বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল যে আন্দোলনের মাধ্যমে, তা ছিল ভাষা আন্দোলন। বাঙালি চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল এই আন্দোলনের মধ্যেই। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রক্তের বিনিময়ে বাঙালিরা তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছিল। ১৯৭১ এ স্বাধীনতা অর্জনের পর অর্ধশতক পেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ইতিবাচক উল্লেখযোগ্য অর্জন যেমন আছে, তেমনি নেতিবাচক ঘটনাও কম নয়। এরই মধ্যে দেশের সংস্কৃতিতে উল্লেখযোগ্য একটি মাইলফলক একুশে বইমেলা। বইমেলা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা। যে মেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়। অমর একুশে গ্রন্থমেলা আমাদের কাছে ব্যাপকভাবে একুশে বইমেলা নামেই পরিচিত।
১৯৭১ সালের পনেরো ফেব্রুয়ারিতে একুশের স্মরণে প্রথম সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বাংলা একাডেমিতে। তখন প্রধান অতিথি হিসেবে সেই মেলার উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু এই বিশালসংখ্যক পাঠককে যে বইয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত করছে, এটা বইমেলার বড় একটা অবদান। এছাড়া ভাষার মাসকে কেন্দ্র করে একটা লম্বা সময় ধরে ভাষাকেন্দ্রিক এই মেলা চলাটা বড় ব্যাপার। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দাঁড়িয়ে বইমেলা হয়তো আন্তর্জাতিক বইমেলা হয়ে উঠতে পারেনি, যেমনটা হয়েছে কলকাতা বইমেলা।
বাংলাদেশের মানুষ বাংলা ভাষায়, ইংরেজরা ইংরেজিতে, চায়নিজরা চায়নায়, ভারতীয়রা হিন্দিতে এবং এভাবে অন্য সবদেশের লোকেরা তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলে থাকে। এগুলো তাদের মাতৃভাষা আর মাতৃভাষাকে প্রথম ভাষা হিসেবে বোঝানো হয়, যা কোনো শিশু তার জন্মের সময় থেকেই পেয়েছিল। আমরা কথা বলি, শুনি, মিথস্ক্রিয়া করি, মনের আবেগ-অনুভূতি ব্যক্ত করি এবং হাসি-কান্না ও দুঃখ-বেদনা সবই প্রকাশ করি আমাদের নিজস্ব ভাষায়, আর তা-ই হচ্ছে বাংলা ভাষা, মানে আমাদের মাতৃভাষা। আমাদের মাতৃভাষা বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত ও সম্মানিত একটি ভাষা, যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেসকোর ঘোষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
একটি শিশু জন্মগ্রহণ করার পর থেকে যে ভাষায় কথা বলে, শোনে, মনের আবেগ ও অনুভূতি ব্যক্ত করে তা-ই মাতৃভাষা। শিশুর বিকাশে মাতৃভাষার ভূমিকা অনেকাংশে গুরুত্বপূর্ণ। এটি আরো সুপরিচিত যে একটি শক্তিশালী মাতৃভাষার ফাউন্ডেশন শিশুদের অতিরিক্ত ভাষা শেখার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার সঙ্গে সজ্জিত করে এবং তাদের ভাষার কাঠামো বোঝার জন্য কয়েকটি নতুন ভাষায় স্থানান্তর করতে শেখায়। শিশুরা যখন তাদের প্রথম ভাষা শিখবে, তখন ব্যাকরণের অন্তর্নিহিত বিষয়গুলো বোঝার ক্ষেত্রে তা সহজেই অন্যান্য ভাষায় স্থানান্তর করতে পারবে। মাতৃভাষা ব্যক্তিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের বিকাশে বিশাল ভূমিকা রাখে। প্রথম ভাষায় শক্ত ভিত্তিযুক্ত শিশুরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের মধ্যে এবং সমাজের মধ্যে তাদের অবস্থান সম্পর্কে আরো গভীর উপলব্ধি প্রদর্শন করে এবং পাশাপাশি মঙ্গল এবং আস্থা অর্জনের বোধশক্তি বৃদ্ধি করে। স্বাভাবিকভাবেই এটি তাদের শিক্ষাগত কৃতিত্বসহ তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রবাহিত হয়।
আধুনিক বিশ্বে এখন মেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সবাই। এই বিবেচনা থেকে বিভিন্ন রাষ্ট্র আজকাল মেলার আয়োজন হয়ে থাকে। বইমেলার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। সারাবিশ্বে এখন বইমেলা হয়। সেসব মেলায়ও লাখ লাখ মানুষের ভিড়। যদিও বই আবিষ্কার হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মেলার কথা কেউ চিন্তাও করেনি। কিন্তু যখন বইয়ের প্রচার-প্রসার এবং এর সংগ্রহ শুরু হলো, সেই সময় থেকেই বইয়ের একটা বাজার সৃষ্টি হয়। বইমেলার ধারণাটা অবশ্য আরো পরে এসেছে। প্রাচীন চীনারা বই সংগ্রহ শুরু করে ৯৬০ সালের পরে। তারা এর নাম দেয় ‘শানবিন’। বইকে তারা খুবই গুরুত্ব দিত। বইমেলা শুরুর পর এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া-এই ইতিহাস কিন্তু খুব বেশি দিনের নয়। ৫০০ বছর আগের কথা। খ্রিস্টিয় পনেরো শতকে জোহানস গুটেনবার্গ মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা আবিষ্কার করেন। বলা হয় সে সময়ই বইমেলার সূচনা হয় জার্মানিতে। অনেকের মতে, জার্মানির লিপজিগ শহরে প্রথম বইমেলা হয়েছিল। কিন্তু কারো কারো ধারণা আলাদা। তারা মনে করে, প্রথমে বইমেলা শুরু হয় ফ্রাঙ্কফুর্টে, লিপজিগ খুব বড় করে মেলার আয়োজন করায় ওটার নামই লোকজন জানত বেশি। বিশে^র অন্যতম বইমেলাগুলো হল লন্ডন বইমেলা, আন্তর্জাতিক কলকাতা পুস্তক মেলা, নয়াদিল্লি আন্তর্জাতিক বইমেলা, কায়রো আন্তর্জাতিক বইমেলা, হংকং বইমেলা, বুক এক্সপো আমেরিকা (বিইএ), আবুধাবি বইমেলা ইত্যাদি।
আমাদের দেশেও অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বইমেলা হয়। বইমেলা অর্থ বইয়ের মেলা বা বই নিয়ে যে মেলা। অর্থাৎ বইই হয়ে ওঠে এ মেলার মূল উপকরণ, উপস্থাপনা ও নির্ভরতার বস্তু। তবে বিষয় বা বস্তুনিষ্ঠতা বইয়ের বৈশিষ্ট্য বা ধর্ম নয়, বই জীবন-জিজ্ঞাসা ও আত্মিক পিপাসা নিবৃত্তির তথ্য-উপাত্ত ও বিশ্লেষণের সন্নিবেশ। তাই অন্যান্য যেকোনো মেলার সাথে এর তুলনা বা সাদৃশ্য চলে না। লৌকিক সেতুবন্ধনে শিল্প-সাহিত্য-সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবন-জগতের নান্দনিক দর্শনের সঙ্গী বই। যেখানে নীরব ভাষার স্থির প্রবাহ মানবাত্মার অমর আলোকে কালো অক্ষরের শৃঙ্খল বুননে কাগজের সীমানায় বাঁধা পড়ে থাকে। শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শোনা যায়, তেমনি বইয়ের মধ্যে হৃদয়ের আবেদন ও আবেগি উত্থান-পতনের শব্দ শোনা যায়। সুতরাং বই কোনো আনুষঙ্গিক অনুষঙ্গ ছাড়াই নির্ভরশীলতার এক আস্থাশীল আশ্রয়। এদিক থেকে অমর একুশে বইমেলা শিল্প-সাহিত্য-সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও জীবন-জগতের সেতুবন্ধনে আবহমানকাল ধরে কাজ করে যাচ্ছে।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
-বাবু/এ.এস