বুধবার ১৩ আগস্ট ২০২৫ ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২
বুধবার ১৩ আগস্ট ২০২৫
বাংলাদেশের-ভারত জ্বালানি করিডোর ইস্যু
সামারা আশরাত
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ৪:২৮ PM

অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশকে তার জ্বালানি নিরাপত্তা ও দীর্ঘমেয়াদি স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে প্রচলিত জীবাশ্ম জ্বালানির উৎস থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্কটের দরুণ জ্বালানি পরিবহন বিঘ্নিত হওয়ার কারণে জ্বালানি নিরাপত্তা উন্নয়নশীল এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য একটি প্রধান উদ্বেগ হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে আন্তঃসীমান্ত জ্বালানি সহযোগিতা এবং ভারত-বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক জ্বালানি করিডোরের ব্যবহার বাংলাদেশকে বর্তমান বৈশ্বিক জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় সহযোগিতা করতে পারে।

২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের সময় বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটান থেকে ভারতের মাধ্যমে বিদ্যুৎ আমদানির অনুমতি দেওয়ার অনুরোধ করেছিল। নেপাল ইলেকট্রিসিটি অথরিটি (এনইএ) ভারতের বিদ্যমান ট্রান্সমিশন অবকাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ৪০-৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানির জন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুমোদন চেয়েছিল। ২০২২ সালের আগস্টে বাংলাদেশ এবং নেপাল উচ্চ-ভোল্টেজ বহরমপুর-ভেড়ামারা ক্রস-বর্ডার পাওয়ার ট্রান্সমিশন লিঙ্ক ব্যবহার করে প্রাথমিক পর্যায়ে নেপাল থেকে বাংলাদেশে ৪০-৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানির অনুমতি দেওয়ার জন্য ভারতকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

নেপাল-বাংলাদেশ জ্বালানি সহযোগিতার জন্য গঠিত সচিব পর্যায়ের জয়েন্ট স্টিয়ারিং কমিটি (জেএসসি) চলাকালীন সমঝোতা অনুসারে এনইএ এবং বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড বিদ্যুৎলাইন ব্যবহার করে একটি ত্রিপক্ষীয় জ্বালানি বিক্রয় ও ক্রয় চুক্তির জন্য এ অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ভূবেষ্টিত দেশ হওয়ার কারণে নেপালের বিদ্যুৎ রপ্তানির পরিকল্পনার জন্য ভারতের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং অংশীদারিত্ব প্রয়োজন। ভারতের সেন্ট্রাল ইলেক্ট্রিসিটি রেগুলেটরি কমিশনের মতে, যেখানে ভারতের সংশ্লিষ্টতা আছে, সেখানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য করার অনুমতি দেওয়া হয়। ত্রিপাক্ষিক চুক্তির একটি নির্দিষ্ট বিধান রয়েছে যা ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ভারত সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকারের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির কাঠামোতে স্বাক্ষর করার অনুমতি দেয়। মূলকথা হলো ভারতের সাথে আন্তঃসীমান্ত বিদ্যুৎ বাণিজ্যের জন্য বাংলাদেশ ও নেপালকে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে হবে।

এখন ভারত কাঠমান্ডুকে ভারতীয় ভূখণ্ড এবং ভারতীয় অবকাঠামোর মাধ্যমে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি করার অনুমতি দেওয়ার জন্য নেপাল ও বাংলাদেশের প্রস্তাব বিবেচনা করছে। তাই বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে ‘জ্বালানি করিডোর’ ইস্যু।

ভারত এবং বাংলাদেশ উভয়ই আগামী বছরগুলোতে তাদের নবায়নযোগ্য শক্তির অংশ উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে চায়। ভারত সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে অ-জীবাশ্ম জ্বালানি উৎস থেকে ৫০০ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা তৈরি করেছে যা নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে ৫০ শতাংশ শক্তির চাহিদা পূরণ করবে। একইভাবে বাংলাদেশ দেশের বিদ্যুৎখাতে নবায়নযোগ্য শক্তির অংশ এখন ৩ শতাংশ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। পানিসমৃদ্ধ নেপাল উভয় দেশকেই তাদের স্বপ্নপূরণে সহায়তা করতে পারে।

এখন ভারতের বাংলাদেশকে সহযোগিতা করার মূল কারণ কী হতে পারে? বাংলাদেশের যেমন ভারতের ভূখণ্ড প্রয়োজন, তেমনি ভারতেরও নিজের দেশের জ্বালানি সম্ভাবনা শতভাগ কাজে লাগাতে বাংলাদেশের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এর প্রধান কারণ হলো উত্তর পূর্বাঞ্চলে ভারতের ভৌগলিক সীমাবদ্ধতা। উত্তর-পূর্বাঞ্চল হল ভারতের নবায়নযোগ্য শক্তির ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রধান কেন্দ্র। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক সম্পদের উপযোগ করতে চায়। শুধুমাত্র অরুণাচল প্রদেশেই ৫০,০০০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে। ইন্ডিয়ান নর্থ ইস্টার্ন ইলেকট্রিক পাওয়ার কোঅপারেশন অনুসারে, ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে প্রায় ৫৮,৯৭১ মেগাওয়াট বিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে যা ভারতের মোট জলবিদ্যুৎ সম্ভাবনার প্রায় ৪০ শতাংশ। ভারত অরুণাচল প্রদেশ এবং অন্যান্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে জলবিদ্যুতের উপযোগের পরিকল্পনা করছে। বর্তমানে ভারতের মোট ১৪৫,৩২০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুতের সম্ভাবনা রয়েছে কিন্তু মাত্র ৪৫,৩৯৯.২২ মেগাওয়াট ব্যবহার করা হচ্ছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার উপরে ১৮টি প্রকল্প উত্তর-পূর্ব জুড়ে নির্মাণাধীন ছিল। কিন্তু ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জলবিদ্যুৎ প্রেরণের জন্য ভারতকে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। কিন্তু শিলিগুরি করিডোর নামক ভৌগোলিক বাধা ভারতকে তার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বাধা দিয়েছে।

কিন্তু খরচ কমাতে ভারত সহজেই বাংলাদেশকে জ্বালানি করিডর ব্যবহার করতে পারে। ২০২১ সালে বাংলাদেশ জ্বালানি করিডোরে আগ্রহ দেখিয়েছে এবং আশা করেছে তার ভূখণ্ডের মধ্য দিয়ে যাওয়া হাই-ভোল্টেজ গ্রিডলাইনের মাধ্যমে ২০-২৫ শতাংশ জলবিদ্যুৎ প্রেরণ করা হবে। বাংলাদেশে ৬,০০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সঞ্চালন লাইন বড়পুকুরিয়ায় নির্মিত হলে ১০০ কিলোমিটার এবং জামালপুরে ২০০ কিলোমিটার হলে প্রতিটি রুটে একটি সাবস্টেশন নির্মাণ করা যাবে। ট্রান্সমিশন লাইনের দুটি সম্ভাব্য রুট হল আসামের বনগা থেকে বড়পুকুরিয়া (দিনাজপুর) বা জামালপুর থেকে বিহারের পুনিয়া এবং আসামের শিলচর থেকে মেঘনা ঘাট-ভেড়ামারা হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত। ত্রিপুরা-কুমিল্লা, বোঙ্গাইগাঁও (আসাম)-জামালপুর/দিনাজপুর-পূর্ণিয়া (বিহার), শিলচর (আসাম) এবং ফেঞ্জুগঞ্জে এই ধরনের উচ্চ-ক্ষমতার আন্তঃসংযোগকারী থাকতে পারে।

ভারত যদি শেষ পর্যন্ত নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানির জন্য বাংলাদেশকে একটি পাওয়ার করিডরের অনুমতি দেয় তাহলে এটি দ্বিপাক্ষিক জ্বালানি সহযোগিতার একটি নতুন যুগের সূচনা করবে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে জলবিদ্যুতের অব্যবহৃত সুযোগ অর্জন করতে পারে। সুতরাং, উভয়েরই দ্বিপাক্ষিক জ্বালানি করিডোরের পারস্পরিক সুবিধার কথা চিন্তা করে তাদের জ্বালানি নিরাপত্তা বাড়াতে এবং দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা বাড়াতে এগিয়ে আসা উচিত।

লেখক : বুখারেস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষক

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত