মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫ ৩১ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
বিবর্তনবাদ : মুসলিম বিশ্বে বিবর্তন ‘বাদ’
শায়েখ আরেফিন
প্রকাশ: রবিবার, ২৯ জানুয়ারি, ২০২৩, ৮:৫১ PM
ধর্ম ও বিজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য পরস্পর বিপরীতমুখী। ধর্মের ভিত্তি বিশ্বাস, বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রমাণ। ধর্মজুড়ে রয়েছে আখ্যান, উপাখ্যান, রূপকথা, উপকথা, কিংবদন্তি, কল্পনাশ্রয়ী অশরীরী সত্তা; বিজ্ঞানে এসবের কোনো স্থান নেই। ধর্ম করে রহস্যের ঘনীভূতকরণ। কিন্তু বিজ্ঞানের কাজ রহস্য দূরীভূতকরণ। তাই প্রাচীনকাল থেকেই ধর্ম আর বিজ্ঞানের বৈরিতা চলছে।

গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে ‘বিবর্তনবাদ’ অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে প্রবল আলোচনা চলছে। বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের সামনে এখানেও যথারীতি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ধর্মতত্ত্ব। হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান, মুসলমানদের ধর্মগ্রন্থে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব ও আদিমানবের উপাখ্যান বর্ণিত আছে। কিন্তু বিজ্ঞান জানাচ্ছে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ আজকের রূপে এসেছে।

বিবর্তন হচ্ছে রূপান্তর, ধীর পরিবর্তন, সময়ের সাথে ক্রমে পরিবর্তিত হয়ে একরূপ থেকে অন্যরূপ ধারণ। মানুষের আয়ুষ্কালের তুলনায় প্রক্রিয়াটি অতিধীর; তাই সাধারণ চোখে তা ধরা পড়ে না। বিবর্তন একধরনের continuum. ইংরেজ প্রকৃতিবিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রকার জীবের উৎপত্তি সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা সম্বলিত একটি বই প্রকাশ করেন (১৮৫৯) সংক্ষেপিত নাম ‘দি অরিজিন অব স্পিশিজ’ (The Origin of Species)। এই বইয়ে তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, জীবজগতের প্রয়োজন অনুযায়ী জীবদেহের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন সংঘটিত হয়। একে তিনি বলেছেন ন্যাচারাল সিলেকশন বা প্রাকৃতিক নির্বাচন। এ প্রক্রিয়ায় জীবজগতের মধ্যে নতুন বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব ঘটে, আর এ বৈশিষ্ট্যগুলোর ধারাবাহিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উৎপত্তি হয়। এটিই বিবর্তনবাদ।

বিজ্ঞানের উৎকর্ষের এ যুগে মানুষ খাবারের চাহিদা মেটাতে জিন (gene) পরিবর্তনের মাধ্যমে উদ্ভাবন করেছে শস্য ফল শাকসবজি পাখি জন্তু মাছের হাইব্রিড প্রজাতি। নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অবলম্বন করে কৃত্রিম উপায়ে গবেষণাগারে উৎপন্ন করা হয় হাইব্রিড প্রজাতি। আর ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব অনুযায়ী প্রজাতিগুলো সুদীর্ঘ সময় ধরে প্রাকৃতিকভাবে পরিবর্তিত হয়। পরিবর্তনের প্রক্রিয়া একই, পার্থক্য সময়কালে। ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব আজ শুধু তত্ত্ব নয়, জেনেটিক্স ও মোলেকিউলার বায়োলজির সমর্থনে তা ফ্যাক্ট।

হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান পুরোহিতেরা আজ আর বিবর্তনবাদ বিরোধে উচ্চকণ্ঠ নয়, তবে একসময় প্রবল বিরোধী ছিল। বিস্ময়কর হলেও সত্য, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূতিকাগার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যের ডেটন শহরের একটি উচ্চ বিদ্যালয়ে বিবর্তনবাদ পড়ানোর ‘অপরাধে’ এক শিক্ষককে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিদ্যমান আইন অনুসারে তাঁকে শাস্তি প্রদান করা হয়। ঘটনাটি ঘটে ১৯২৫ সালে যা  ‘স্কোপস ট্রায়াল’ (Scope’s trial)  নামে পরিচিতি পায়। আইনটি পরবর্তীকালে বাতিল করা হয়, তাও খুব বেশি আগে নয়, ১৯৬৭ সালে। হিন্দু, ইহুদি, খ্রিস্টান পুরোহিতেরা আজ বিজ্ঞানের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছে। এসব ধর্ম-প্রধান দেশের বিদ্যালয়ে বিবর্তনবাদ পড়ানোতে কোনো বাধা আসে না, এখন বাধা শুধু মুসলিমপ্রধান দেশে। সৌদি আরব, ওমান, আলজেরিয়া, মরক্কো ও তুরস্কের বিদ্যালয়ে বিবর্তনবাদ পড়ানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। জর্ডান, মিশর ও তিউনিসিয়ার বিদ্যালয়ে বিবর্তনবাদ পড়ানো হয় ধর্মীয় কাঠামোর মধ্যে থেকে। কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বিবর্তনবাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করা আছে। তাই সেখানে বিবর্তনবাদ পড়ানোয় হুমকি আছে। 

মুসলমানদের বিশ্বাস আদম পৃথিবীর প্রথম মানুষ, অপরাধ সংঘটনের কারণে তাকে স্বর্গচ্যুত করে পৃথিবীতে প্রেরণ করা হয়। তার মাধ্যমে পৃথিবীতে বংশবৃদ্ধি ঘটেছে যার ফল আজকের ৮০০ কোটি মানুষ। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলাম মতে পৃথিবীতে আদমের আগমন ঘটে, তর্কসাপেক্ষে, আজ থেকে ৭ হাজার বছর আগে। পৌরাণিক বিশ্বাসে আস্থা স্থাপনকারী মানুষের সংকীর্ণ ভাবনায় সাত হাজার বছরই অনেক পুরোনো! আদম বেঁচে ছিলেন, তর্কসাপেক্ষে, ৯৫০ বছর, উচ্চতা ছিল ৯০ ফুট। লক্ষ্যণীয়, ধর্মানুসারীরা বিবর্তনবাদ না মানলেও তাদের বিশ্বাসে থাকা আদিমানবের বিবর্তন কিন্তু মাত্র কয়েক হাজার বছরেই ঘটে গেছে! ৯০ ফুটের আদম সন্তানদের উচ্চতা এখন ৫-৬ ফুট! ধর্মানুসারীরা পৃথিবীতে শুধু মানুষের আগমন নিয়েই ভেবেছে ও তৈরি করেছে উপাখ্যান। অন্য প্রাণী-প্রজাতির আগমন কীভাবে ঘটলো সে-সম্পর্কে ভাবেনি, উপাখ্যানও রচনা করেনি। কুকুর, বিড়াল, সিংহ, হাতি, মাছ, পাখিও কি স্বর্গচ্যুত হয়ে এসেছিল পৃথিবীতে? আর তা না হলে কীভাবে অস্তিত্বশীল হলো ওরা?

ধর্মানুসারীদের ধারণা মানুষ একই অবয়বে চিরকাল ছিল ও থাকবে; সমস্ত জীবজগতের আকার ও গঠন স্থির, অপরিবর্তনীয়। সাধারণ দৃষ্টিতে দেখা ও উপলব্ধি করা যায় না বিধায় মানুষের অবচেতন মনে একটা ধারণা কাজ করে যে বিবর্তনবাদ শুধু অতীতেরই ঘটনা। বিবর্তন এখন থেমে গেছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণসহ বিস্ময়কর তথ্য আমাদের সামনে উপস্থিত করছে মানুষ এখনও পরিবর্তিত হচ্ছে, এবং হচ্ছে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে দ্রুত! আগে সর্বতোভাবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতো প্রকৃতি। ফলে পরিবর্তন ছিল ধীর, প্রকৃতির তালে তালে হতো। এখন মানুষ অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করে নিজের মতো করে। ফলে বিবর্তন প্রক্রিয়া দ্রুততর হয়েছে। খুব সুক্ষ্মভাবে চলতে থাকা এ প্রক্রিয়াকে বলে মাইক্রো ইভোল্যুশন (micro evolution)। এ বিষয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রাপ্ত কয়েকটি ফল নিচে তুলে ধরা হলো :

এক. গবেষণায় পাওয়া গেছে আগের চেয়ে অধিক হারে (প্রায় ৩৫ শতাংশ) ‘উইজডম টিথ’ (আক্কেল দাঁত) ছাড়া শিশু জন্মগ্রহণ করছে। এ হার ক্রমবর্ধমান। গবেষকেরা জানাচ্ছেন, একসময় উইজডম টিথের বিলুপ্তি ঘটবে। ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, মানুষ একসময় শক্ত খাবার খেত। শক্ত খাবার চিবোতে উইজডম টিথের প্রয়োজন হতো। কালক্রমে মানুষ নরম খাবারে অভ্যস্ত হচ্ছে। আগুনে পর্যাপ্ত সেদ্ধ করে, নানা প্রক্রিয়ায় খাবার নরম করে, কাটলারির সাহায্যে কেটে খাবার গ্রহণ করছে। ফলে খাবার চিবোতে হচ্ছে কম। কম চিবোনোর ফলে চোয়াল ছোট হচ্ছে। চোয়াল ছোট হওয়ার ফলে দাঁত ধারণের স্থান সংকীর্ণ হচ্ছে। এর ফলে উইজডম টিথ জায়গা হারাচ্ছে। বিপরীতভাবে ভাবা যায় উইজডম টিথের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে আসছে, তাই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তা বিলুপ্ত হচ্ছে। প্রয়োজন আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্যে চমৎকার এক বোঝাপড়া যেন! দুই. নরম খাবার গ্রহণের কারণে কম চিবোতে হয়। ফলে মানুষের মুখমণ্ডলের আকারও ছোট হয়েছে। তিন. উনিশ শতকের শেষদিক থেকে মানুষের হাতের রত্নিতে (কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত অংশ) অতিরিক্ত একটি ধমনি অস্তিত্বশীল হচ্ছে, নাম Median artery. ধমনিটি প্রথম দিকে গর্ভাবস্থায় দেখা যেত কিন্তু জন্মের পর তা আর থাকতো না। ১৮৮০ সালের দিকে জন্মের পরও এটিকে দেখা যেতে থাকে, প্রায় ১০ শতাংশ শিশুর মধ্যে এই ধমনি পাওয়া যায় তখন। একশো বছর পর ৩০ শতাংশ শিশু এই ধমনী নিয়ে জন্মাতে থাকে। ২০২০ সালের এক স্টাডিতে দেখা যায় এ হার উন্নীত হয়েছে ৩৫ শতাংশে। গবেষকদের ধারণা, ২১০০ সালের মধ্যে অধিকাংশ মানুষের রত্নিতে থাকবে এই ধমনি। তখন এটি সাধারণ ঘটনায় (common phenomena) পরিণত হবে। মানবদেহের এই পরিবর্তনকে বিজ্ঞানীরা  Ôa significant development in a fairly short period of time বা ‘একেবারে অল্প সময়ে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্ধন’ অভিহিত করেছেন। গত ৫ হাজার বছরে মানুষের বিবর্তন প্রক্রিয়া ১০০ গুন দ্রুত হয়েছে। আগের ৬ কোটি বছরে এতো দ্রুত কখনো হয়নি। চার. বর্তমান পৃথিবীর ১৭ শতাংশ মানুষের চোখ নীলাভ রঙের। গবেষণায় পাওয়া যায়, ছয় হাজার বছর ধরে এটি বাড়ছে। আগে নীলাভ চোখের অস্তিত্ব ছিল না। এ সময়কালে মানুষের ত্বকের পুরুত্বও কমে গেছে। পাঁচ. মানুষের মস্তিষ্ক সংকুচিত হচ্ছে। ৩০ হাজার বছর আগে মস্তিষ্কের আয়তন ছিল ১৫০০ ঘন সেন্টিমিটার, এখন ১৩৫০ ঘন সেন্টিমিটার। ৩০ হাজার বছরে সংকুচিত হয়েছে শতকরা ১০ ভাগ।

ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব আজ প্রমানিত, বৈজ্ঞানিক সত্য, বাস্তব। একসময় মানুষ আজকের মতো থাকবে না, অন্য আকার ধারণ করবে। আজকের হোমোস্যাপিয়েন্স নিয়ে তখন হয়তো গবেষণা করবে মানুষের থেকেই উৎপন্ন হওয়া আরেক ধরনের প্রাণী। জ্যোতির্বিজ্ঞানী কার্ল স্যাগান বলেছেন, পৃথিবী থেকে প্রক্সিমা সেন্টরাই বা অন্য কোনো তারার রাজ্যে আমরা একদিন পৌঁছে যাব। ঠিক ‘আমরা’ নই, পৌঁছুবে অনেকটা আমাদের মতো দেখতে ভিন্ন কোনো প্রাণী যাদের সাথে আমাদের ডিএনএ'র মিল থাকবে। স্যাগান বিবর্তনবাদকে মাথায় রেখে কথাটি বলেছেন।

বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব বাতিল করতে বিজ্ঞান প্রয়োজন। ধর্মোপাখ্যানে বিশ্বাসীরা যদি বৈজ্ঞানিক উপায়ে বিবর্তনবাদকে ভুল প্রমাণ করতে পারেন এবং আদম আবির্ভাবের ঘটনা প্রমাণ করতে সক্ষম হন, তাহলে সেটিও হবে বিজ্ঞানের জন্য বিরাট এক অগ্রগতি। কিন্তু যারা বিবর্তনবাদ না মেনে বিবর্তন ‘বাদ’ দিয়েছে, জোরপূর্বক আইন-ফতোয়া জারি করে বিবর্তনের জ্ঞান থেকে মানুষকে বঞ্চিত রেখেছে, তারা সভ্যতার শত্রু হিসেবে ইতিহাসে র'য়ে যাবে। গ্যালিলিওকে শাস্তি দেওয়ার সাড়ে তিনশো বছর পর গির্জা যেমন ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছে সেদিন, তেমনি আজকের বিবর্তনবাদ অপলাপকারীরাও তাদের ভুলের জন্য একদিন ক্ষমাপ্রার্থনা চাইবে।

লেখক : বিশ্লেষক ও সমালোচক

বাবুৃ/জেএম

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত