শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ২ হাজার ৫১১ কোটি টাকার ‘সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্পে’ যারা বিজ্ঞান বিষয়ে বিশেষজ্ঞ তাদেরকে অগ্রাধিকার না দিয়ে কেন অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এ নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এ প্রকল্পের পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক এবং গবেষণা কর্মকর্তা কেউই বিজ্ঞান বিষয়ের বিশেষজ্ঞ নন।
এছাড়া এ প্রকল্পে বিস্তর অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের মেয়াদ গত জুনে শেষ হলেও কাজ বাকি রয়েছে এখনও প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ। এরই মধ্যে প্রকল্পের মেয়াদ আরো দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত নির্মাণাধীন ২০০টি ভবনের একটিরও কাজ সম্পূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়নি। তবে নতুন ভবনের জন্য আসবাবসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনাকাটা থেমে নেই। এসব কিনতে গিয়ে দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছেন প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা।
এরই মধ্যে বিভিন্ন দৈনিকে এ প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন হওয়ায় দুদক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি তদন্ত কমিটি করেছে। তদন্ত কমিটি সভাপতি প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম, সদস্য সচিব মহিউদ্দিন আহমদ এবং সদস্য এনামুল হক হাওলাদার।
জানা যায়, দেশের ২০০ সরকারি কলেজে বিজ্ঞান শিক্ষার বিদ্যমান সুযোগ সম্প্রসারণসহ অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যমান আইটি সরঞ্জাম এবং আরও উন্নতমানের তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ, শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষকের পদ সৃজন, সরকারি কলেজসমূহের মধ্যে আঞ্চলিক অসমতা দূরীকরণ, ক্রমবর্ধমান শিক্ষার্থীর চাহিদা পূরণ, অধিকতর শিখন-শিক্ষণ সুযোগ সৃষ্টি, দেশের দুর্গম এলাকার কলেজসমূহে ৪৭টি ছাত্র/ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণ ও বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি সরবরাহের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিই এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য।
কিন্তু এ প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে বিজ্ঞান বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তাদেরকে অগ্রাধিকার না দিয়ে কেন অন্য বিষয়ের শিক্ষকদের এখানে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তা খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন কর্মকর্তা।
বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ এ প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক, উপপরিচালক, সহকারী পরিচালক এবং গবেষণা কর্মকর্তা কেউই বিজ্ঞান বিষয়ে বিষেশজ্ঞ নন। জানা যায় এ প্রকল্পের পরিচালক খন্দকার মুজাহিদুল হক এবং সহকারী প্রকল্প পরিচালক সরফুদ্দিন আবু ইউসুফ রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। প্রকল্প উপপরিচালক জেসমিন তাসলিমা বানু দর্শন এবং গবেষণা কর্মকর্তা মো. সোলায়মান ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক। তবে গবেষণা কর্মকর্তা মো. সোলায়মান এরই মধ্যে অন্যত্র বদলি হয়ে চলে গেছেন। তাছাড়া গবেষণা কর্মকর্তা ইব্রাহীম মিয়া প্রকিউরমেন্ট কাজের সাথে জড়িত। গবেষণা কর্মকর্তার পদটি অষ্টম গ্রেডের। কিন্তু ইব্রাহীম মিয়া ৩৬তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারের নবীন ও নবম গ্রেডের কর্মকর্তা হয়েও অষ্টম গ্রেডের পদে কীভাবে চাকরি করেন তা বোধগম্য নয়।
আরো জানা যায়, ২ হাজার ৫১১ কোটি টাকার ‘সরকারি কলেজসমূহে বিজ্ঞান শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণ প্রকল্প’শুরু হয় ২০১৮ সালের ১ জুলাই। এ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০২২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে মাত্র চার ভাগের একভাগ। এই প্রকল্পের অধীনে ২০০ সরকারি কলেজে অবকাঠামো উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক আইসিটি ও বৈজ্ঞানিক সরঞ্জাম সরবরাহ, শিক্ষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ নানা কাজ করার কথা। এখন পর্যন্ত একটি ভবনও হস্তান্তর করা সম্ভব না হলেও ২০০ কলেজের জন্য কেনা হয়েছে ২০০ ডিজিটাল ক্যামেরা, সিসি ক্যামেরার আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র। অর্থাৎ মূল কাজ না এগোলেও অব্যাহত আছে কেনাকাটা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ডিজিটাল ক্যামেরা কিনতে নিষেধ করা হলেও তা এই প্রকল্প থেকে মানা হয়নি। তবে এখন অব্যবহৃত থেকে ক্যামেরাগুলোর ওয়ারেন্টি শেষ হয়ে যাচ্ছে। এমনকি প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই হয়তো ক্যামেরাগুলো তাদের কার্যক্ষমতাও হারাতে পারে। এছাড়া প্রকল্প অফিসের জন্য কয়েক কোটি টাকায় কেনা হয়েছে দামি দামি আসবাব, বিভিন্ন ধরনের অফিস সরঞ্জামসহ অত্যাধুনিক গাড়ি। বর্তমানে প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়েছে।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায় সম্প্রতি সরকারি ক্রয় নীতিমালা (পিপিআর) লঙ্ঘন করে প্রথম ৬ জনকে বাদ দিয়ে আসবাব সরবরাহের কাজ দেওয়া হয়েছে সপ্তম এবং চতুর্থ দরদাতাকে। আসবাব প্রস্তুতকারী দেশের বড় নামিদামি প্রতিষ্ঠান সর্বনিম্ন দরদাতা হওয়ার পরও তাদের কাজ দেওয়া হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান এর আগে নানা অনিয়মের অভিযোগে এই প্রকল্পের প্রথম পরিচালককে গত বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রত্যাহার করে নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর খন্দকার মুজাহিদুল হক যোগদান করেন গত বছরের ৫ মে। আগের পরিচালককে যেসব কারণে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বর্তমান পরিচালকও এখন একই ঘটনা ঘটাচ্ছেন। বর্তমান প্রকল্প পরিচালক খন্দকার মুজাহিদুল হক কেনাকাটার ক্ষেত্রে এমন ক্রাইটেরিয়া সেট করেন যাতে কোনো বিশেষ কোম্পানি কাজ নিতে পারে। এর ফলে বার বার একই কোম্পানি কাজ পায় এবং সেই কোম্পানি থেকে অনৈতিকভাবে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকেন প্রকল্প পরিচালকসহ তার সিন্ডিকেট।
প্রকল্প পরিচালকের বিরুদ্ধে এমনও অভিযোগ রয়েছ ফার্নিচার, কম্পিউটার ও ল্যাবের যন্ত্রপাতি ক্রয়সংক্রান্ত বিষয়ে ইভাল্যুয়েশন কমিটি তার হস্তক্ষেপে কখনো কখনো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে না। ইভাল্যুয়েশন কমিটিকে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন প্রকল্প পরিচালক। ফলে এ নির্দেশনা মানা ছাড়া উক্ত কমিটির অন্য কোনো গত্যন্তর থাকে না।
তদন্ত কমিটির বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তারা আরো জানান তদন্ত কমিটি নির্ধারিত একটি প্রেসক্র্যাইবড ফরমে কর্মকর্তাদের কাছ থেকে লিখিত নেওয়া হচ্ছে। যেখানে ‘প্রোযোজ্য নয়’ হবে এমন জায়গায় কর্মকর্তাদের লিখিত দিতে হয়েছে, ‘আমার জানা ও বিশ্বাস মতে প্রকল্পে অনিয়ম হয়নি’ এমন মন্তব্য। কর্মকর্তারা এমন মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন কারণ তাদের এসিআর প্রকল্প পরিচালকের হাতে রয়েছে। যদি তারা এমন মন্তব্য না দেন, তাহলে প্রকল্প পরিচালক তাদের এসিআর-এ রিপোর্ট খারাপ দিতে পারে। এমন ভীতি থেকে সব কর্মকর্তাই এমন লিখিত দিতে বাধ্য হয়েছেন।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায় এ প্রকল্পের তদন্ত করতে গিয়ে তদন্ত কমিটি কোনো কর্মকর্তার আলাদা করে কোনো মতামত নেয়নি। তাই কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে তথ্য দিতে পারেননি। তদন্ত কমিটি যদি আলাদা আলাদাভাবে প্রকল্পের সাথে জড়িত কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য ও মতামত জানতে চাইত, তাহলে তারা স্বাধীনভাবে তথ্য দিয়ে তদন্ত কমিটিতে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত কার্যক্রমে সহায়তা করতে পারত বলে জানান নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক কর্মকর্তা।
তাছাড়া এ প্রকল্পের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং তদন্ত কমিটি একই ক্যাডারভুক্ত (বিসিএস সাধারণ শিক্ষা) হওয়ায় নিরপেক্ষ তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। যদি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্বাধীন তদন্ত কমিটি হত তাহলে এ প্রকল্পের অনিয়ম বিস্তারিতভাবে উঠে আসত বলে মনে করেন অনেক কর্মকর্তা।
এ বিষয়ে তদন্ত কমিটির সাথে কথা বলার চেষ্টা করা হলেও কমিটির সভাপতি প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম ও সদস্য এনামুল হক হাওলাদার ফোন ধরেননি। তবে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব মহিউদ্দিন আহমদের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, আমরা বিস্তরভাবে তদন্ত করছি। তদন্তের কাজ শেষ, খুব শীঘ্রই প্রতিবেদন জমা দেব। প্রকল্পের কর্মকর্তাবৃন্দ এবং তদন্ত কমিটি কর্মকর্তরা একই ক্যাডারভুক্ত হওয়ায় নিরপেক্ষ তদন্ত নিয়ে সংশয় প্রকাশ করলে তিনি বলেন, আমরা সার্ভিস রুল অনুযায়ী তদন্ত করছি। এখানে আমাদের কারো পক্ষে কিংবা বিপক্ষে কোনো রিপোর্ট দেওয়ার কিছু নেই। তদন্তে যা উঠে আসছে তা-ই দাখিল করা হবে।
-বাবু/এ.এস