ফুটবলের ইতিহাস দীর্ঘ। খেলাটির জন্ম কোথায়, কখন তা নিয়ে মতভেদ আছে। খেলাধুলার জন্মের ইতিহাস নিয়ে এ মতভেদ থাকারই কথা। এটা তো আর কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের মতো না যে কেউ গবেষণা ক'রে বের করেছে। জন্ম/উৎপত্তি যখন যেখানেই হোক, ফুটবলের প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে ১৮৭২ সালে ইংল্যান্ড-স্কটল্যান্ডের একটি ম্যাচকে।
ফুটবলের ইতিহাস শতবছরের পুরোনো হলেও ‘সেরা ফুটবলার’ আলোচনায় ষাটের দশকের আগে যেতে দেখা যায় না। আগের খেলোয়াড়েরা আলোচনায় আসে না, তারা হারিয়েই গেছে। ওই সময়ে বিস্তৃত পরিসরে প্রচারমাধ্যম, যোগাযোগমাধ্যম না থাকায় খেলাধুলা স্টেডিয়ামের বাইরে আসতো না এবং খেলা ধারণকৃত না থাকায় আজকের মানুষও তা দেখতে-জানতে পারছে না, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করাও সম্ভব হচ্ছে না। ফলে তারা আলোচনায় নেই।
সেরা ফুটবলার কে, কার মতে কে সেরা, কোন দশকের কে সেরা, কোন পজিশনে কে সেরা, ইত্যাদি ‘সেরা’ নির্বাচন যুগযুগ ধ'রে চলছে; বিভিন্ন সংস্থা, প্রচারমাধ্যম অগণিত জরিপ চালিয়েছে। কিন্তু খেলোয়াড়-সংখ্যা অগণিত নয়, ঘুরেফিরে প্রত্যেক দশক থেকে নির্দিষ্ট কিছু খেলোয়াড়ের নামই উঠে এসেছে তালিকায়। ডি স্টেফানো, লেভ ইয়াসিন, ফন্তেইন, গারিঞ্চা, পেলে, ইউসেবিও, বেকেনবাওয়ার, চার্লটন, পুসকাস, রিভেলিনো, জার্ড মুলার, ক্রুইফ, জর্জ বেস্ট, জিকো, প্লাতিনি, সক্রেটিস, ফ্যালকাও, রসি, মারাদোনা, ম্যাথাউস, বাস্তেন, গুলিত, হ্যাজি, স্টইচকোভ, বার্গক্যাম্প, ডেল পিয়েরো, রোমারিও, ব্যাজ্জিও, মালদিনি, ফিগো, কার্লোস, রোনালদো, রিভালদো, জিদান, রোনালদিনহো, অঁরি, ফোরলান, জাভি, ইনিয়েস্তা, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, মেসি এই নামগুলো সেরাদের তালিকায় অবধারিতভাবে এসেছে।
ইউটিউব যুগের আগে ‘সেই সময়ের’ খেলোয়াড়দের সম্পর্কে জানা যেত শুধু পত্রিকা প'ড়ে। ইউটিউব যুগে প্রবেশের পর খুব সহজেই সেসব খেলোয়াড়ের খেলা দেখা যাচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভিডিও দেখা যায়। ফলে কল্পরাজ্যে ভেসে বেড়ানো কিংবদন্তিরা কেমন খেলতেন তা আজ হাতের মুঠোয়, খুব কাছের, অতিপরিচিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কোনো এক শ্রেণিতে পেলেকে নিয়ে একটা লেখা পাঠ্য ছিল ‘ফুটবলের রাজা’ শিরোনামে। সেটা পড়াতে গিয়ে শিক্ষক এমন এক বর্ণনা করলেন যা শুনে আমরা পেলেকে ভালোবেসে ফেললাম, আর ব্রাজিল দেশটার প্রতিও অনুরাগ জন্মালো। একবার পেলে গোলপোস্টে শট করলেন কিন্তু বল বারে লেগে ফিরে আসলো। পেলে বললেন গোলবার দুইঞ্চি ছোট আছে। মেপে দেখা গেল তিনি ঠিক বলেছেন! পেলে এতো দক্ষ খেলোয়াড় ছিলেন যে পেনাল্টি কিক তিনি উল্টোদিকে হয়ে গোড়ালি দিয়ে মেরেই গোল করতেন (বড় যেকোনো খেলোয়াড় সম্পর্কেই এ ধরনের গল্পের প্রচলন ছিল তখন)। শিক্ষকের মুখে এসব অতিমানবীয় দক্ষতার বর্ণনা শুনে ভক্ত না হয়ে উপায় কী! ইউটিউব যুগের আগে সেই সময়ের খেলোয়াড়দের খেলা ‘না-জানি-কেমন-ছিল’, ‘যদি একটু দেখতে পারতাম’, এ ধরনের বিস্ময় ও আকাক্সক্ষামাখা ছিল। তাদের ঘিরে অনেক কল্পনা মনে জায়গা ক'রে নিতো।
আমি যাদের খেলা সরাসরি দেখেছি তাদের মধ্যে ডেনিস বার্গক্যাম্প, রোনালদো নাজারিও, রবার্তো কার্লোস, দিয়েগো ফোরলান আমার খুব পছন্দের। যাদের খেলা সরাসরি দেখা হয়নি কিন্তু ইউটিউবে দেখেছি তাদের মধ্যে পেলে, জর্জ বেস্ট, জিকো, ফ্যালকাও, মারাদোনা সেরা [মারাদোনার খেলা ’৯৪ বিশ্বকাপে সরাসরি দেখলেও তার সেরা সময়ের খেলা (’৮৬ ও ’৯০) ইউটিউবে দেখতে হয়েছে]। অন্যদিকে, নামকরাদের অনেককেই ওভাররেটেড মনে হয়েছে; প্রথমেই যে নামটি আসবে ইয়োহান ক্রুইফ। আর আন্ডাররেটেড কারো নাম করতে চাইলে তিনি ডেনিস বার্গক্যাম্প; এমন একজন ব্রিলিয়ান্ট খেলোয়াড়কে নিয়ে আলোচনা তেমন হয় না! সবাইকে ছাপিয়ে আমার সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় লুইস নাজারিও ডি লিমা রোনালদো। স্কিল, গতি, ড্রিবলিং, স্কোরিং অ্যাবিলিটি, উভয় পায়ের কার্যকারিতা, সবকিছুর সমন্বয় ঘটেছে এই ফুটবলারের মধ্যে। একজন পরিপূর্ণ ফুটবলার ছিলেন তিনি।
রোনালদো নাজারিও ১৭ বছর বয়সে জাতীয় দলে ডাক পান। ১৯৯৪ বিশ্বকাপ জয়ী ব্রাজিল দলের সদস্য ছিলেন। ব্রাজিল দেশটিকে মানুষ বলে ‘ফুটবলার তৈরির কারখানা’। তেমন একটি দেশের বিশ্বকাপ স্কোয়াডে এই ‘অপরিণত’ বয়সেই জায়গা পাওয়া তাঁর প্রতিভাকে নির্দেশ করে। তাঁকে ‘দ্য ফেনোমেনন’ (বিস্ময় মানব) উপাধি দেওয়া হয়। বল ড্রিবলিঙে ছিল তাঁর বহুমুখী পারদর্শিতা। স্টেপওভার, নাটমেগ, টো পোক, ট্র্যাপিং, ভলি, ডামি, ফ্লিপ ফ্ল্যাপ (ইলাসটিকো/বডি ডজ) একপায়ে এতো বৈচিত্র্যময় দক্ষতা অন্য কারও মধ্যে দেখা যায় না। নাজারিওর ডজে তাঁর মার্কাররা শুধু পর্যদুস্ত হতো না, ভূপাতিত হতো। রোনালদো দ্য ফেনোমেনন প্রদীপের আলোয় থেকে ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ খেলতে আসেন। টুর্নামেন্টে প্রত্যাশা মতোই খেলে চলেন। কিন্তু ফাইনালে রহস্যময় এক খিচুনির কারণে নিষ্প্রভ ছিলেন। সেদিন দল হারলেও টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার ‘গোল্ডেন বল’ জিতে নেন তিনি।
এরপর ১৯৯৯-২০০০ সালে মারাত্মক হাঁটুর ইনজুরিতে পড়েন। অনেকে তাঁর ক্যারিয়ারের শেষ দেখে ফেলেছিলেন। কিন্তু ২০০২ বিশ্বকাপের আগে আবার দলে ফেরেন। দোর্দণ্ড প্রতাপে খেলে ব্রাজিলকে এনে দেন পঞ্চম শিরোপা। আট গোল করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়ে জিতে নেন গোল্ডেন বুট। তিনি তিনবার ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলারের পুরস্কার পান। সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে (২০ বছর বয়সে) এই পুরস্কার জয়ের রেকর্ডটি এখনো তাঁর। রোনালদো সম্পর্কে একটি অভিযোগ আছে তিনি অলস ছিলেন, অধিকাংশ সময় প্রতিপক্ষের অর্ধেকে কাটাতেন। কথাটি অর্ধসত্য। ইনজুরির আগে তিনি মাঠজুড়ে খেলতেন। কিন্তু ইনজুরির পর নিজেকে নিরাপদ ও ক্যারিয়ার অক্ষুণ্ন রাখতে স্বাভাবিক গতিতে কিছুটা রাস টানতে বাধ্য হয়েছিলেন। তারপরও ২০০২ বিশ্বকাপে তাঁর পারফরম্যান্স দেখে কে বলবে তাঁর গতি কম!
‘দ্য ফেনোমেনন’ রোনালদো দুটো বিশ্বকাপ জয়ী দলের সদস্য, হয়েছেন ফিফা বর্ষসেরা ফুটবলার, জিতেছেন গোল্ডেন বল, গোল্ডেন বুট। তাঁর পায়ের কাজ ছিল বৈচিত্র্যে ভরা ও কার্যকর। এমন একজন ফুটবলারকে সর্বকালের সেরা বলতে দ্বিধা কোথায়?
লেখক : সমালোচক ও বিশ্লেষক
বাবু/জেএম