মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫ ১৭ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১ জুলাই ২০২৫
তোমাদের ঋণ শোধ হওয়ার নয়
ড. মতিউর রহমান
প্রকাশ: বুধবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২২, ৫:০৯ PM আপডেট: ১৪.১২.২০২২ ৫:১২ PM
বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য দূরীকরণে তথা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা অপরিসীম এবং অনস্বীকার্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির মহামাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে। কেবল তাই নয়, তাদের আশা আকাক্সক্ষার প্রতীক, দাবি আদায়ের বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে একটি স্বাধীন মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্ত, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী সসস্ত্র রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেখা দেয় সেই বহু প্রত্যাশিত মহামুক্তি। অর্জিত হয় বিজয়। পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, বাংলাদেশ।

স্বাধীনতা যুদ্ধে আমরা যেমন অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে হারিয়েছি, তেমনি হারিয়েছি শত শত দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীকে। পাক-হানাদার বাহিনী দেশদ্রোহী রাজাকার, আলবদর ও আল শামসের সহায়তায় অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ  কাল রাত থেকে মুক্তিযুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তারা এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। বলা হয়ে থাকে শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এবং বুদ্ধিজীবীরা জাতির মস্তিষ্ক। কারণ, তাঁরা তাদের মেধা, মনন, প্রজ্ঞা, শ্রম ও দেশপ্রেম দিয়ে জাতিকে আলোর পথ দেখায় এবং জাতি গঠনে সহায়তা করেন। বাঙালি জাতিসত্তা গঠন ও স্বাধীনতা অর্জনে শহীদ বুদ্ধিজীবীরা যে অবদান রেখেছেন তা কখনও ভুলবার নয়। তাঁদের লেখনি, পরামর্শ, তত্ত্ব, তথ্য, উপাত্ত ও সক্রিয় অংশগ্রহণ মুক্তিযুদ্ধে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় অর্জিত হওয়ার আগে পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী যখন বুঝতে পেরেছিল যে তাদের পরাজয় নিশ্চিত, তখন তারা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার জন্য একটি ঘৃণ্য নীলনকশা প্রণয়ন করে। তাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত চূড়ান্ত গণহত্যা চালায়। এই সময়ে প্রথিতযশা  শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সমাজকর্মী, রাজনীতিবিদ, কবি, লেখক, সাংবাদিক, সাহিত্যিক ও  শিল্পীকে বেছে বেছে হত্যা করা হয়; যারা বাঙালি জাতির কৃতীসন্তান বা বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণ্য ছিলেন। এই ঘটনার স্মরণে বাঙালি জাতি প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বরকে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে ১৪ ডিসেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগী আল শামস, আলবদর ও রাজাকারদের দ্বারা সবচেয়ে নির্মম, নিষ্ঠুর ও জঘন্য এ অপরাধ সংঘটিত হয়। এগুলি ছিল পরিকল্পিত, হিসেব করা এবং ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড যার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের কবল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামরত জাতির মেরুদণ্ডকে পঙ্গু করে দেওয়া।

রক্ত যদি স্বাধীনতার মূল্য হয়, তবে পাকিস্তানের অত্যাচারী দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ তা পুরোপুরি পরিশোধ করেছে। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে জাতি পেয়েছে কাঙ্খিত স্বাধীনতা। নয় মাসব্যাপী মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান দখলদার বাহিনী  ও তাদের এদেশীয় সহযোগী আলবদর, আল শামস এবং রাজাকারদের মতো স্থানীয় ঘাতকদের নিয়ে গঠিত ডেথ স্কোয়াডের সদস্যরা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের (সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, চিত্রশিল্পী, শিক্ষক, গবেষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, স্থপতি, ভাস্কর, সরকারি ও বেসরকারি কর্মচারী, রাজনীতিক, সমাজসেবী, সংস্কৃতিসেবী, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ যারা  বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছিলেন) তুলে নিয়ে যায়, গুলি করে বা ছুরিকাঘাতে হত্যা করে এবং রায়েরবাজার ও মিরপুরের জলাভূমিতে ফেলে দেয়। 

পরে এসব জলাভূমি থেকে নিহতদের বিকৃত লাশ উদ্ধার করা হয়। ঢাকার বাইরে অন্যান্য স্থানেও একই ধরনের জঘন্য কাজ করা হয়েছে। তাদের অপরাধ ছিল তারা বাঙালি এবং আলোকিত মানুষ ছিলেন। সর্বোপরি তাঁরা জাতির মূল চালিকা শক্তি শোষিত মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন এবং তাদের জন্য আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করছিলেন। তাঁরা প্রবল দেশপ্রেমিকও ছিলেন যারা বিশ্বাস করতেন যে একদিন জাতি স্বাধীন হবে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে যেভাবে একটি স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র গঠনের  কথা বলেছিলেন তাঁরা  এর পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও তাদের এদেশীয় মিত্ররা বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছিল যে এদেশের বুদ্ধিজীবীরা তাদের জন্য একটি বড় হুমকি। তাঁরাই সাধারণ মানুষের মাঝে বিদ্রোহের বীজ বপন করেছিল। তাঁদের দ্বারাই প্রতিবাদের ধ্বনি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছিল এবং তাঁদের দ্বারাই সাধারণ মানুষের মধ্যে কর্তৃত্বকে অস্বীকার করার সাহস জন্মেছিল। তাই সাধারণ জনগণের শক্তির উৎস যদি ছেঁটে ফেলা যায়, তাহলে তাদের বশীভূত রাখার বাকি কাজটা সহজ হবে। এমন একটি ঘৃণ্য পরিকল্পনা নিয়ে ঘাতকরা কাজ করেছিল এবং অনেকাংশে সফল হয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায় বুদ্ধিজীবীদের নির্মূল করার ষড়যন্ত্রটি এঁকেছিলেন জেনারেল রাও ফরমান আলী, যাকে সহায়তা করেছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশির এবং ক্যাপ্টেন কাইয়ুম এবং গোলাম আযম ও মওলানা মান্নানের মতো কুখ্যাত বাঙালি মাস্টারমাইন্ডরা।

১৯৭১ সালের নভেম্বরের দিকে পশ্চিম পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী সাব-জোনাল মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর ব্রিগেডিয়ার বশিরের নেতৃত্বে আল-বদর, আল-শামসকে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে ব্রিফ করা শুরু করে। পরিকল্পনার সুবিধার্থে ৪ ডিসেম্বর থেকে কারফিউ ও ব্ল্যাকআউট জারি করা হয়। ১০ ডিসেম্বর থেকে বুদ্ধিজীবী হত্যা নিধন পুরোদমে শুরু করা হয়। ব্ল্যাকআউটের সময় আল-বদররা ঘরে ঘরে গিয়ে তালিকাভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যায় এবং নির্মমভাবে হত্যা করে। তাঁদের অনেকেই নিখোঁজ হন যাদের আর কখনও পাওয়া যায়নি। কুখ্যাত চরিত্র চৌধুরী মাইনুদ্দিনের নেতৃত্বে আলবদর, আল-শামস বাহিনী এবং তাদের সহযোগীরা সবচেয়ে জঘন্য এই কাজটি করেছিল। কালো পোশাক পরে তারা বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে যায়, মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, ধানমন্ডি হাই স্কুল এবং এমএলএ হোস্টেলের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রাখে। নির্মম নির্যাতনের পর রায়েরবাজারের একটি ইটভাটায় এবং মিরপুরের একটি জলাভূমিতে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। প্রতিবছর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালনের মাধ্যমে আমরা জাতির শ্রেষ্ঠ মেধাবী সন্তানদের স্মরণ করি। প্রতিবছর বিজয়ের এই মাসে আনন্দের পাশাপাশি  এই দিনে আমরা শোকে মুহ্যমান হই।  আমরা স্মরণ করি যে, আমরা শুধু স্বাধীনতা অর্জনই করিনি; এর জন্য আমরা অনেক বেশি মূল্য দিয়েছি এবং বিশ্বকে প্রমাণ করেছি যে আমরা একটি সম্পূর্ণ অত্যাচারী শাসক থেকে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। দুঃখজনক হলেও সত্য বিজয়ের পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তে লেখা ইতিহাস বারবার বিকৃত করা হয়েছে। তাদেরকে যথাযথভাবে স্মরণ করা হয়নি। মিথ্যা ইতিহাস রচনা করা হয়েছে। মহান মুক্তিযুদ্ধের খলনায়কদের নায়ক বানানো হয়েছে। কিন্তু বেশি দিন এ মিথ্যা ইতিহাস টেকেনি। তাঁরা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়েছে।

বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। আমৃত্যু তাঁরা তাঁদের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে দেশের জন্য কাজ করে গেছেন। দেশের মানুষের অধিকার আদায়ে তাঁরা তাদের অবস্থানে অটল ছিলেন। তাঁরা দেশের জন্য ত্যাগের মহান আদর্শ স্থাপন করেছেন। সেই আদর্শ অনুযায়ী আমরা নিজেদেরকে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলব। তাহলেই শহিদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি ও মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদ লাখো বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সম্ভ্রম হারানো লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানো সম্ভব হবে। বলা হয়ে থাকে প্রকৃত বুদ্ধিজীবীরা কখনই তাদের সময় ও চারপাশের জগৎ বা চলমান ঘটনা নিয়ে সন্তষ্ঠ থাকে না। জাতির বৃহত্তর কল্যাণে, অন্যায় ও অপশক্তির বিরুদ্ধে তাঁরা জাতিকে ন্যায়ের দিকনির্দেশনা প্রদান করেন। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও তাঁরা সেই কাজটি করেছিলেন। আর এজন্যই শাসকগোষ্ঠী তাঁদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। 

কাজেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী ও দেশরিরোধী সকল অপশক্তির বিরুদ্ধে আমাদেরেকে একতাবদ্ধ হয়ে রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ, অপশক্তির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর শিক্ষা মুক্তিযুদ্ধে শহিদ বুদ্ধিজীবীরাই তাঁদের জীবন দিয়ে আমাদেরকে শিখিয়ে গেছেন। আর এভাবেই শহিদ বুদ্ধিজীবীদের রক্তের ঋণ পরিশোধ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে। নতুবা তাঁদের রক্তের ঋণ শোধ করা কখনও সম্ভব হবে না।

লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

বাবু/জেএম

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত