আমি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। আমার নাম দেবেশ চন্দ্র সান্যাল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন পর্যন্ত আমাদের দেশে মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমি দেশের ক্রান্তিকালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলাম। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র নিয়ে পকিস্তানি সৈন্য ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বিরুদ্ধে গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। যাত্রা করার দিনটি ছিল ২৩ জুলাই ১৯৭১ (৬ শ্রাবণ ১৩৭৮) শুক্রবার। রাত ৯টায় আমি শাহজাদপুরের তদানীন্তন এমপিএ আব্দুর রহমান স্যারের সাথে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য ভারতের উদ্দ্যেশে রওনা হলাম।
আমরা এক সাথে ২২ জন রওনা হলাম। পাকিস্তানি হানাদারেরা ২৫ মার্চ ১৯৭১ রাত ১১টার পর ‘অপারেশন সার্চলাইট’ পরিকল্পনা করে বিশে্বর জখন্নতম জালাও, পোড়াও ও হত্যাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কাজ শুরু করেছে। তখন সারাদেশের অধিকাংশ স্থান পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে। টিক্কা খানের প্রলোভনে ’৭০-এর নির্বাচনে পরাজিত আমাদের দেশের জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ ইসলামী রাজনৈতিক দল তাদের সহযোগী হয়েছে। এ দেশীয় দোসরদের নেতৃত্বে সারাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করার জন্য পিচ কমিটি, রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ও অন্যান্য বাহিনী গড়ে উঠেছে। সারাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যরা জালাও, পোড়াও, লুটতরাজ, হত্যা, গণহত্যা নারী নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কাজ করে চলেছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রধান টার্গেট ছিল এদেশের হিন্দুরা। পাকিস্তানি হানাদারেরা এদেশের হিন্দুদের খুঁজে বের করার জন্য মানুষকে জিজ্ঞেস করতো। মালাউন কাহা হ্যায়। পুরুষ কাউকে ধরলে বলত তুম মুসলিম হ্যায়? কলেমা বাতাও। উলঙ্গ করে হিন্দু-মুসলমান পরীক্ষা করত। পাকিস্তানি সৈন্যদের সহযোগিতা করছে এদেশের বিভিন্ন স্বাধীনতাবিরোধীরা।
আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলে নিশ্চিত মারা যাব। এই ভেবে বাবা-মা কিছুতেই মুক্তিযুদ্ধে যেতে সম্মতি দিতেন না। তাই বাবা-মা ও পরিবারের অন্য কেউকে না জানিয়ে ভারতের উদ্দেশে রওনা হলাম। রওনা হওয়ার আগে মাকে একটা চিরকুট লিখলাম। ‘মা, প্রনণম নিও, বাবাকে আমার প্রণাম দিও। বড় দাদা, মেজদাদা, ও বৌদিকে প্রণাম দিও। ছোটভাই-বোনকে স্নেহাশিষ দিও। আমি মুক্তিযুদ্ধে গেলাম। তোমাদেরকে বলে গেলে যেতে দিতে না, এজন্য না বলে চলে গেলাম। অপরাধ ক্ষমা করিও। আশীর্বাদ করিও। আমি যেন বিজয়ী হয়ে তোমাদের কাছে ফিরে আসতে পারি। ইতি- তোমার ছেলে দেবেশ।’
যাবার সময়ে বাড়ির কাউকে জানিয়ে যাইনি। আমরা সুজানগর সাত বাড়িয়া হয়ে পদ্মা নদী পাড় হয়ে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর থানার চিলমারি ইউনিয়নের খারিজাথাক গ্রাম দিয়ে বাংলাদেশের বর্ডর অতিক্রম করলাম। আমরা ভারতের পশ্চিম বাংলার জলঙ্গী বর্ডার দিয়ে ভারতে ঢুকলাম। এমপিএ স্যার আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়ে তিনি অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের উদ্দেশে কলিকাতা চলে গেলেন। আমি প্রথমে ভর্তি হলাম কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। বয়সের স্বল্পতার কারণে প্রথম ট্রেনিং কর্তৃপক্ষ আমাকে ভর্তি করতে চাইলেন না। কয়েক দিন ভারতের বিভিন্ন আত্মীয় বাড়িতে ঘুরলাম। আবার ফিরে এলাম কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে। আমাকে ভর্তি করার জন্য বিশেষ অনুরোধ করলাম। কর্তৃপক্ষ আমার একটা ইন্টারভিউ নিলেন। আমার দেশপ্রেম, সাহসী মনোভাব ও অন্যান্য শুনে ভর্র্তি করলেন। প্রাথমিক ট্রেনিংক্যাম্পে শুধু আমাদের জাতীয় সংগীত গাওয়ানো হতো। আর পিটি-প্যারেড করানো হত। কদিন কামারপাড়া ইয়ুথ ক্যাম্পে থাকার পর আমাকে, রবীন্দ্রনাথ বাগচী, রতন কুমার দাস ও নজরুল ইসলামকে ট্রান্সফার করলো মালঞ্চ ট্রানজিট ক্যাম্পে, তারপর মালঞ্চ থেকে কুড়মাইল ট্রানজিট ক্যাম্পে। কুড়মাইল থেকে আমাদেরকে আনা হলো পতিরাম ক্যাম্পে। পতিরাম ক্যাম্প থেকে এক যোগে ভারতীয় আর্মি লরিতে ২০-২২ জনকে নিয়ে আসা হলো দাজিলিং জেলার শিলিগুড়ি মহকুমার পানিঘাটার ইন্ডিয়ান আর্মি ট্রেনিং ক্যাম্পে।
প্রশিক্ষণ শুরুর দিনে কো-অর্ডিনেটর প্রথমে প্রশিক্ষণের বিভিন্ন নিয়মকানুন বিষয়ে বললেন। তারপর তিনি বললেন দুপুর ১২টায় প্রশিক্ষণ প্রধান ডি এস ভিলন স্যার আসবেন। ঠিক দুপুর ১২টায় প্রশিক্ষণ প্রধান শিখসেনা ডি এস ভিলন এলেন। তিনি আমাদের সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘... আপনাদেরকে স্যালুট। আপনারা বীর, আপনারা আপনাদের দেশমাতাকে হানাদার মুক্ত করতে যুদ্ধ করতে এসেছেন। আমরা আপনাদের জন্য তেমন কিছু করতে পারব না। আমরা মানবিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিব। আপনাদের দেশকে আপনাদেরই স্বাধীন করতে হবে। আপনাদের জন্মদাতা পিতা-মাতাকে স্যালুট জানাচ্ছি। তাঁরা দেশের জন্য তাঁদের সন্তানদের কে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন...।’
পানিঘাটা ট্রেনিং ক্যাম্পটি ছিল ভারতের শিলিগুড়ি মহকুমার ৭নং সেক্টর অধীন। পানিঘাটা স্থানটি ছিল চারদিকে পাহাড়ের মধ্যে। কার্শিয়ান পাহাড় হইতে নেমে আসা একটি ক্যানেলের দক্ষিণ পার্শ্বের বনাঞ্চল। চাঁনমারি স্থানের বামপাশে পাহাড় থেকে নেমে এসেছে ঝর্ণার জল। ক্যাম্পে নিয়ে আমাদের তাবুর মধ্যে থাকার সিট করে দিল। আমাদের প্রত্যেককে একটা মগ, একটা প্লেট, দুইটা প্যান্ট, ২টা গেঞ্জি, একটি মশারি, ও বিছানাপত্র দেওয়া হল। ট্রেনিং শুরু হল। আমাদের ২১ দিনের ট্রেনিং হল। আমাদেরকে থ্রিনট-থ্রি রাইফেল, এলএমজি, এসএলআর, স্টেনগান, টুইঞ্চ মর্টার, হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ, এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার, ফাস্টএইডসহ অন্যান্য ট্রেনিং দিল। যুদ্ধে সহযোদ্ধা আহত হলে বা শহীদ হলে করণীয় সর্ম্পকে এবং ফাস্টএইড সম্পর্কে ধারণা দিল। ভারতীয় কয়েক জন হিন্দু বিহারি ও শিখ সৈন্য প্রশিক্ষণ দিল আমাদের কোম্পানির। প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন শিখ সেনা ডি. এস. ভিলন। তাঁর কাছ থেকে জানলাম আমার এফ.এফ নং-৪৭৪২।
ট্রেনিং শেষে আমাকে, রবীন্দ্র নাথ বাগচী, নজরুল ইসলাম ও রতন কুমার দাসকে নিয়ে আসা হল ৭নং সেক্টরের হেড কোয়ার্টার কালিয়াগঞ্জ থানার তরঙ্গপুরে। তরঙ্গপুর এনে সিরাজগঞ্জ জেলার ১০ জনের সমন্বয়ে একটি গেরিলা গ্রুপ করা হল। আমাদের গ্রুপের গ্রুপ লিডার হলেন বেলুকুচি উপজেলার তামাই গ্রামের এম এ মান্নান। ডেপুটি লিডার নিযুক্ত হলেন শাহজাদপুর উপজেলার জামিরতা গ্রামের অধিবাসী বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী। আমাদেরকে তরঙ্গপুর থেকে অস্ত্র, গোলা-বারুদ, রেশনিং ও পকেটমানি দেওয়া হল। আমার নামে একটি থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, এক ম্যাগজিন গুলি, একটি হেলমেট ইস্যু করা হল। অন্যান্য গোলা বারুদ, মাইন গ্রেনেড ও এক্সপ্লোসিভ কমান্ডার স্যারের কাছে দিলেন। মৃত্যু যে হবে না এমন কোনো গ্যারান্টি ছিল না। তাই আমি তরঙ্গপুর বাজার থেকে একখানা শ্রী শ্রী চন্ডী গ্রন্থ, একটি মানচিত্রখচিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও একটি ৪ ব্যান্ডের রেডিও কিনলাম। তরঙ্গপুর থেকে কালিয়াগঞ্জ পর্যন্ত বাসে এসে ট্রেনে উঠলাম। শিলিগুড়ি রেলওয়ে জংশন স্টেশনে এসে আমাদের ট্রেন বদলাতে হল। ট্রেন বদলিয়ে আসামগামী ট্রেনে উঠলাম। ভারতীয়রা আমাদেকে জয় বাংলার লোক বলতো। সরকারি বাস ও ট্রেনে টিকেট চাইতে এলে ‘জয় বাংলা’ বললেই আর টিকেট বা ভাড়া চাইত না।
আসামগামী ট্রেনে ধুবরী নামক স্টেশনে আমরা নামলাম। তারপর বাস যোগে মানিকার চর এলাম। রাত হয়ে যাবার কারণে রাতে মানিকার চর একটা বডিংয়ে থাকলাম। পরদিন সকালে নদী পার হয়ে এলাম তদানীন্তন রংপুর জেলার কুড়িগ্রাম মহকুমার (বর্তমানে জেলা) মুক্তাঞ্চলে স্থাপিত রৌমারী মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে। রৌমারী ক্যাম্পে আমরা স্নান খাওয়া-দাওয়া করলাম। আমাদের কমান্ডার স্যার সিরাজগঞ্জ জেলার মুক্তাঞ্চল যমুনার চড়ে পৌঁছানোর জন্য একটি বড় ছইওয়ালা নৌকা ভাড়া করলেন। রৌমারী ক্যাম্প থেকে রাতের খাবার খেয়ে রাত ৯টার দিকে আমাদের নৌকা ছাড়ল ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। নৌকা বাহাদুরাবাদ ঘাট, জগন্নাথগঞ্জ ঘাট ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা দিয়ে আসতে হয়। আমরা জানতে পেরেছিলাম। বাহাদুরাবাদ ঘাট অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। ঐ ক্যাম্পের পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকারেরা ভয়ানক। তারা স্পিডবোট নিয়ে রাতে নদী টইল দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের নৌকা পেলে ধরে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে অমানুষিক অত্যাচার করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমাদের কমান্ডার এমএ মান্নান স্যার নির্দেশ দিলেন ‘আপনারা সবাই নৌকার ডওরার মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকুন। পাকিস্তানি হানাদারেরা ধরতে এলে আমরা ধরা দিব না। যুদ্ধ করব। যুদ্ধ করে শহীদ হব কিন্তু ওদের হাতে ধরা দিব না।’ রাত ২টার দিকে আমরা বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করতে থাকলাম। ওদের সার্চলাইটের আলো এসে বার বার আমাদের নৌকাতে পড়ছিল। কিন্তু ওরা আর স্পিডবাট নিয়ে ধরতে এলো না। আমরা বাহাদুরাবাদ ঘাট এলাকা অতিক্রম করলাম। আমাদের সাথে চিড়া-গুড় ছিল। ভোরে মাঝিরা এক কাইসা খেতের মধ্যে নৌকা ঢুকিয়ে দিল। আমরা নিচে নেমে খেতের মধ্যে প্রস্রাব পায়খানা করলাম।
আমাদের সাথে থাকা চিড়া-গুড় দিয়ে সকালের জলখাবার খেলাম। তার পর নৌকা আবার ছাড়ল। তখন কাজিপুর থানার অধিকাংশ এলাকা পাকিস্তানি হানাদারদের দখলে। কাজিপুর থানার সম্মুখ দিয়ে আমাদের নৌকা আসবে। দেখে-শুনে খোঁজ নিয়ে থামিয়ে থামিয়ে ৪ দিন পরে নৌকা এসে পৌছালো সিরাজগঞ্জ হানাদার মুক্তাঞ্চল যমুনার চরে, টাঙ্গাইল জেলার সিংগুলির চড়ের নিকটবর্তী। নৌকাতেই রান্নার ব্যবস্থা ছিল। মাঝিরা কোনো রকমে ডালভাত অথবা খিচুরি রান্না করে আমাদের খাওয়াতো। এভাবে খেয়ে না খেয়ে চলছিলাম। পরদিন রাতে যমুনা নদীর এপাড়ে চলে এলাম। চলে এলাম বেলকুচি-কামারখন্দ নির্বাচনী এলাকার এমএনএ আব্দুল মোমিন তালুকদারের গ্রামের বাড়িতে। তিনি তখন বাড়িতে ছিলেন না। তাঁর ভাই রশিদ তালুকদার আমাদের থাকা খাওয়া ও অন্যান্য বিষয়ে সহযোগিতা করলেন। অক্টোবর ১৯৭১ মাসের মাঝা মাঝির আগ পযর্ন্ত আমাদের গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা কম থাকায় সম্মুখ যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত কমান্ডার স্যার নেননি। আমরা পাকিস্তানি হানাদার সৈন্য ও তাদের দোসরদের আতঙ্কে রাখার জন্য গেরিলা কার্যক্রম হিট এন্ড রান চালাতাম। পাকিস্তানি সৈন্য বা রাজাকার ক্যাম্পের নিকটবর্তী গিয়ে ২-৪টা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেলের আকাশমুকী ফাঁকা গুলি ছুড়ে চলে আসতাম। পাকিস্তানি দালাল, পিচ কমিটির লোক ও অন্যান্যরা আমাদের অস্তিত্বের কথা জানতে পারত। আমরা দিনের বেলা স্কুলে বা কারো বাড়িতে আত্মগোপন করে থাকতাম। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশের অভ্যন্তরে ছিল দুইটি পক্ষ। একটি স্বাধীনতার পক্ষে। অন্যটি স্বাধীনতার বিপক্ষে। স্বাধীনতার বিপক্ষের পিচ কমিটির সদস্য, রাজাকার, আলবদর, আস-শামস ও অন্যান্যরা।
স্বাধীনতাবিরোধীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের তথ্য দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে এসে বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, চাঁদাবাজি করত। বাড়ির মালিককে ধরে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যা করতো। হিন্দু ও আওয়ামী লীগ নেতারা ছিল ওদের বড় টার্গেট। হিন্দু নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে যেত। নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যা করত। বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধারাও পাকিস্তানি হানাদার পক্ষ ত্যাগ ও তাদের সহযোগিতা করার জন্য বিশেষ ভাবে অত্যাচারী পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকারদের হত্যা করতো। আমাদের গ্রুপের নীতি ছিল ‘আমরা আমাদের দেশি কোনো ভাইকে হত্যা করব না। বুঝিয়ে তাদেরকে স্বাধীনতার পক্ষে আনাব’ যে কারণে আমাদের মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ কোনো স্বাধীনতাবিরোধীকে ধরিনি, অত্যাচার বা হত্যা করিনি। আমরা নিজেরা বা তাদের আত্মীয়ের মাধ্যমে বুঝিয়ে বিভিন্নভাবে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বাধীনতার পক্ষে আনার চেষ্টা করতাম। আমাদের বুঝানোর কারণে দৌলতপুর গ্রামের এক রাজাকারের মাধ্যমে বেলকুচি রাজাকার ক্যাম্পের ৫ জন সশস্ত্র রাজাকার অস্ত্রসহ পালিয়ে এসে আমাদের গ্রুপের কাছে আত্মসমর্পন করে ছিল। আমরাও প্রতিটি মুহূর্তে আতঙ্কে থাকতাম। যেকোনো সময় পাকিস্তানি হানাদাররা আমাদের আক্রমণ করতে পারে। আমাদের থাকা-খাবারে কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। আমরা আজ এ শেল্টারে কাল সে শেল্টারে থাকতাম। কোনো শেল্টারেই একাধিক দিন থাকতাম না। কোনো কোনো দিন শেল্টারের অভাবে সারারাত চিড়া-গুড় খেয়ে রাত্রি জেগে স্কুলের বেঞ্চে শুয়ে থাকতে হত। কী যে অমানবিক কষ্ট। আমাদের শেল্টার পালাক্রমে আমরা দু’জন করে করে পাহাড়া দিতাম। প্রতিরাতে কমান্ডার স্যার আমাদের পাশ ওয়ার্ড দিতেন। আমরা রাতে বিভিন্ন রাজাকারদের বাড়িতে গিয়ে তাদের বুঝাতাম। সকালে আমরা অস্ত্রে ফুল থ্রু মারতাম, পরিষ্কার করতাম ও অস্ত্রে তেল দিতাম। তখন দেশের অধিকাংশ মানুষ ছিল স্বাধীনতার পক্ষে।
তবুও স্বাধীনতাবিরোধীদের ভয়ে অনেকেই আমাদেরকে শেল্টার বা খাবার দিতে সাহস পেতেন না। কারণ অধিকাংশ গ্রামেই ছিল পাকিস্তানি দালাল ও রাজাকার। তারা খোঁজ জানলে পাশর্^বর্তী আর্মি বা রাজাকার ক্যাম্পে সংবাদ দিয়ে তাদেরকে নিয়ে এসে বাড়িঘর জালিয়ে দিবে, বাড়ির মালিককে ধরে নিয়ে হত্যা করবে ও অত্যাচার চালাবে এই ছিল তাদের ভয়। আমাদের সাথে সবসময় চিড়া-গুড় থাকত। স্থনীয় কিছু আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ট্রেনিং দেওয়ায়ে আমাদের সাথে নিলাম। আমি মুক্তিযুদ্ধে যাবার কারণে আমার পিতৃদব ও মাতৃদেবী প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। রাজাকারদের আলটিমেটামে গণহত্যার হাত হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য গোটা পরিবার বাড়িঘর ফেলে ভীষণ ঝুঁকি নিয়ে ভারতের আসামের মানিকার চড় শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। কোথাও আক্রমণের পূর্বে আমরা রেকী করে দেখতাম। তারপর আক্রমণ করতাম।
আমাদের গ্রুপের গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধগুলো হল এক. বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধ। বেলকুচি সিরাজগঞ্জ জেলার একটি উল্লেখযোগ্য থানা। এই থানা আক্রমণ যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার এম এ মান্নান স্যার। ২৪ অক্টোবর ১৯৭১ কমান্ডার স্যারের ও আরো ৩ জনের রেকিতে একযোগে বেলকুচি থানা ও মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল মতিনের বাড়ি আক্রমণ করলাম। সন্ধ্যায় বানিয়া গাতি শেল্টারে কমান্ডার স্যার বিস্তারিত ব্রিফ করলেন। আমাদের দুই গ্রুপে ভাগ করে দিলেন। সিদ্ধান্ত হল কমান্ডার স্যারের নেতৃত্বে বড় গ্রুপটি থানা আক্রমন করবে। অন্য গ্রুপটি রবীন্দ্র নাথ বাগচীর নেতৃত্বে মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমণ করে মতিন সাহেবকে ধরে আনবে। আমি কমান্ডার স্যারের গ্রুপে থেকে থানা আক্রমণ যুদ্ধে অংশ নিলাম। রাত ৯টায় বানিয়াগাতি থেকে যাত্রা করলাম। থানার কাছে গিয়ে দু’গ্রুপ টার্গের উদ্দেশ্যে ভাগ হলাম। রাত ১২টায় একযোগে আক্রমণের সিদ্ধান্ত। পরিকল্পনা মোতাবেক থানার পশ্চিম পাশ দিয়ে স্ক্রলিং করে থানার সামনে যেতেই সেন্ট্রি দেখে ফেললো। হুইসেল বাঁজিয়ে থানার সবাইকে জানিয়ে দিয়ে আমাদেরকে লক্ষ্য করে গুলি করল। আমাদের কমান্ডার স্যার কমান্ড করে ফায়ার ওপেন করলেন। আমরা সবাই একযোগে গুলি করলাম। ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ চললো। ভয়া বহ যুদ্ধ মাথায় হেল মেট। দুইটি গুলি এসে হেলমেটে লাগল। আমার ডান পার্শে^ আমার কমান্ডার। আমাদের গ্রুপে ২৭ জন। হয় বিজয় আর না হয় মৃত্যু ছাড়া কোনো পথ নাই। বৃষ্টির মত গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। থানার বিহারি পুলিশ ও রাজাকার থানার পিছনদিক দিয়ে পালিয়ে সোহাগপুর নদীতে থাকা একটি লঞ্চে চড়ে আমাদের রেঞ্জের বাইরে যমুনার মধ্যে গেল। থানার সেন্ট্রি গুলি করা বন্ধ করে দুই হাত উপরে তুলে আত্মসমর্পণ করল।
আমরা থানার ভিতরে ঢুকে পড়লাম। থানার মধ্যে গিয়ে দেখি ১ জন পুলিশ ও ২ জন রাজাকার গুলিতে মারা গেছে। আমরা থানার মাল খানা থেকে গোলাবারুদ নিলাম। থানার দু’জন রাজাকারকে জ্যান্ত চোখ-হাত বেঁধে ধরে নিয়ে এলাম। রাজাকাররা যাতে আমাদের শেল্টার চিনতে না পারে সেই জন্য তাদের চোখ বেঁধে নিয়ে এলাম। ভোর হয়ে গেল। মতিন সাহেবের বাড়ি আক্রমণ করা দলটিও এল। মতিন সাহেব পালিয়ে গেছে। তাকে ধরা সম্ভব হয়নি। থানার আশেপাশের লোকজন দোকান ও বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দিল। বিজয়ী হয়ে চলে এলাম। পরদিন সিরাজগঞ্জ থেকে শতাধিক পাকিহানাদার ও রাজাকার এসে থানার আশে পাশে আগুন দিয়েছিল এবং মানুষদের নির্যাতন করেছিল। বেলকুচি থানা আক্রমণ যুদ্ধে আমরা দুইজন রাজাকার কে ধরে এনেছিলাম। কিছু সময় চোখ বেঁধে আমাদের শেল্টারে রেখে ছিলাম। তাদেরকে চোখ বেঁধে পাশের রুমে রাখা হয়েছিল। আমি কমান্ডার স্যারের অনুমতি নিয়ে ওদের সাথে কথাবার্তা বললাম। তাদেরকে রাজাকার হওয়ার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জিজ্ঞাস করলাম শুনলাম। ওদের সাথে জিজ্ঞাসাবাদে মনে হল ওরা সহজ-সরল ও অভাবী মানুষ। ওদের বাড়িতে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা আছে। পিচ কমিটির লোকদের কথায় বিশ্বাস করে ওরা রাজাকার হয়েছে। ওরা মনে করে ছিল এটা একটা চাকরি। উপার্জন করে সংসার পরিচালনার জন্য ওরা রাজাকার হয়েছে। তারা বলল আমরা কাউকে কোনো অত্যাচার করি নাই। কোনো বাড়িঘর লুটতরাজ করিনি। পাকিস্তানি হানাদের নিয়ে এসে কোনো গণহত্যা করিনি। কোনো বাড়িতে আগুন দেয় নাই...। তাদের কথায় আমার মায়া হল। আমি তাদের চোখ বাঁধা খুলে দিলাম। তাদেরকে বিভিন্নভাবে বুঝালাম। রাত্রিতে শেল্টার পরিবর্তনের সময় কমান্ডার স্যারেকে অনুরোধ করে রাজাকার দুইজনকে ছেড়ে দিয়েছিলাম।
দুই. কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন ব্রিজ পাহাড়ারত রাজাকার ক্যাম্প অ্যাম্বুস। কালিয়া হরিপুর সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ থানার একটি রেলওয়ে স্টেশন। এই অ্যাম্বুসের নেতৃত্বে ছিলেন গ্রুপ কমান্ডার এম এ মান্নান স্যার। ৪ নভেম্বর ১৯৭১ আমাদের গ্রুপের ঝাঐল গ্রামের সিরাজগঞ্জের এমএনএ মোতাহার হোসেন তালুকদারের ভায়রা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল হামিদ তালুকদারের রেকির ভিত্তিতে কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন ব্রিজ পাহাড়ারত রাজাকার ক্যাম্প অ্যাম্বুস করেছিলাম। কমান্ডার স্যার ক্রলিং করে রেললাইনে বৈদ্যুতিক মাইন বসিয়ে আসলেন। তথ্য ছিল ঈশ্বরদী থেকে পাকহানাদার নিয়ে একটি ট্রেন সিরাজগঞ্জ যাবে। কমান্ডার স্যার ট্রেনটি উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। আমরা ধানক্ষেতের মধ্যে পজিশন অবস্থায় থাকলাম। কামান্ডার স্যারের হাতে মাইনের তার ও ব্যাটারি। টর্চলাইট ও হ্যারিকেন হাতে পাকি মিলি শিয়া ও রাজাকারেরা টহল দিচ্ছিল। ওদের পায়ে লেগে হঠাৎ আমাদের মাইনের তার বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। মাইনটি ওদের নজরে পড়ল। হুইসেল দিয়ে রাজাকারদের লাইং পজিশনে রেডি থাকতে বলল। আমাদের দিকে টর্চলাইট মেরে মেরে উর্দুতে বকাবকি করতে থাকল। ইতিমধ্যে ঈশ্বরদী থেকে সিরাজগঞ্জগামী পাকহানাদারবাহী ট্রেন এল। পাকহানাদারেরা সিগন্যাল দিল। স্টেশনে ট্রেনটি থামিয়ে দিল। ট্রেনের পাকহানাদারেরা অস্ত্র তাক করা অবস্থায় নেমে আমাদেরকে খুঁজতে থাকল। আমাদের মাইনটি ব্লাস্ট করা সম্ভব হলো না। পাকহানাদারদের সংখ্যাধিক্যতায় ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে কমান্ডার স্যার উইথড্র হওয়ার কমান্ড করলেন। পরের দিন সিরাজগঞ্জ থেকে পাকহানাদার ও রাজাকারেরা এসে কালিয়া হরিপুরের অনেক বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং গ্রামের অনেককে ধরে নির্যাতন করেছিল। আমরা কালিয়া হরিপুর রেলওয়ে ব্রিজসংলগ্ন রাজাকার ক্যাম্প অ্যাম্বুস থেকে ফিরে এসে তামাই গ্রামে কমান্ডার স্যারের বাড়িতে একত্রিত হই। কমান্ডার স্যারের মা আমাদের জন্য খাবার ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমরা কমান্ডার স্যারের বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলাম। খাওয়া-দাওয়ার পর আমাদের সবাইকে বসিয়ে কমান্ডার স্যার ব্রিফ করলেন। স্থানীয়ভাবে ট্রেনিং দেওয়া বেশ কিছু যুবককে আমাদের গ্রুপে ভর্তি করা হয়েছিল। এত বড় প্লাটুন এক শেল্টারে শেল্টার নেওয়া সমস্যা। তাই কমান্ডার স্যার ডেপুটি কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগচীকে কমান্ডার করে আমাদের ১১ জনের আর একটি গ্রুপ করে দিলেন।
তিন. কল্যাণপুর যুদ্ধ কল্যাণপুর সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার একটি গ্রাম। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী। কমান্ডার স্যারের নির্দেশে আমরা ১১জন রবীন্দ্র নাথ বাগচীর নেতৃত্বে হয়ে হেঁটে ভোরে বেলকুচি উপজেলার কল্যাণপুর নামক গ্রামে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। ৫ নভেম্বর ১৯৭১ বাড়ির মালিক আমাদের সকালের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। আমরা সারারাত নিদ্রাহীন থেকেও হেটে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। সকালের খাবার খেয়ে প্রকাশ্যে পিটি-প্যারেড করলাম। অস্ত্র পরিষ্কার করলাম। অস্ত্রে ফুলতুরি মারলাম। একজন করে ডিউটি করতে থাকলাম। অন্যান্যরা ঘুম বা রেস্টে থাকলাম। কল্যাণপুর একটি নিতৃত গ্রাম। আমাদের ধারণা ছিল এই গ্রামে পাকহানাদার ও রাজাকার আসবে না। বেলা ১০টার দিকে সেন্ট্রিরত সহযোদ্ধা রতনকুমার দাস দৌড়ে এসে জানালেন আমদেরকে ধরার জন্য বেলকুচি থানা থেকে কয়েকজন পাকহানাদার মিলে শিয়া ও রাজাকার আসছে। বওড়া গ্রামের মধ্য দিয়ে কল্যাণপুরের দিকে আসছে। দুইজন পাকিস্তানি দালাল গামছা দিয়ে মুখ বেধে নিয়ে হানাদার ও রাজাকারদের পথ চিনিয়ে নিয়ে আসছে। দূর থেকে অনুমান হল এই দলে ৫জন মিলেশিয়া এবং ৮জন রাজাকার আছে। আমাদের কমান্ডার যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা কল্যাণপুরে রাস্তার ধারে বাংকারের মতো বাঁশঝাড়ের মধ্যে পজিশন নিলাম। বাঁশঝাড়ের সামনে দিয়ে চলা রাস্তা ধরে ওরা আসছিল। আমাদের রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথে আমাদের কমান্ডার রবীন্দ্রনাথ বাগচী কমান্ড ও ফায়ার ওপেন করলেন। একলাফে হানাদারেরা রাস্তার উত্তর পার্শ্বে পজিশন নিল। ওরাও আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালাল। আমরাও একযোগে বৃষ্টির মতো গুলি ছাড়তে থাকলাম। গোলাগুলির শব্দ পেয়ে আশে পাশে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপ আমাদেরকে সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এলেন। এক ঘণ্টার অধিক সময় সম্মুখ যুদ্ধ চলল। তারপর পাকহানাদারেরা লাশ নিয়ে পিছিয়ে গেল। এই যুদ্ধে ১জন মিলেশিয়া ও ১ জন রাজাকার মারা গিয়েছিল। যুদ্ধে জয়ী হয়ে আমরা বিজয় উল্লাস করলাম। সকল স্তরের মানুষের আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হলো। এক বাড়িতে খাওয়া-দাওয়া করলাম; তারপর হেঁটে দৌলতপুর গ্রামের সহযোদ্ধা শামসুল হকের বাড়িতে শেল্টার নিলাম। কয়েক দিন দৌলতপুর, তেঞাশিয়া, খুকনী, বাজিয়ারপাড়া, দরগার চর ও অন্যান্য গ্রামে থাকতে থাকলাম।
চার. ধীতপুর যুদ্ধ ধীতপুর সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর থানার একটি গ্রাম। এই যুদ্ধে নেতৃত্বে ছিলেন ডেপুটি কমান্ডার (কমান্ডার হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত) বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচী। ২৩ নভেম্বও ১৯৭১ আমরা শেল্টার নিলাম সৈয়দপুর গ্রামের কালা চক্রবর্ত্তীর বাড়িতে। ২৫ নভেম্বর ১৯৭১ সংবাদ পেলাম পাকহানাদারেরা কৈজুরী হয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলের যুদ্ধে পাকহানাদারেরা পরাজিত হয়ে লঞ্চে যমুনা নদী পাড় হয়ে মালিপাড়া ক্যাম্পে এসেছে। মালিপাড়া ক্যাম্প থেকে রাস্তা চিনানোর জন্য দুই জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়েছে। আমরা পাকহানাদারদের আক্রমণ করার জন্য ওদের পিছু নিলাম। ওরা ক্ষুধার্ত। কৈজুরী গ্রামের একজনের মুলা ক্ষেত থেকে মুলা খাওয়ার চেষ্টা করল। ওরা হয়তো জানত না কাচা মুলা খাওয়া যায় না। ওয়াপদা বাঁধ ধরে ওরা অগ্রসর হতে লাগল। আমরাও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে অস্ত্র তাক করে ওদের পিছু পিছু হাটতে থাকলাম। ওরা ভীষণ ক্রোধাম্বিত। ধীতপুর নামক স্থানে গিয়ে ওরা আমাদের দিকে অস্ত্র তাক করে গুলি করল। আমরা জাম্প করে ওয়াপদা বাঁধের পশ্চিম দিকে পজিশন নিলাম। ওদের উপর গুলি ছুড়লাম। ওরা ওয়াপদা বাঁধের পূর্বপার্শ্বে পজিশন নিল। এক ঘণ্টাব্যাপী গুলি পাল্টা গুলি চলতে থাকল। গুলির শব্দে শাহজাদপুর ও বেড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অবস্থানকারী মুক্তিযোদ্ধা দল আমাদের সহযোগিতা করার জন্য এগিয়ে এল। এদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। হানাদারেরা গুলি করা বন্ধ করল। আমরাও অন্ধকারে গুলি করা বন্ধ করলাম। সারারাত আমরা না খেয়ে পজিশন অবস্থায় ছিলাম। আমাদের গ্রুপটি ছিল বাবু রবীন্দ্র নাথ বাগচীর নেতৃত্বে। আমার বাম পার্শ্বের এলএমজি চালাচ্ছিলেন কমান্ডার স্যার। আমার ডান পার্শ্বের থ্রি নট থ্রি চালাচ্ছিলেন আমার মেজদাদা সমরেন্দ্র নাথ সান্যাল। তাঁর ডান পার্শ্বের অবস্থান নিয়ে থ্রি-নট-থ্রি ও স্টেনগান চালাচ্ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শামসুল হক রতন কুমার দাস, নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য আরো ১৭ জন।
রাতে ধীতপুর সার গুদাম থেকে মাঝে মাঝে ২-১টা করে গুলি আসছিল। ওদের গুলির প্রেক্ষিতে আমরা ২-১ টা করে গুলি করছিলাম। ভোরে ফর্সা হলে আমাদের কমান্ডার বরীন্দ্রনাথ বাগচী ও বেড়ার কমান্ডার আমির হোসেন ক্রলিং করে ধীতপুর সার গুদামে এগিয়ে গেলেন। গিয়ে দেখতে পেলেন পাকহানাদারেরা পালিয়ে গেছে। দুজন রাজাকার সারারাত কভারিং ফায়ার করেছে। কমান্ড করে রাজাকার দুজনকে স্যারেন্ডার করালেন। রাজাকার দুজনের নাম ছিল লতিফ ও কালাম। তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে নেওয়া হল। তাদের কাছ থেকে জানা গেল রাত ১১টার দিকে হানাদারেরা ক্রলিং করে নিরাপদ দূরত্বে এসে হেঁটে বেড়া নদী পার হয়ে ঢাকা যাবার উদ্দেশে পালিয়েছে। পরে জানা গেল। পাকহানাদারেরা বেড়া ঘাটে গিয়ে ভেড়াকোলা গ্রামের হলদারদের নৌকায় নদী পাড় হয়ে নগরবাড়ি ঘাট হয়ে ঢাকা যাবার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। ধীতপুরের যুদ্ধে বেড়ার আমির হোসেনের গ্রুপের আব্দুল খালেক শহীদ হয়েছেন। স্থানীয় দুজন পথচারী গোলাগুলির সময়ে গুলি লেগে মারা গিয়েছেন। ধীতপুর যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা জামিরতা হাইস্কুলে ক্যাম্প করে অবস্থান নিয়েছিলাম। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ জাতির পিতা পাকিস্তানের কারাগার হতে মুক্ত হয়ে দেশে আসলেন। ১২ জানুয়ারি জাতির পিতা প্রথমে রাষ্ট্রপতি হিসেবে এবং পরক্ষণেই রাষ্ট্রপতি পদের ইস্তেফা দিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রথা চালু করে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশের দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলেন। জাতির পিতা আমাদেরকে অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। আমাদের গ্রুপ ২৪ জানুয়ারি রবিবার ১৯৭২ সালে সিরাজগঞ্জ সদরস্থ ইব্রাহিম বিহারি বাসায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ্ধ জমা দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব শেষ করলাম।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার
বাবু/জেএম