মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫ ৩১ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ১৫ জুলাই ২০২৫
স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীর অবদান
অবন্তিকা চৌধুরী
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৩, ৫:০০ PM

আজ ২৬ মার্চ আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। দেশজুড়ে আমরা উদযাপন করছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। সুদূর অতীতের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যায়Ñ মুক্তিযুদ্ধে দেশের নারীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। তারা মুক্তিযুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধ থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। নানা কৌশল ও গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র পৌঁছে দেওয়া থেকে শুরু করে খাবারের ব্যবস্থা, হাসপাতালে সেবাদান, গোপন তথ্য আদান প্রদানে নারীরা ছিল এগিয়ে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নারীরা নানা কৌশল নিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। বন্দুক চালানো, গ্রেনেড নিক্ষেপ, ব্যারিকেড তৈরি, আত্মরক্ষাতে মরিচের গুঁড়া শত্রুর গায়ে নিক্ষেপ ইত্যাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো নারীদের। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাহাড় ঘেরা নির্জন জায়গায় ও কোন বাড়িতে এসব প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ নারীরা এসব প্রশিক্ষণ দিতেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের নিয়ে প্রথম সশস্ত্র ব্রিগেড তৈরি করেন একজন নারী কমান্ডার। সেখানে ছাত্রীদের রাইফেল চালানো, শরীর চর্চা, ব্যারিকেড তৈরি ও প্রাথমিক চিকিৎসা শিক্ষা দেওয়া হয়। ঢাকার কলাবাগান, রাজারবাগ, ধানমন্ডি, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বিভিন্ন স্থানে প্রথমে নারী ব্রিগেড তৈরি ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ওই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের অনেক নেত্রী সশস্ত্র ট্রেনিংয়ে অংশ নিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য ভারতে গিয়ে গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণ করেন। কলকাতায় একমাত্র মহিলা মুক্তিযুদ্ধা ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপিত হয়। ওই ট্রেনিং ক্যাম্পটি গোবরা ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত।

আওয়ামী লীগ নেত্রী সাজেদা চৌধুরী ওই ক্যাম্পটি পরিচালনা করতেন। ওই ক্যাম্পে প্রায় ৪০০ নারী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ওই ট্রেনিং ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের আগে নারীদের সাহসিকতা, রাজনৈতিক চেতনা ও দেশপ্রেম সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়া হতো। তারপর তাদের ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হতো। ভারতের একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার তাদের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দিতেন। সেখানে ১৬ জন করে তিনটি গ্রুপে ৪৮ জন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধে আগরতলা গেরিলা ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই সময়ের রোকেয়া হলের ছাত্রলীগ শাখার নেত্রী ফোরকান বেগমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ছাত্রীরা ছিলেন। তারা সীমান্ত অতিক্রম করে আগরতলায় যান। সেখানে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণের ক্যাম্পে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের কাছে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন। সেখানে নারী গেরিলা স্কোয়াডের নেতৃত্বে ছিলেন ফোরকান বেগম।

শুধু যুদ্ধই নয়, নারীরা নাটক, সঙ্গীত, মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহ প্রেরণাকারী বিভিন্ন ধরনের নাটক ও সঙ্গীত পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দিয়েছেন। আবার কেউ রণাঙ্গনে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা পালন করেছে। গ্রেনেট হামলায় উড়িয়ে দিয়েছেন গানবোট, হত্যা করেছেন পাকসেনাদের। অনেক নারী গেরিলা হামলায় নেতৃত্বও দিয়েছেন। এমন নানা কাহিনি লুকিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায় পাতায়।

মুক্তিযুদ্ধে ২০টির বেশি সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরজাহান বেগম ওরফে কাঁকন বিবি। সিলেটের এই মহান নারী ‘খাসিয়া মুক্তি বেটি’ নামেও পরিচিত। তিনি ছদ্মবেশে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র যোগান দেয়া থেকে শুরু করে সম্মুখযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের আরেক বীর নারীযোদ্ধা তারামন বিবি। তার জন্ম কুড়িগ্রামে। মহান স্বাধীনতার মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতার জন্য তাকে বীর প্রতীক খেতাব দেন।

৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর দেশব্যাপী যে গণজোয়ার শুরু হয়েছিল সেই গণজোয়ারে নারীরা পিছিয়ে ছিলেন না। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত নারীরা স্বাধীনতার পক্ষে জেগে উঠেছিল। মুক্তিযোদ্ধারা যখন পাড়া মহল্লায় গ্রাম গঞ্জ, শহর বন্দর থেকে মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার সময় মা-বোনেরা টাকা পয়সা সোনা দানা দিয়ে সহায়তা করেছিল।

মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে গিয়ে বহু নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার আলবদরদের কাছে নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছে। শুধু তাই না নারীরা ঝুঁকির মধ্যেও নিজের সন্তানকে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছিলেন। এমন কি বৃদ্ধ নারীরা ভিক্ষুক সেজে পাকহানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের দিতেন। ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসার দলে সেবিকার কাজ করতেন অনেক নারী। অনেক নারী আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাথমিক চিকিৎসা, অস্ত্র চালানো ও গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছিল। আবার কেউ মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে রান্নার দায়িত্ব পালন করছেন।

যুদ্ধকালীন নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও যৌন অপরাধ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। যুদ্ধকালে সাধারণভাবে দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারের কৌশল হিসেবে নারী নির্যাতন এবং ধর্ষণের মতো অপরাধ করা হয়ে থাকে। এটি আঘাত হানে নারীর সম্মানের উপর। মুক্তিযুদ্ধে টানা ৯ মাস সারাদেশে প্রায় আড়াই লাখ নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর, রাজাকারের হাতে ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু আজ ৫২ বছর পরও নেই নির্মম সত্যি কথাটি বলতে হয় বার বার। মুক্তিযুদ্ধে নারী অবদানের স্বীকৃতি মেলেনি আজও।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত