বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা। প্রতিবছরের মতো এবারও ১ ফেব্রুয়ারির শুরু হবে। ইতোমধ্যে বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের সব প্রস্তুতি শেষের দিকে। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো প্যাভিলয়ানের কাজও প্রায় সম্পূর্ণ। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বাংলা একাডেমি চত্বরে নির্ধারিত জায়গায় স্টল পেয়েছে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো।
বৈশ্বিক মহামারি কারণে দুই বছর প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন ব্যবসা করতে পারেনি। জেলা-উপজেলা থেকে বইপ্রেমীরা মেলায় আসতে পারেনি। অনেক কবি-সাহিত্যিক গ্রামে বসবাস করেন। প্রাণের স্পন্দন গ্রন্থমেলায় না আসতে পারায় পুড়ছে হৃদয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৩ সবকিছু ঠিক থাকলে লেখক-পাঠব-প্রকাশকের মিলনমেলায় পরিণত হবে এমন আশায় বুক বাঁধতেই পারি। দৈনন্দিন জীবনে যেমন সবকিছুর দাম আকাশছোঁয়া অবস্থা। কাগজের দামও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক প্রকাশনী এবার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। নতুন কওে কোনো বই প্রকাশ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেনি। আবার যে প্রতিষ্ঠানগুলো বই প্রকাশ করছে কপালে একটু চিন্তার ভাঁজও আছে তাদের। যে অর্থলগ্নি করেছে, সে অনুপাতে বিক্রি হবে কিনা প্রশ্ন থাকতেই পারে। কারণ কাগজ, কালি ও বাইন্ডিং সবকিছুরই মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। সোনামণি প্রকাশনীর কর্ণধার ফিরোজ খান প্রিন্স বলেছেন, আশাবাদী শতভাগ। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান বাবুই এর স্বত্বাধিকারী কাদের বাবু বলছেন, সবকিছুর দাম বেশি এবার বইয়ের দামও বেশি। সে তুলনায় পাঠকও পছন্দের বইটি কিনতে একটু বেগ পেতে পারে।
তারপরেও সারাবছরের মধ্য একটি মাসের জন্য অপেক্ষা করি। ভালো বিক্রির আশায়। এখন যেহেতু মহামারি নেই, মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে মেলায় আসবে। পছন্দের বইটি কিনবে। হরিৎপত্র প্রকাশনীর মালিক ফারুকী উমর বলেছেন, এবার মেলা নিয়ে বেশ আশাবাদী। আমি সাহিত্যের সাথে জড়িত প্রায় দুই দশকের বেশি কাল ধরে। একটা অভিযোগ নিত্য শুনি, কবিতা চলে না, কবিতা মানুষ পড়ে না, আমি এসব কথা আমলে নেই না। প্রতিবছর নবীন-প্রবীণ কবিরা কবিতার বই প্রকাশ করে। মূলকথা হচ্ছে এসব বই পাঠক কতটুকু গ্রহণ করেছে। অনেক প্রকাশনী কবির খরচে বই প্রকাশ করে যার দায়ভার কবির। হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তরুণ কবিদের বই তাদের অর্থলগ্নি করে প্রকাশ করে। আবার কিছু মৌসুমি কবি আছে, বইমেলা আসলেই দেখা যায় সাহিত্যপাড়ায় বাংলাবাজার, কাঁটাবন, শাহবাগ এলাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ২৪ ঘণ্টা সরব; বই প্রচারের চিল্লাচিল্লি করতে দেখা যায়। কিছু প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান আছে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে লেখক হতে মোটা অংকের টাকা নিয়েও বইটি প্রকাশ করছে না। আমার সৎ পরামর্শ হলো আপনি যেখানেই টাকা দেন চোখ-কান খোলা রেখে দিবেন। অন্যথায় বিফলে মূল্য ফেরত পাওয়ার সম্ভবনা খুবই কম।
কবি ও প্রাবন্ধিক বঙ্গ রাখাল, কবি ও প্রাবন্ধিক এনাম রাজু, কবি জোবায়ের মিলন, রুদ্র সাহাদাৎ, কবি রফিকুজ্জামান রণি, লেখক অলোক আচার্য, কবি মেহেদী ইকবাল, কথাসাহিত্যিক শফিক হাসান, কবি রায়হান উল্লাহ, কবি মামুন রশীদ, কবি লতিফ জোয়ার্দার, কবি রনি বর্মন, কবি গোবিন্দ লাল হালদার, কবি ফারুক আফনদী, কবি ওবায়েদ আকাশ, কবি পিয়াস মজিদ, কবি জহুরুল ইসলাম, কবি নুসরাত সুলতানা, কবি এনাম আনন্দ, কবি শেখ ফজল, কবি ধ্রুব জ্যোতি ঘোষ মুকুল, কবি এস ডি সুব্রত, কবি জাকারিয়া জাহাঙ্গীর, কবি দ্বীপ সরকার, কবি আদ্যনাথ ঘোষ, গবেষক মীম মিজান, কবি মাহমুদ নোমান, কবি হাসান ইমতিয়াজ, কবি মাহফুজ রিপন, কবি সাজ্জাদুর রহমান, কবি আহমদ কাউসার, কবি কৃষক মাহমুদ, কবি মাসুদ চয়ন, কবি আইরিন সুলতানা লিমা, কবি রওশন রুবি, কবি নূরে জান্নাত, কবি অনন্ত পৃথ্বীরাজ, কবি মাহফুজুর রহমান সৌরভ, গল্পকার জোবায়ের রাজু, কবি নকিব মুকশি, কবি জাহীদ ইকবাল এখানে যাঁদের নাম উল্লেখ করেছি সকলেই আমদের সাহিত্যপাড়ায় পরিচিত মুখ, জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতায় নিয়মিত। আমি মনে করি বাংলা সাহিত্যে ভালো লিখেছেন।
অনেকে আবার অভিযোগ করতে পারেন, তার নামটি দেওয়া হয়নি, সব নাম তো আর মুখস্থ থাকে না, এখনো অনেক কবি ছদ্মনামে লেখে, নিজেকে আড়ালে রাখতে চায়। উল্লেখিত কবি ও লেখকদের কয়েকজন বাদে মোটামুটি সবার বই পাঠ করেছি, একজন পাঠক হিসেবে বলতে দ্বিধা নেই। বেশকিছু বই বাক্যের সাথে রস, ভাব, সমসাময়িক বিষয়গুলোকে শব্দ বুনে, সৃষ্টি করেছেন কবিতা। শব্দের ব্যবহার, দাঁড়ি-কমা সঠিক পথেই আছে। পাঠকের হৃদয়কে মোচড় দিয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, আল মাহমুদ, রফিক আজাদ, রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুল্লাহ তাঁদের সব লেখা যে পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছে একথা কেউ বলতে পারবে না। কারণ সব লেখাই পাঠকের হৃদয়ে পুষ্প হয়ে ফোটে না। আমাদের রাজনীতির মাঠ চাপা দিয়ে চললেও, বাংলা সাহিত্য চাপার জোরে চলে না। মেলা লেখক-পাঠক মিলনমেলায় পরিণত হোক, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আসুক, বইয়ের গন্ধে ভরে যাক মেলা প্রাঙ্গণ। প্রতিদিন যে পরিমাণ মানুষ মেলায় প্রবেশ করে, সবাই যদি অন্তত একটা করে বই কিনে। আমার ধারণা মেলা বইশূন্য হয়ে যাবে। আমি বাণিজ্যমেলায় লক্ষ কওে দেখেছি, মানুষ ঘর সাজানোর জন্যে কত রকমের আসবাবপত্র কিনছে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বলব, ঘরের সৌন্দর্য হচ্ছে বই। আপনিসহ ছেলেমেয়েদের অবসরে বই পড়াতে পারেন। জোর ভাবে বলতে পারি, যিনি বই পড়েন, তিনি সহজে অন্যায় করতে পারেন না। তার ভিতরে একটা বিবেক-বুদ্ধি কাজ করে। যুবসমাজকে জাগ্রত করতে হলে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সাহিত্য, ভ্রমণ, সায়েন্স ফিকশনসহ বিভিন্ন পড়তে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে বছরের শুরুতেই ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে প্লাস্টিক, জগ, বদনা ও প্লেট পুরস্কার বিতরণ করা হয়। প্লাস্টিক পুরস্কারগুলো সাংসারিক কাজে ব্যবহৃত হলেও ছাত্রছাত্রীদেও কোনো কাজে লাগছে না। এ বিষয়ে শিক্ষক যদি সচেতন না হয়। প্লাস্টিকের পুরস্কার চলতেই থাকবে। পুরস্কার হিসেবে বই দেওয়া যেতে পারে। বিয়ের অনুষ্ঠানে বই উপহার দিতে পারেন, যাঁরা বাস, ট্রেন ও লঞ্চে যাতায়াত করেন, মোবাইল টিপাটিপি না করে বই পড়তে পারেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০২৩ এর সফলতা কামনা করছি। দাবি একটাই অন্তত একটি বই কিনুন।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট