যাদের আমরা ডাকি তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ ব’লে, যারা মূলত হিজড়া হিসেবে পরিচিত। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে হিজড়াদের উপস্থিতি বেড়েছে। তারা ট্রাফিক সিগন্যালে আটকে পড়া যানবাহনের আরোহীদের কাছ থেকে একপ্রকার জোর করেই টাকা আদায় করে। এই হিজড়াদের জ্বালায় অতিষ্ঠ নগরবাসী। ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় হিজড়াদের টাকা তুলতে দেখা যায়। যা নতুন কিছু নয় , এক কথায় নগরীর পুরনো চিত্র এটি বলা চলে। আগে মানুষ যা দিত, তা নিয়েই খুশি থাকত হিজড়ারা। তবে ইদানীং তাদের আচরণ বদলে গেছে। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, দোকানপাট যেখানে-সেখানে টাকার জন্য মানুষকে নাজেহাল করছে তারা।
তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীতে অনেক নকল হিজড়া আছে, যাদের মূল উদ্দেশ্য মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে বিনা পরিশ্রমে অর্থ উপার্জন করা। ট্রাফিক সংকেতে যানবাহন থামার পর হিজড়ারা সামনে এসে দাঁড়ালে যাত্রীদের কিছু করার থাকে না। যাত্রীরা মুখোমুখি হতে হয় কিছু অস্বাভাবিক মুহুর্তের। এমন সকল বিব্রতকর পরিস্থিতির স্বীকার রাজধানীর বেশির ভাগ বাসিন্দারা। প্রতিদিনই কোনো না কোনো সড়কে গেলেই দেখা যায় সিগন্যাল পড়লেই দৌড়ে এসে যাত্রীবাহী যানবাহনে জোর করে ওঠে গাড়িতে থাকা যাত্রীদের কাছে টাকা দাবি করছে, না দিলে যাত্রীদের অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে।
গুলিস্তান থেকে গাজীপুর রুটে চলাচলকারী একটি বাসে উঠে পড়ে ৩ জন হিজড়া। প্রত্যেক যাত্রীর কাছে গিয়ে টাকা চাইতে থাকে। কেউ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলেই গায়ে হাত দিচ্ছিল, আজেবাজে কথা বলছিল। এমন কী পকেটে হাক দিয়ে জোর পূর্বকভাবে টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তারা বাস থেকে নেমে যেতেই একাধিক যাত্রী বললেন, হিজড়াদের টাকা আদায় এখন রীতিমতো উৎপাতে পরিণত হয়েছে। হিজড়াদের বিষয়ে সরকারের উচিত এখনই ব্যবস্থা নেওয়া।
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০০৪ সালে একটি জরিপ করেছিল। ওই জরিপে হিজড়াদের সংখ্যা ১৫ হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে হিজড়াদের দাবি, শুধু ঢাকা শহরেই কমপক্ষে ৩০ হাজার হিজড়া আছে। ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার হিজড়াদের একটি পৃথক লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
হিজড়ারা বলে, গ্রামাঞ্চলে কিংবা জেলা শহরগুলোয় হিজড়াদের একঘরে হয়ে থাকতে হয়। সে কারণে তারা মহানগরগুলোয় চলে আসে। এদিক থেকে ঢাকা তাদের সবচেয়ে পছন্দ। সদ্য জন্ম নেওয়া কোনো শিশুর খবর পেলেই বাসাবাড়িতে চলে আসছে হিজড়ারা। তাদের দাবির পরিমাণ অর্থ না দিলে বিশৃঙ্খলা শুরু করে। উত্তরা, রামপুরা, বাড্ডা, মিরপুরসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এমন ঘটনার খবর জানা যায়। এমনই এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘বাচ্চার বয়স ৩০ দিন না হতেই একদল হিজড়া এসে হাজির। হট্টগোল শুরু করে। ১০ হাজার টাকা না দিলে ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করার হুমকি দেয়। পরে ৫ হাজার টাকা দিয়ে রেহাই মেলে।’
গত বুধবার হিজড়াদের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত এক কর্মকর্ত । নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই ব্যক্তি বলেন, ‘অফিসের নারী সহকর্মীর সঙ্গে কাজে যাচ্ছিলাম। মহাখালীতে রিকশার জট লাগতেই দুই হিজড়া দুপাশে এসে দাঁড়িয়ে টাকা চাইল। নারী সহকর্মীর শরীরে হাত দিতে শুরু করলে ২০ টাকা দেই। কিন্তু তারা আজেবাজে কথা বলতে শুরু করে।’
এই বিষয়ে তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, টাকা না তুলে তারা নিরুপায়। তাদের আয়-রোজগারের কোনো সুযোগ নেই। বাধ্য হয়ে রাস্তায় নেমেছে। হিজড়াদের কেউ কেউ অভিযোগ করে বলে,ইদানীং কিছু নকল হিজড়ার কথাও বলছে অনেকে, যারা মূলত পুরুষ কিন্তু হিজড়া সেজে টাকা আদায় করছে।
সাধারণ মানুষ যেমন হিজড়াদের অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন, হিজড়াদেরও তেমনি রয়েছে অনেক বঞ্চনার কাহিনী। কেউ জন্মগতভাবে হিজড়া হয়ে জন্মালে বঞ্চনায় তাকে ছাড়তে হচ্ছে পরিবার ও সমাজ। কোথাও স্থান না পেয়ে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারায় বাধ্য হয়ে তাদের যোগ দিতে হচ্ছে হিজড়া সমাজে। গুরু মা’র নির্দেশে নামতে হচ্ছে চাঁদা আদায়ে। অনেকে বিভ্রান্ত হয়ে সার্জারীর মাধ্যমে লিঙ্গ পরিবর্তন করে হিজড়ায় রুপান্তরিত হচ্ছেন। এত বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করেও হিজড়াদের অনেকে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সাবলম্বী হচ্ছেন। বর্তমান সরকার হিজড়াদের সম্পত্তির ভাগ দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়া বয়স্ক ভাতা, প্রশিক্ষণ, বৃত্তিসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে হিজড়াদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে। হিজড়াদের চাঁদা তোলা অনেক পুরনো। আগে মানুষ যা দিত, তা নিয়েই খুশি থাকত। ইদানীং হিজড়াদের আচরণ বদলে গেছে। রাস্তাঘাট, বাসাবাড়ি, দোকানপাট যেখানে-সেখানে টাকার জন্য মানুষকে নাজেহাল করছেন তারা।
হিজড়াদের হাতে নাজেহালের শিকার হয়ে সম্প্রতি ফেসবুকে স্ট্যাস্টাস দিয়েছেন এক যুবক। পরে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায়, কিছুদিন আগে, তিনি তখন অফিসে। বাসায় সদ্য জন্ম নেয়া শিশু সন্তান, তার স্ত্রী ও শাশুড়ি। বারান্দায় বাচ্চার জমা-কাপড় মেলা দেখে ৪ সদস্যদের একদল হিজড়া এসে বাসার কলিং বেল বাজায়। তার স্ত্রী দরজা খুলতেই হিজড়ারা শয়ন কক্ষে ঢুকে পড়ে। বাচ্চাকে কোলে নিয়ে ২ হাজার টাকা দাবি করে। একপর্যায়ে তার স্ত্রী ৫০০ টাকা দিতে চাইলেও নিবে না বলে জানায়। বাচ্চাকে ওপরে শূণ্যে ছুড়ে খেলা করতে থাকে। এমনটি দেখে স্ত্রী ও শাশুড়ি চিৎকার করে ওঠেন। তখন পাশের বাসার বাসিন্দারা ছুটে আসেন। প্রতিবেশীসহ সবাই হিজড়াদের ১ হাজার টাকা দিতে চাইলেও কাজ হয়নি। পুলিশকে ফোন করলে বলা হয়, ‘কম-বেশি দিয়ে বুঝিয়ে-শুনিয়ে পাঠিয়ে দেন।’ প্রতিবেশীর কাছ থেকে ধার নিয়ে ২ হাজার টাকা দিয়েই হিজড়াদের বিদায় করতে হয়। অসহায় কণ্ঠে তারা বলে এ কেমন বিচার!

আবাসিক এলাকা ছাড়াও এদের উপদ্রব বেশি চোখে পড়ে ঢাকার প্রবেশ মুখে, বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টারের সামনে ও পার্কের আশপাশে। সন্ধ্যা হলেই কারওয়ান বাজার সংলগ্ন পান্থকুঞ্জ পার্কে এসে ভিড় করে একদল হিজড়া। ওই পথে পায়ে হেঁটে যাওয়া পথচারীদের নানা অঙ্গভঙ্গিতে ডাকে। এদের ডাকে সারা দিয়ে কেউ পার্কের ভিতরে গেলেই সর্বস্ব হারিয়ে বের হতে হয়। একাধিক গোপন সূত্র বলে, সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাদের এই অপকর্মের শেল্টার দিয়ে থাকে চাঁদার ভাগ পাওয়া স্থানীয় কয়েকজন যুবক এবং পুলিশ।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্যমতে উত্তরার হাউজ বিল্ডিং, রাজলক্ষ্মী, জসিম উদ্দিন, বিমানবন্দর এলাকা থেকে শুরু করে ঢাকা শহরের প্রায় বেশিরভাগ এলাকাতেই বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে হিজড়ারা মোটা অংকের অর্থ দাবি করে ঈদ, পূজা-পার্বণ, পহেলা বৈশাখ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক দিবসগুলোতে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে অশালীন অঙ্গভঙ্গি অপ্রীতিকর বক্তব্য প্রদান করেন তারা। সচেতন সমাজ মনে করেন তাদের টাকা-পয়সার প্রয়োজন আছে কিন্তু তাই বলে জোর করে অর্থ আদায় করা এটা চাঁদাবাজির শামিল। এই ব্যাপারে সচেতন মহল বলেন, এদের অত্যাচারে যাত্রীবাহী পরিবহনে চলাটাই দুষ্কর।
প্রশাসনের কাছে জানতে চাইলে তারা জানান, অনেক সময় হিজড়াদের বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হয় না। এদের নিয়ে অনেক সংস্থাই কাজ করে। সম্প্রতি চাঁদাবাজির অভিযোগে বেশ কয়েকজন হিজড়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিষয়টি আমরা গুরুত্ব সহকারে দেখছি। এদের নাজেহালের বিষয়টি কোন ভুক্তভোগী সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশকে জানানোর পরও পুলিশি সহায়তা না পেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা কিংবা থানার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বাবু/জেএম