতাল, এম আবদুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেনারেল হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শীতজনিত রোগে সাড়ে তিন শতাধিক শিশু চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. বোরহানুল ইসলাম সিদ্দিকী।

দেশের উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ে গেল কয়েকদিন ধরে ১১ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। মঙ্গলবার (৬ ডিসেম্বর) ভোর ৬টায় তাপমাত্রা ১২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হলেও সকাল ৯টায় তা রেকর্ড করা হয়েছে ১১ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দিন-রাতে তাপমাত্রা দুই রকম থাকায় এই জেলায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে শীতজনিত রোগ। জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়াসহ ঠান্ডাজনিত রোগে হাসপাতালগুলোতে ভিড় করছেন রোগীরা।

জেলা-উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত দুই-তিন শতাধিক রোগী চিকিৎসা নিতে আসছেন। এদের মধ্যে বেশির ভাগই শিশু। গত ৫ দিনে জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালে ৪৬২ জন রোগী ভর্তি হয়েছে। আর গত নভেম্বর মাসে এ হাসপাতালে ৩ হাজার ৬৪৮ জন শিশু ভর্তি হয়েছিল।

নীলফামারীর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে গত এক সপ্তাহে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত ৪৫৩ জন শিশু ভর্তি হয়েছে। তবে কোনো মৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি। হাসপাতালে শয্যা সংকুলান না হওয়ায় একই বেডে চিকিৎসা নিচ্ছে দুইজন করে শিশু। আবার অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছে হাসপাতালের বারান্দায়।

কথা হয় সদরের দারোয়ানি এলাকার আলেফা আক্তারের সঙ্গে। শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় তিনি তার দুই মাসের শিশু রানী আক্তারকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন। ছয় দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া আলেফা আক্তার বলেন, এখানে সব ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে। শুধু ডাক্তার এসে দেখে যাচ্ছেন, আর কিছু নাই।

এদিকে কুড়িগ্রামেও ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে বেড়েছে রোগীর চাপ। হাসপাতালে ২৫০ শয্যার বিপরীতে শুধু শিশু ওয়ার্ডে রোগী ভর্তি রয়েছে ১২ শয্যায়। এর বিপরীতে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে ৩৮ ও শিশু ওয়ার্ডে ৪৮ শয্যার বিপরীতে ৯০ জন ভর্তি রয়েছে।

হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা কুড়িগ্রাম সদরের পাঁচগাছী ইউনিয়নের রহিম বলেন, গত ৪-৫ দিন ধরে আমার ১১ মাসের শিশুকে নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। ডায়রিয়া ওয়ার্ডে আছি। এখানে একটি বেডে দুজন করে শিশুকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এই হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে বেডের সংখ্যা বাড়ানো উচিত।

চিকিৎসকরা বলছেন, উত্তরাঞ্চল শীতপ্রবণ হওয়ায় এই সময়ে শীতজনিত রোগের প্রকোপ অনেকটা বেড়ে যায়।  এই মৌসুমে আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় বাতাসে জীবাণুর পরিমাণ বেড়ে যায়। যার প্রভাব পড়ে শিশু ও বয়স্কদের ওপর। রোগ হিসেবে সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট বেশি হয়ে থাকে। আর শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠরা শীতজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তাই রোগ প্রতিরোধে শিশুদের চিকিৎসার পাশাপাশি গরম কাপড় ও উষ্ণতার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. মো. শাহীনুর রহমান জানান, শীতের প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় হাসাপাতালে রোগীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে ডায়রিয়া ও শিশু ওয়ার্ডে বেডের বিপরীতে দ্বিগুণেরও বেশি রোগী ভর্তি আছে। শীতের শুরুতেই শুধু মাত্র কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিচ্ছেন ১২০০-১৩০০ রোগী।

রমেক হাসপাতালের পরিচালক ডা. শরিফুল ইসলাম জানান, প্রচণ্ড শীতের কারণে নিউমোনিয়া, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগের প্রকোপ বাড়ছে। বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসা শিশুদের মধ্যে যাদের অবস্থা সংকটাপন্ন মনে হচ্ছে, তাদের ভর্তি করা হচ্ছে। গত পাঁচ দিনে শিশু ওয়ার্ডে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়ে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে।


রংপুর আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে এই অঞ্চলে তাপমাত্রা কমে শৈত্য প্রবাহ বাড়বে। এ ছাড়া এখন গড়ে প্রতিদিনি ১৩ থেকে ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ওঠানামা করছে। চলতি মাসে শীতের তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে দুটি শৈত্য প্রবাহ হতে পারে বলেও জানান তিনি।  

বাবু/জেএম
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত