রবিবার ২২ জুন ২০২৫ ৮ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবার ২২ জুন ২০২৫
বঙ্গবন্ধু একজন কাব্যপ্রেমী সত্তা
সাজু কবীর
প্রকাশ: শুক্রবার, ৭ এপ্রিল, ২০২৩, ৭:৫৬ PM আপডেট: ০৭.০৪.২০২৩ ৮:০২ PM
‘শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল আমাকে বলেছে আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি’ কিংবা ‘মুজিব আমার স্বাধীনতার অমর কাব্যের কবি’ কিংবা ‘কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী/গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি/এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। অথবা ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী  মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান। কত চমৎকারভাবেই না কবিরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে কাব্যের সোনালি পাতায় স্মরণীয় করে রেখেছেন। এটি ছিলো তাঁর পাওনা। তিনিও কবি ও কবিতা অসম্ভব ভালোবাসতেন বলেই তিনি কাব্যজগতে অমর-অম্লান হয়ে আছেন।

বাল্যকালেই কবিতা তাঁর মন-মগজের সাথে একাকার হয়েছিল। তিনি সুগভীর আগ্রহ নিয়ে কবিতা মুখস্থ করতেন আবার মনের সুখে দরাজ কণ্ঠে আবৃত্তিও করতেন। পরবর্তীতে বক্তৃতার মঞ্চেও তিনি ক্ষেত্র বুঝে কবিতার যথাযথ উদ্ধৃতি দিতেন। এ কাব্যপ্রেমের কারণেই হয় তো তাঁর ভাষণগুলো কাব্যরূপ ধারণ করত। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের এক দার্শনিক, বাস্তবিক দিকনির্দেশনা। বঙ্গবন্ধু এ দীর্ঘ অভিযাত্রায় বাঙালির স্বাধীনতার আরেক স্বপ্নদ্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’র কাব্যদর্শন দ্বারা গভীরভাবে প্রাণীত হন। ‘বল বীর/বল উন্নত মম শির।/শির নেহারি আমারি নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির।...মহা বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত/আমি সেইদিন হব শান্ত/যবে, উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না।’ স্বাধীন দেশে প্রথম নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে নজরুল একাডেমির স্মারকগ্রন্থে বঙ্গবন্ধু  লেখেন, ‘নজরুল বাংলার বিদ্রোহী আত্মা ও বাঙালির স্বাধীন ঐতিহাসিক সত্তার রূপকার।’

১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিখ্যাত ‘নিউজ উইক’ পত্রিকা প্রচ্ছদ জুড়ে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রকাশ করে এবং তাঁকে ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ বা ‘রাজনীতির কবি’ বলে স্বীকৃতি দেয়।  তাদের নিবন্ধ ‘দ্যা পয়েট অব পলিটিক্স’ এ লেখা হয় ‘৭ মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা।’ ‘জয় বাংলা’ অভিধাটি আক্ষরিক অর্থে কাজী নজরুল ইসলামই প্রথম ব্যবহার করেন  ১৯২৪ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘ভাঙ্গার গান’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ অভিনন্দন’ কবিতায়। প্রকাশিত হওয়ার তিন মাস যেতে না যেতেই বৃটিশ সরকার গ্রন্থটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কবিতাটিতে ছিল বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের ভবিষ্যৎ মুক্তিযুদ্ধের অবশ্যম্ভাবী বিজয়ের ইঙ্গিত। বঙ্গবন্ধু এ কালজয়ী অভিধাকে স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করে এর জাদুকরী প্রাণশক্তি দিয়ে বাঙালি জাতিকে উজ্জীবিত করেছিলেন। ‘বাংলাদেশ’ যার কালজয়ী বিজয়।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দীক্ষাগুরু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে করাচি ভ্রমণে গাড়িতে কয়েকজন অ্যাডভোকেট ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ভাষায়Ñ আমার কাছে তাঁরা নজরুল ইসলামের কবিতা শুনতে চাইলেন। আমি তাঁদের ‘কে বলে তোমায় ডাকাত বন্ধু’, ‘নারী’, ‘সাম্য’ আরো কয়েকটা কবিতার অংশ শুনালাম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু-একটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাঁদের ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন।’ একাত্তরের রক্তঝরা মধ্য মার্চে সাংবাদিকদের সাথে এক সাক্ষাৎকারে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে দিতে গিয়ে এক পর্যায়ে তিনি নজরুলের কবিতা তরজমা করে বলেন, I can smile even in hell. বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের কবিতার উদ্ধৃতি দেন ‘চারিদিকে নাগিনীরা ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস, শান্তির ললিত বাণী শুনাইবে ব্যর্থ পরিহাস।’ অগ্নিঝরা মার্চের আরেক দিনের কথা। টঙ্গিতে পাকহানাদার বাহিনীর গুলিতে অসংখ্য শ্রমিক হতাহত হন। বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী শ্রমিকরা স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত এক বিশাল মিছিল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সমবেত হন। বঙ্গবন্ধু তাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিচ্ছিলেন। বক্তৃতার উপসংহারে গিয়ে তিনি উত্তেজিত সংগ্রামী শ্রমিকদের সুউচ্চ ভরাট কণ্ঠে বিদ্রোহী কবির কবিতার উদ্ধৃতি দেন ‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, আমি সেইদিন হবো শান্ত, যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ ভূমে রণিবে না।’ জেলখানায় একবার বাবা-মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। এ কষ্টকর সময়ে মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রকাব্যে আশ্রয় নেন। ‘মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলি স্মরণ করে একটু শান্তি পেলাম’ বলে মন্তব্য করেন। ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে আমি না যেন করি ভয়’ এমন কবিতা বঙ্গবন্ধু ধারণ করে মনে সাহস জোগাতেন।

বঙ্গবন্ধু তাঁর বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবনেও দুঃখ-দৈন্য-হতাশায়-উপেক্ষায় ‘বিপদে মোরে রক্ষা কর এ নহে মোর প্রার্থনা, বিপদে যেনো না করি আমি ভয়’, অথবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’ প্রভৃতি অসংখ্য কাব্যকথা মনের মাধুরী দিয়ে কণ্ঠে ধারণ করে শান্তি ও সান্ত্বনা খোঁজতেন। কারাজীবনে বঙ্গবন্ধুর সাথী ছিল ‘সঞ্চয়িতা’। কাব্যের প্রতি কতটা ভালোবাসা থাকলে এমনটি হয়। শান্তিনিকেতনের এক সময়ের শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরীকে মুক্তির পরে এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘সব মিলিয়ে ১১ বছর কাটিয়েছি জেলে। আমার সব সময়ের সঙ্গী ছিল এই সঞ্চয়িতা। কবিতার পর কবিতা পড়তাম আর মুখস্থ করতাম। এখনও ভুলে যাইনি। এই প্রথম মিয়ানওয়ালি জেলের নয় মাস সঞ্চয়িতা সঙ্গে ছিল না। বড় কষ্ট পেয়েছি।’

কবিতাপ্রেমিকদের প্রায় প্রত্যেকেই জীবনানন্দ দাশের কবিতার পঙ্ক্তি সময় পেলেই আবৃত্তি করে সুখ নিয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধুও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। তিনি তাঁর কবিতা মুখস্থ রাখতেন। পাকিস্তানের পাশবিকতা যখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে সেই গণহত্যা শুরু হওয়ার প্রাক্কালে সাংবাদিকরা তাঁর সাক্ষাৎকার নেন। এ সময় তিনি বিষাদের সুরে কান্না-কাতর কণ্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদ্ধৃতি দেন ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়।’ বঙ্গবন্ধুর ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রাম ছিলো বাঙালির অধিকার আদায়ের। বীভৎস পাকিস্তানি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে। লড়াই-সংগ্রামের এ সুদীর্ঘ সময়ে তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে যোগ হয়েছে অনেক মহৎ উপলব্ধি। স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবহিনীকে তিনি মনের মতো করে জনগণের কল্যাণে গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। তিনি সেনাবাহিনীকে ‘জনগণের বাহিনী’ বলে আখ্যা দেন। তাদের উদ্দেশে গঠনমূলক এক ভাষণে অনেক কল্যাণকর দিকনির্দেশনা দেন। ভাষণে তিনি বলিষ্ঠ অথচ স্নেহমাখা কণ্ঠে কবি জীবনানন্দ দাশের মা কবি কুসুমকুমারী দাশের কাব্য দ্বারা তাদের উদাত্ত আহ্বান জানান ‘মুখে হাসি বুকে বল তেজে ভরা মন, মানুষ হইতে হবে মানুষ যখন।’

তখন মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয় আমাদের ঘরে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ দেখার তৃষ্ণা তাঁর চোখে-মুখে-বুকে। অবশেষে দীর্ঘ ৯ মাস ১৪ দিন পাকিস্তানে কারাবাসের পর মুক্ত হয়ে তিনি দেশে ফিরেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকার তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে সর্বকালের সর্ববৃহৎ মহাজনসমুদ্রে তিনি যে ভাষণ দেন তাতে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতার ‘সাড়ে সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে, মানুষ করোনি’ আবৃত্তি করেন। পরক্ষণেই আবেগে আপ্লুত বঙ্গবন্ধু অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে উঠেন ‘কবিগুরু, তুমি এসে দেখে যাও, তোমার বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে, তুমি ভুল প্রমাণিত হয়েছো, তোমার কথা আজ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।’ এ ভাষণে তিনি দেশে ফেরার তীব্র আবেগ ও অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে কবিগুরুর ‘দুই বিঘা জমি’র ‘নমোনমো নম, সুন্দরী মম জননী বঙ্গভূমি! গঙ্গার তীর স্নিগ্ধ সমীর, জীবন জুড়ালে তুমি’ উচ্চারণ করেন। রেসকোর্স ময়দানের ভাষণের ঠিক দুই দিন পর ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর আহ্বানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন মন্ত্রিপরিষদ গঠন করেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের কিছুক্ষণ পর তিনি এক সাংবাদিকের মুখোমুখি হন। সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞেস করেন, ‘স্যার, আজাকের এ শুভদিনে জাতির প্রতি আপনার বাণী কী? উত্তরে তিনি কাব্যের আশ্রয় নেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর চিরাচরিত হাস্যস্মিত মুখে বললেন ‘উদয়ের পথে শুনি কার বাণী/ভয় নাই, ওরে ভয় নাই/নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’

বঙ্গবন্ধু হয় তো কাব্যচর্চা করে বিশ্ববরেণ্য কবি হতে পারতেন, কিন্তু তিনি তা করেননি। তাঁর কবিতা ছিল ‘বাঙালির অধিকার প্রতিষ্ঠা’। এ চর্চার ফসল হল ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূ-খণ্ড, একটি লাল-সবুজের পতাকা। অমর হয়ে রইলেন তিনি ‘জাতির জনক’, ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’ কিংবা ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে। বাংলা কাব্যাঙ্গনে তিনি চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন। কারণ, তিনি কবিতাকে ভালোবাসতেন।

তথ্যসূত্র : (স্মৃতির পাতায় জাতির জনক, তোফায়েল আহমেদ) (বঙ্গবন্ধুর কবি ও কাব্যপ্রেম, মো. আবু রায়হান) (বঙ্গবন্ধুর বয়ানে সাহিত্য ও সাহিত্যিক, পিয়াস মজিদ) (বঙ্গবন্ধু ও নজরুলের জয়বাংলা, সম্পা দাস 

বাবু/জেএম
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »


Also News   Subject:  বঙ্গবন্ধু   কাব্যপ্রেমী   সত্তা  







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত