সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫ ২৩ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫
হেরোইনে বিবর্ণ পদ্মাপাড়ের নারীরা
হেরোইনের স্রোত দশ সীমান্তে
ইমরান হোসাইন
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২১ মার্চ, ২০২৩, ২:৩৩ PM

পদ্মাপাড়ের শহর রাজশাহী। শহর থেকে পশ্চিমের ৩০ কিলোমিটারের পথ গোদাগাড়ি। বরেন্দ্র অঞ্চলের সুখ্যাতি নিয়ে নানা রকমের কৃষিপণ্যের জন্য বিখ্যাত এই অঞ্চলটি। বিশেষ করে এই এলাকার টমোটোর চাহিদা সারাদেশ ব্যাপি। সীমান্ত ঘেঁষা অন্তত ১০ এলাকা রয়েছে যেখান দিয়ে মরণ নেশা হেরোইন আসে বাংলাদেশে। সারাদেশে যে পরিমান হেরোইন পাচার হয় তার ৯০ ভাগই আসে গোদাগাড়ির এ সীমান্ত দিয়ে। এক শ্রেণির গডফাদাররা দীর্ঘদিন ধরেই হেরোইন পাচারের সঙ্গে যুক্ত। তবে অতিসম্প্রতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে হেরোইন বহনে যুক্ত হচ্ছে নারীরা। কেউ লোভে পড়ে আবার কেউ বিপদে পড়ে পা বাড়িয়েছে সর্বনাশা এই পথে। বর্তমানে তারা কেউ জেলে কেউ মামলার চালাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, হেরোইনের গেটওয়ে খ্যাত গোদাগাড়ির গডফাদারদের চোখ পড়ে কলেজ ছাত্রী মুক্তির ওপর। সবে স্কুল পেরুনো কলেজের প্রথম বর্ষের মুক্তি দেখতেও সুন্দরী। সাংস্কৃতিক মনা টিনেজ মুক্তির ওপর টার্গেট করে সফলও হয় মাদক ব্যবসায়ীরা। নানা ছলে কৌশলে এমন ফাঁদ পাতা হয় হেরোইন বহনের কাজে রাজি হয়ে যায় মুক্তি। মাস চারেক আগে ৩০০ গ্রামের একটি চালান পাচারের সময় র‌্যাবের হাতে ধরা পড়ে মুক্তি। পরিবারের একমাত্র মেয়ের এমন কাণ্ডে হতভম্ব তার পরিবার। উপজেলা মৎস্য অফিসের অফিস সহকারী মোখলেসের পরিবারে নেমে আসে অন্ধকার। আদরের একমাত্র মেয়ে মুক্তি এখন কারাগারে। যে মুক্তির সঙ্গে আনন্দসময় পার করতো মা সেই মা এখন শোকে পাথর। হেরোইনের ছোবলে প্রায় বাকরুদ্ধ হয়ে আছে মনোয়ারা বেগম।

গোদাগাড়ি থানার ঠিক দক্ষিণপাশের্^ই রামনগর এলাকা। পদ্মা তীরের পাড়। সেখানে গিয়ে কথা হয় মুক্তির মা মনোয়ারার সঙ্গে। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে কথা বলতে গেলে গলা যেন ধরে যায় তার। এক প্রকার পাথর হয়ে গেছেন তিনি।

তিনি বলেন, ফিশারিজ মোখলেসের পরিবার (মুক্তির বাবা) কেমন কে না জানে। কিন্তু মেয়ে এরকম হবে কল্পনাতেও ছিল না। কারা নষ্ট করলো তার সন্তানকে এমন কথাতে চোখে পানি চলে আসে মনোয়ারার। তিনি বলেন, কারা নষ্ট করলো আমার মেয়েকে, আমি তাদের বিচার চাই। মেয়ে তো আমার এরকম ছিল না। কেন এমন হলো।’

পদ্মার কোলঘেঁষে দাড়িয়ে থাকা সীমান্ত ঘেঁষা উপজেলাটি যেমন কৃষি পণ্যের জন্য বিখ্যাত তেমনি মাদক তথা মরন নেশা হেরোইনের ‘গেটওয়ে’ হিসেবে সারাদেশে পরিচিত। কক্সবাজারের টেকনাফ দিয়ে যেমন নদীর স্রোতের মত ইয়াবা আসে দেশের অভ্যন্তরে, তেমনি রাজশাহী উপজেলার অন্তত ১০ টি সীমান্ত গলিয়ে হেরোইন প্রবেশ করে দেশের অভ্যন্তরে। যে কয়টি সীমান্ত পেরিয়ে হেরোইন আসে তার মধ্যে গোদাগাড়ি স্পটটি অন্যতম। অর্থাৎ শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ হেরোইনই এ সীমান্ত দিয়ে আসে। আর হেরোইনের গডফাদাররা তা পাচারের জন্য নানা কৌশল ব্যবহার করে।

তাদের পাতা ফাঁদ থেকে নারী, শিশু এমনকি স্কুল ছাত্রীও বাদ যায়নি। হেরোইনের এ ফাঁদে পড়ে একদিকে যেমন সংসার তছনছ হয়ে গেছে অন্যদিকে সমাজ তথা লোকজনের নিকট হয়ে পরিচিতি হয়েছে মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে। অনেকে বছরের পর বছর জেল খেটে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতেও পারেননি। কারবারীরা নগদ টাকার লোভ দেখিয়ে নারীদের দিয়ে বাহনের কাজে ব্যবহার করছে। আর এতে করেই তাদের জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার।

স্বামীহারা সংসার চালাতে যখন হিমসিম খাচ্ছিলেন এ সময় স্থানীয় এনজিও থেকে ঋণ নেন একই গ্রামের সুলতানা। ঋণের কিস্তি পরিশোধেও পড়েন বেকায়দায়। এমন অবস্থায় ধারদেনা করতে গেলে প্রস্তাব পান হেরোইন পাচারের। অন্যায় এবং বিপজ্জনক হওয়া সত্বেও রাজি হয়ে যান তিনি। পরে হেরোইন নিয়ে রাজশাহী থেকে রংপুরে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরাও পড়ে যান। বর্তমানে কারাগারে থাকা সুলতানার বাড়িতে গেলে দেখা মেলে তার ছেলে বাপ্পির।

বাপ্পি জানান, সংসারে ঋণের টাকার কিস্তির জন্য তাদের সমস্যা হচ্ছিল। এ কারণে মা এ কাজে জড়িয়েছে। নগদ টাকার জন্যই অন্যায় জেনেও মা রাজি হয়ে যায়।

তিনি জানান, মা বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। এখন বুঝছি মায়ের এ কাজে জড়ানো ঠিক হয়নি। মায়ের মামলা চালাতেও আমরা হিমশিম খাচ্ছি।

সুলতানগঞ্জের মুক্তির অবস্থাও ছিল একই রকম। লোভের বশবর্তী হয়ে কারবারে জড়িয়ে এখন তিনিও কারাগারে। মুক্তি কিংবা সুলতানায় নয়, গোদাগাড়িতে প্রায় শত নারী কেউ কারাগারে আছেন কেউ কারাগার থেকে জামিনে রয়েছে। কারবারীরা আড়ালে থেকে নানা প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ভয়ঙ্কর এই রাস্তায় নামিয়ে দিচ্ছে। আর এতে করেই একসময়ের সুশৃঙ্খল জীবনে নেমে আসছে অন্ধকার। বিবর্ণ হয়ে গেছে এসব নারীদের জীবন।

সর্বনাশা হেরোইন আসা ১০ সীমান্ত : উপজেলার ১০ টি সীমান্ত দিয়ে দিনে রাতে হেরোইন আসে বলে জানা যায়, পদ্মায় মাছ ধরা নৌকা কিংবা চর এলাকায় মোটরসাইকেল ব্যবহার করে কারবারীরা সীমান্ত গলিয়ে দেশে আনছে। এ সীমান্তগুলো হলো মহিষালবাড়ি, বিদিরপুর, বখচর, চর আষাড়িয়াদহ, চর অনুপনগর, দেবিনগর, ফুলতলা, কামারপাড়া, সুলতানগঞ্জ, রেলবাজার ঘাট।

লোকজন বলছেন, কারবারীরা টাকা লাগিয়ে বসে থাকে। বাকি কাজগুলো করে তাদের এজেন্টরা। সীমান্তের ওপার থেকে এপারে আনাতে একজন দ্বায়িত্বে থাকে। আবার এপারে আনার পর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পাচারের জন্য অন্য এজেন্ট। এই এজেন্টরা একেক কৌশল ব্যবহার করে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন সীমান্তে পাচার করে থাকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজর এড়াতে অত্যন্ত সুকৌশলে তারা এ কাজ করছে। র‌্যাব পুলিশের অতি সতর্কতার ফলে তারা ধরাও পড়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়- ১০০ গ্রাম হেরোইন গোদাগাড়ি থেকে রাজশাহী পর্যন্ত পৌঁছালেই ১০ হাজার টাকা দেয়া হয়। এরপর ঢাকা পর্যন্ত নিয়ে যেতে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত বাহককে দেয়া হয়। নগদ টাকার এ লোভে পড়েই নারী, শিশুসহ অন্যরা এ কাজে জড়িয়ে পড়ছে।

স্থানীয় শিক্ষক রেজাউল করিম বলেন, আমরা এখন নিজেদের গোদাগাড়ি এলাকার বাসিন্দা বলে পরিচয় দিতে লজ্জা পাই। বর্তমানে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে কে ভালো আর কে মাদক ব্যবসায়ী এটা নির্ণয় করা কঠিন। একজন স্কুল শিক্ষক হয়েও অনেক সময় আমাকে তলাøশির আওতায় পড়তে হয়। এটা আমার জন্য লজ্জাস্কর, অপমানকর। তিনি আরো বলেন, এটি খুবই উদ্বেগের যে এখন গৃহবধু থেকে শুরু করে স্কুলের ছাত্রীরাও এ কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আসলে টাকা কামানোর প্রতিযোগীতায় কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় কিছুই দেখা হচ্ছে না। আর এ কারণেই এমন পরিস্থিতি।

রেজাউল করিম বলেন, আসলে আমাদের মধ্যে ধর্মের চেতনা জাগ্রত করতে হবে। ধর্মের চেতনা জাগ্রত হলেই কেবল এসব অন্যায় বেআইনী কাজ বন্ধ হবে।

রাজশাহীর পুলিশ সুপার মাসুদ হাসান বলেন, নারীরা যে এমন কাজে জড়াচ্ছে এটি উদ্বেগের। তবে যার কাছেই পাওয়া যাবে আমরা তাদেরই গ্রেফতার করবো এবং আইনের আওতায় আনবো। তিনি বলেন, শুধু বাহক নয়, মূল কারবারীকেও আমরা গ্রেফতার করছি। তিনি বলেন, সবাই জানে মাদকের কুফল ও শাস্তি। সে কারণে নতুন করে বলার কিছুই নাই। জেনে শুনে কেউ বিপদে পা দেবে না। উনারা বিপদ জেনেই পা দিয়েছেন। আমরা এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রেখেছি। যার কাছেই পাওয়া যাবে তাকেই আমরা গ্রেফতার করবো। 

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত