উপকূলীয় জেলা পিরোজপুর মিষ্টি পানির জেলা হিসেবে পরিচিত হলেও বর্তমানে সেখানকার পানিতে মিশে গেছে লবণাক্ততা। এতে প্রভাব পড়েছে এখানকার কৃষি ও পরিবেশের উপর। সুপেয় খাবার পানিতেও দেখা দিয়েছে লবণাক্ততা। ফলে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন রোগে। এই পানির কারণে জেলার প্রায় ৭ লক্ষাধিক মানুষ রয়েছেন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে। আর ২০ হাজার হেক্টর জমির ফসল রয়েছে হুমকির মুখে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরের পর এ এলাকার জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে। জেলার সর্বত্র নোনা পানি ঢুকে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে জোয়ার ভাটায় পরিবর্তন দেখা দেওয়ায় লবণাক্ত পানি সমুদ্র পর্যন্ত যেতে পারেনি। ফলে এ এলাকার নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি হয়ে পড়েছে লবণাক্ত। এর প্রভাব দেখা দিয়েছে কৃষিক্ষেত্রে। মরছে গাছপালা উৎপাদন কমছে এলাকার অর্থকরী ফসল নারিকেল ও সুপারিতে, বাদ যাচ্ছে না ধানও।
এদিকে জেলার সর্বত্র লবণ পানি প্রবেশ করায় জেলার নদী নির্ভর পানির প্লান্টগুলোতে দেখা দিয়েছে সুপেয় পানির অভাব। অন্যদিকে টিউবয়েলের খাবার পানিতেও দেখা দিয়েছে লবণাক্ততা। এ জেলার মানুষ আমাশয়সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। তাছাড়া নদী-পুকুরের পানিতেও লবণাক্ততা থাকায় দেখা দিচ্ছে চর্মসহ বিভিন্ন রোগ। পানিতে লবণাক্ততা থাকায় কংক্রিটের নির্মাণ সামগ্রী আগের চেয়ে দ্রুততার সঙ্গে লবণাক্ততায় আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া যেসকল এলাকায় টিউবওয়েল (অগভীর নলকূপ) বসানো হয় সেখানে আর্সেনিকের ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে ডিপ টিউবওয়েল (গভীর নলকূপ) বসানো হলে এই সমস্যা থাকে না।
স্থানীয় বাসিন্দা মাহাতাব হোসেন বলেন, আমি ছোটবেলা থেকেই এই বলেশ্বরে গোসল করছি, মাছ ধরছি। আগে নদীর গভীরতা ছিল অনেক বেশি। কিন্তু এখন
দেখছি পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে গেছে। কীভাবে আসছে বা কোথা থেকে আসছে জানিনা। তবে এই পানি বর্তমানে ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। আমরা পৌরসভা থেকে যে খাবার পানি পাই সেটাও মাঝে মাঝে লবণাক্ত আসে। আমাদের শরীরে চামড়ার রং কালো হয়ে গেছে। লবণের কারণে মাটির উর্বরতা
শক্তি কমে গেছে।
কৃষক হাবিবুর রহমান বলেন, ফালগুন-চৈত্র মাসে নদীর পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে যায়। আগে এই পানি ব্যবহার করে আমরা যে চাষাবাদ করেছি সেটি বর্তমানে হুমকির মুখে। রবি শস্যসহ নারকেল-সুপারি আগের মতো ফলে না। আমরা চাই এটা যাতে প্রকট আকার ধারণ না করে। এ বিষয়ে সরকার দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।
রং মিস্ত্রী জালাল উদ্দিন বলেন, বর্তমানে ভবনগুলোতে যে পানি ব্যবহার করা হয় তাতে অনেক লবণ। যার কারণে ভবনের পলেস্তরা খুলে পড়ে। দেয়ালে রং টিকে না। কয়েকদিনের মধ্যেই ভবন সব নষ্ট হয়ে যায়। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না হলে আমরা বড় ধর বিপদে পড়ব।
পিরোজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম সিকদার বলেন, পিরোজপুরে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়েছে। তবে লবণাক্ততা দুই ধরনের। একটি পানির এবং অপরটি মাটির। শীতে লবণাক্ততা মটিতে কম থাকলেও পানিতে বেশি থাকে। তবে মাটির লবণাক্ততায় ফসলের উপর প্রভাব কম পড়ে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আমাদের যখন বৃষ্টি হবার কথা তখন হয় না। আবার যখন হবার কথা না তখন হচ্ছে। স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। যাতে কৃষির উপর জলবায়ুর প্রভাবটা কম আসে।
পিরোজপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল আলীম গাজী বলেন, পিরোজপুর সমুদ্র উপকূলবর্তী হওয়ায় লবণাক্ততা ও আর্সেনিকজনিতসমস্যা দেখা যায়। আমরা জনসাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ থেকে টিউবওয়েল বসিয়ে সেখানেও লবণাক্ততার বিষয়টি পেয়েছি। আমরা বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তাদের সুপেয় পানির পানের ব্যবস্থা করছি। আমরা ২০২১-২২ অর্থবছরে পানি সংরক্ষণ ও নিরাপদ পানি সরবারহের লক্ষে “জেলা পরিষদ মালিকানাধীন পুকুর-দীঘি পুনঃখনন প্রকল্প” এর আওতায় জেলার নাজিরপুর উপজেলায় ২টি ও নেছারাবাদ উপজেলায় ৩টি পুকুর খনন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি।
এছাড়া “সেভ ওয়াটার সাপ্লাই অ্যান্ড সেনিটেশন” প্রকল্পের আওতায় মঠবাড়িয়া উপজেলায় ৮টি পুকুর খনন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছি। যা থেকে মানুষ সুপেয় পানি পেতে পারে। তবে “ট্রিটমেন্ট প্লান্ট” প্রকল্পটি পৌরসভা আমাদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলে পাস করালে জনগণের সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে সেটি অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।
বাবু/ এনবি